আসগর মতিন
২০২৫ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হাঙ্গেরীর লাজলো ক্রাসনাহোরকাইকে। ২০০২ সালে হাঙ্গেরীর আরেক লেখক ইমরে কার্তেজ নোবেল সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। লাজলো নোবেল জয়ী দ্বিতীয় হাঙ্গেরিয়ান। নোবেল কমিটি সাইটেশনে বলেছে, ‘ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতেও শিল্পের শক্তি দেখানো তার প্রভাবশালী ও দূরদর্শী সাহিত্যকর্মের জন্য’ এ বছর তিনি সাহিত্যে নোবেল পেলেন। ক্রাসনাহোরকাই ডিস্টোপিয়ান ও বিষণতাময় উপন্যাসগুলোর জন্য খ্যাত। তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে আছে, সাটানট্যাঙ্গো, দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স। এগুলো পরবর্তীতে চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। তিনি ২০১৫ সালে ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পেয়েছিলেন, প্রথম হাঙ্গেরীয় লেখক যিনি এই পুরস্কারে ভূষিত হন এবং ২০১৯ সালে ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড ফর ট্রান্সলেটেড লিটারেচার জেতেন।
ক্রাস্নাহোরকাইয়ের জন্ম ১৯৫৪ সালের ৫ জানুয়ারি হাঙ্গেরির গিউলা একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে। তার বাবা, গিওর্গি ক্রাস্নাহোরকাই ছিলেন একজন আইনজীবী এবং তার মা, জুলিয়া প্যালিঙ্কাস, একজন সামাজিক নিরাপত্তা প্রশাসক। তার বাবা তার ইহুদি বংশোদ্ভূত পরিচয় গোপন রেখেছিলেন, কেবল ক্রাস্নাহোরকাই যখন এগারো বছর বয়স হয় তখনই তা প্রকাশ করেন।
১৯৭২ সালে, ক্রাসনাহোরকাই এরকেল ফেরেঙ্ক হাই স্কুল থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন, যেখানে তিনি ল্যাটিন ভাষায় বিশেষজ্ঞ হন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি জোসেফ আত্তিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমানে সেজেদ বিশ্ববিদ্যালয়) এবং ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বুদাপেস্টের ইওটভোস লোরান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইএলটিই) আইন অধ্যয়ন করেন। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি ইএলটিই মানবিক অনুষদে হাঙ্গেরীয় ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করেন এবং ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট শাসন থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর লেখক ও সাংবাদিক সান্দোর মারাই (১৯০০-১৯৮৯) এর কাজ এবং অভিজ্ঞতার উপর তিনি থিসিস রচনা করেন। ক্রাসনাহোরকাই প্রকাশনা সংস্থা গন্ডোলাত কোনিভকিয়াডোতে কাজ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৫ সালে, তার প্রথম উপন্যাস “সাতানটাঙ্গো” সাফল্য অর্জন করে এবং তিনি তাৎক্ষণিকভাবে হাঙ্গেরীয় সাহিত্য জীবনের অগ্রভাগে চলে আসেন। এটি ২০১৩ সালে ইংরেজিতে সেরা অনুদিত বইয়ের পুরস্কার লাভ করে।
লাজলো ১৯৮৭ সালে প্রথমবারের মতো কমিউনিস্ট হাঙ্গেরির বাইরে ভ্রমণ করেন, একটি ফেলোশিপের প্রাপক হিসেবে পশ্চিম বার্লিনে এক বছর কাটিয়েছেন। সোভিয়েত ব্লকের পতনের পর থেকে, তিনি বিভিন্ন স্থানে বসবাস করেছেন। ১৯৯০ সালে, প্রথমবারের মতো, তিনি পূর্ব এশিয়ায় উল্লেখযোগ্য সময় কাটান। তিনি মঙ্গোলিয়া এবং চীনে তার অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে The Prisoner of Urga and Destruction and Sorrow Be-neath the Heavens” রচনা করেন। তিনি বহুবার চীন সফর করেছেন। জার্মানির বার্লিনে বেশ কয়েক বছর বসবাসের পর, যেখানে তিনি বার্লিনের ফ্রি ইউনিভার্সিটিতে ছয় মাস এস. ফিশার অতিথি অধ্যাপক ছিলেন।
লাজলো মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে উচ্চকিত করেছেন। তার লেখাতে তা আছে। সেই সাথে আছে সমাজতন্ত্রের পতনের ঠিক আগমুহূর্তে অনিশ্চয়তা ও নিরাশার কথা। সাতানটাঙ্গো হাঙ্গেরির সাহিত্য জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস দ্য মেলানকোলি অব রেজিসট্যান্স (১৯৮৯ সালে প্রকাশিত, ইংরেজি অনুবাদ ১৯৯৮)। লাজলোর জন্মস্থান দক্ষিণ-পূর্ব হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলার মতোই একটি প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চল হলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের প্রথম উপন্যাস সাতানটাঙ্গোর (১৯৮৫ সালে প্রথম প্রকাশিত) প্রেক্ষাপট। এই উপন্যাসে উঠে এসেছে হাঙ্গেরির একটি গ্রামীণ পরিত্যক্ত সমবায় খামারে বাস করা দরিদ্র কিছু মানুষের কথা। সমাজতন্ত্রের পতনের সময়কাল বা আগমুহূর্তে যাঁরা অনিশ্চয়তা ও নিরাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন তাদের কথা। ১৯৯৩ সালে, তার উপন্যাস “দ্য মেলানকোলি অফ রেজিস্ট্যান্স” বছরের সেরা সাহিত্যকর্মের জন্য জার্মান বেস্টেনলিস্ট-পুরষ্কার পেয়েছিল। ১৯৯৬ সালে, তিনি বার্লিনে উইসেনশ্যাফ্টস্কোলগের অতিথি ছিলেন।
“ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার” উপন্যাসটি সম্পন্ন করার সময়, তিনি ইউরোপ জুড়ে ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেছিলেন। আমেরিকান কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ কাজটি সম্পন্ন করতে ব্যাপক সহায়তা করেছিলেন; ক্রাসজনাহোরকাই কিছু সময়ের জন্য গিন্সবার্গের নিউ ইয়র্ক অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করেন এবং তিনি বইটিকে জীবন্ত করার ক্ষেত্রে কবির বন্ধুত্বপূর্ণ পরামর্শকে মূল্যবান বলে বর্ণনা করেছিলেন। দূরপ্রাচ্যের নান্দনিকতা এবং সাহিত্য তত্ত্বের সাথে তার যোগাযোগের ফলে তার লেখার ধরণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে এবং বিষয়বস্তু প্রয়োগ করা হয়। তিনি প্রায়শই জার্মানি এবং হাঙ্গেরিতে ফিরে আসেন, তবে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, গ্রীস এবং জাপান সহ আরও বেশ কয়েকটি দেশে বিভিন্ন সময় কাটিয়েছেন, তার উপন্যাস “ সেইওবো দিয়ার বিলো”-এর জন্য অনুপ্রেরণা জোগাতে, যা ২০১৪ সালে সেরা অনুদিত বইয়ের পুরষ্কার জিতেছিল।
তার অনেক উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। বিখ্যাত চিত্র পরিচালক বেলা টার লাজলোর কাজের উপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে স্যাটানটাঙ্গো এবং ওয়ার্কমিস্টার হারমোনিজ। ক্রাস্নাহোরকাই শিল্পী ম্যাক্স নিউম্যানের সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে চিত্রিত উপন্যাস চেজিং হোমার (২০২১), যার সাথে রয়েছে জ্যাজ সঙ্গীতশিল্পী সিলভেসটার মিক্লোসের একটি মৌলিক পারকাশন স্কোর। ২০২০ সালে, “আকর্ষণীয় গল্প বলার প্রতি তার প্রতিশ্রুতির” জন্য তাকে মিনস্কে বোর্ট্রান্ড পুরস্কার প্রদান করা হয়।
আমেরিকান সমালোচক সুসান সোন্ট্যাগ লাজলোকে “সমসাময়িক হাঙ্গেরিয়ান অলৌকিক-উেেন্মাচনের মাস্টার হিসেবে বর্ণনা করেন, তাকে গোগোল এবং মেলভিলের সাথে তুলনা করতে অনুপ্রাণিত করেন” নিকোলাই গোগোল ইউক্রেনের বংশোদ্ভুত রুশ লেখক ও মেলভিল মবিডিক উপন্যাসের জন্য খ্যাতিমান আমেরিকান লেখক। ডব্লিউজি সেবাল্ড মন্তব্য করেছেন, “ক্রাসজনাহোরকাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গির সার্বজনীনতা গোগোলের ডেড সোলসের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং সমসাময়িক লেখার সমস্ত ছোটখাটো উদ্বেগকে ছাড়িয়ে যায়।”
সমালোচকদের মতে, ক্রাসনাহোরকাই এক অসাধারণ সাহিত্যভুবনের স্রষ্টা, যা তাঁকে হাঙ্গেরির অন্যতম প্রধান লেখক এবং নোবেল পুরস্কারের দীর্ঘদিনের প্রার্থী করে তুলেছিল। তাঁর গল্পগুলো গঠিত হয় একক এবং অবিচ্ছিন্ন বাক্যে, যা কখনো নমনীয়ভাবে জটিল দার্শনিক চিন্তার দিকে মোড় নেয়, আবার কখনো রসিকতায় ভরে ওঠে। তাঁর বিশ্বাস, ভালোবাসার মতো অভিজ্ঞতা, যা প্রকাশ করতে সময় ও সাহস লাগে তা সংক্ষিপ্ত বাক্যে ধরা যায় না। ক্রাসনাহোরকাই তাঁর জটিল ও গভীর ভাবনাপ্রসূত উপন্যাসগুলোর জন্য পরিচিত। তাঁর লেখাগুলো প্রায়শই প্রায়শই উত্তর-আধুনিক হিসেবে চিহ্নিত হয়, যেখানে তিনি দুঃস্বপ্নলোক ও বিষণ মানবঅভিজ্ঞতার নানা দিক অনুসন্ধান করেছেন।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের প্রারম্ভিক জীবন ভালো কাটেনি। কেটেছে ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে। পুলিশ তাঁর পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করেছিল। তাঁর প্রথম দিকের উপন্যাসগুলো, যেমন ‘সাটানটাঙ্গো’ ও ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’, সেই দমবন্ধ করা আবহই তুলে ধরে। ইউরোপের আইরন কার্টেনের পতনের পর তাঁর লেখায় আসতে থাকে একধরনের হালকা স্বচ্ছতা, যা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ উপন্যাসে, যেখানে তিনি গভীরভাবে যুক্ত হয়েছেন এশীয় শিল্প ও দর্শনের সঙ্গে, বিশেষ করে বৌদ্ধ ভাবনায়।
তাঁর সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হারশট০৭৭৬৯’-এ তিনি একদিকে জোহান সেবাস্টিয়ান বাখকে, আরেক দিকে জার্মান নব্য নাৎসিবাদকে পাশাপাশি স্থাপন করেছেন। আর দ্য ইয়েল রিভিউ এ তাঁর এ সদ্য প্রকাশিত গল্প ‘এন অ্যাঞ্জেল পাসড অ্যাবভ আস’-কে তুলনা করেছে ইউক্রেন যুদ্ধের কাদামাখা ট্রেঞ্চের বাস্তবতার সঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভর বৈশ্বিকীকরণের মায়াময় প্রতিশ্রুতিগুলোর।
ক্রাসনাহোরকাই ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের বিষয়ে হাঙ্গেরীয় সরকারের নীতির তীব্র নিন্দা করেছেন। এ থেকে ধারণা করা যায় তিনি যুদ্ধ বিরোধী, সেই সাথে সোভিয়েত তথা বর্তমান রাশিয়ার বিরোধী। তবে তার দেশের প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান ঘোর রুশ সমর্থক। অরবানের “অভ্যন্তরীণ স্লাভিক বিষয়” হিসাবে সংঘাতের চিত্র তুলে ধরাকে নৈতিকভাবে অপ্রতিরোধ্য এবং ঐতিহাসিকভাবে অসংলগ্ন বলে বর্ণনা করেছেন লাজলো। কারণ হাঙ্গেরির অতীতে রাশিয়ার আক্রমণের কারণে এটি অসংলগ্ন ছিল। ক্রাসনাহোরকাই যুক্তি দিয়েছিলেন যে আগ্রাসনের মুখে নিরপেক্ষতা জড়িত থাকার সমান এবং অরবান সরকারের যুক্তিকে এক ধরণের মানসিক অস্বীকৃতির সাথে তুলনা করেছেন। রাজনীতি সচেতন লাজলো যুদ্ধের ভীতিকর ফল কি তা ধারণ করতে পেরেছেন বলেই ইউক্রেন যুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন। তার নোবেল প্রাপ্তিতে এসব বিষয় যুক্ত বলে মনে করা যেতেই পারে।