আফসার নিজাম

একটি ইমারতে উঠার জন্য সিঁড়ি প্রয়োজন। সিঁড়ির দৈর্ঘ্য দেখেই বোঝা যায় যায় ইমারতে উচ্চতা। ঠিক তেমনি একজন মানুষের অবস্থান বুঝতে তার সৃষ্টিসমূহ দেখলেই বুঝা যায় তার প্রাজ্ঞতা। খন্দকার আবদুল মোমেনকে আমরা বুঝতে পারি তার সম্পাদিত সাহিত্য সাময়িকী ‘প্রেক্ষণ’ দেখে। তিনি প্রথাগত কোনো সাহিত্যিক নন। কিন্তু তিনি সাহিত্য সংগঠক এবং সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক। খন্দকার মোমেন একজন প্রকৃত ও প্রাজ্ঞ সাহিত্য বোদ্ধা এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। সাহিত্য পত্রিকা ‘প্রেক্ষণ’ই তার সাক্ষী। খন্দকার মোমেন একজন প্রথিতযশা সাহিত্যতিক হতে পারতেন কিন্তু তিনি সে দিকে হাঁটেননি। কেনো হাঁটেননি তার বয়ান আমার কাছে করেছন। তিনি বলেন ‘আমি যদি শুধুই লেখক হই তাহলে আমার মাত্র একটি লেখা হবে। কিন্তু আমি যদি দশজন লেখক তৈরি করতে পারি তাহলে দশটি লেখা হলো। আমাদের মিশন সাকসেস হবে। এটাই মিশনারীদের কাজ। আমি সেই কাজটিই করতেছি। যেটা আমাদের পূর্বপুরুষরা করে গেছেন।’ আমি সেই দিন থেকেই খন্দকার মোমেনকে চিনে গেছি। তিনি সাচ্চা সংগঠকই ছিলেন। কিন্তু সম্পাদক হওয়ার তার তেমন খায়েস ছিলো না। তিনি শিক্ষক মানুষ। ছাত্রদের জ্ঞান দিয়ে, মানে লেকচার দিয়ে ক্ষান্ত ছিলেন। তারপরও তিনি সম্পাদনা করেছেন। তিনি যখন ঢাকা সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্রের সভাপতি তখন তিনি ‘প্রেক্ষণ’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা করতেন। বেশ যত্নসহকারেই করতেন। যখন তিনি ঢাকা সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্রের সভাপতি থেকে অব্যহতি পান তখন সাহিত্য সংস্কৃতি থেকে অনেকটাই দূরে সরে যান। শুধুমাত্র শিক্ষকতা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ‘প্রেক্ষণ’ তখন তার মাথা থেকে উবে যায়। তিনি যেনো এর মধ্য থেকে চিরতরে দূরে সরে গেছেন।

মতিউর রহমান মল্লিক যে কিনা খন্দকার মোমেনকে দুলাভাই বলে সম্ভোধন করে থাকেন। তিনি তাঁকে আবার প্ররোচনা করেন সাহিত্যাঙ্গনে ফিরে আসতে। খন্দকার মোমেন বলেন, ‘আপনাকে প্রেক্ষণের ইতিহাস বলি।’ আমি বললাম বলেন। ‘আমি যখন সাহিত্য কেন্দ্র থেকে চলে আসি তখন আমার বিদায়টা তেমন সুন্দর ছিলো না। সেসব কথা থাক। ‘প্রেক্ষণ’টি আমি সম্পাদনা করলেও ঢাকা সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্রের কাছে রেখে আসি। কিন্তু মল্লিক ভাই বারবার আমাকে প্ররোচনা দিতে থাকেন। দুলাভাই আপনি প্রেক্ষণটি নিয়ে আসেন। আপনি এটা সম্পাদনা করেন। আমি বারবার তা প্রত্যাখ্যান করি। বলি এটা সংগঠনের জিনিস এটা আমি নিবো কোন অধিকারে। এটা আমানতের ক্ষেয়ানত হবে। আমি সংগঠনের কিছু নিতে পারবো না। তখন মল্লিকভাই বলেন, আপনি আজাহার ভাইকে বলেন, আমি মানছুরকে বলি। তারা না করবে না। আপনি যদি ‘প্রেক্ষণ’ সম্পাদনা না করেন তা হলে এটা আর প্রকাশ পাবে না। আমি লাজুক সভাবের মানুষ। কারো কাছে কিছু চাইতে লজ্জা করি। আমি চুপ করে বসে থাকি। প্রয়োজনে মল্লিকভাইকে এড়িয়ে চলি। আমাদের মাঝে দূরত্ব হতে থাকে। কিন্তু মল্লিক ভাই নাছোড় বান্দা। একবার যেটা বলে সেটা না করে ছাড়েন না। একদিন তার সাথে কাঁটাবনে দেখা। তিনি বলেন- চলেন। আমি বলি কোথায়। তিনি বলেন- চলেন। দুজনে রিকশায় উঠলাম। গিয়ে নামলাম মগবাজার। আল ফালাহ-য় একটি অনুষ্ঠান হচ্ছে। সেখানে আজাহার ভাই আছেন। মল্লিক ভাই দরস দিলেন। আমিও কথা বললাম। অনুষ্ঠান শেষে আজহার ভাইয়ের সামনে বসে মল্লিক ভাই ‘প্রেক্ষণ’-এর কথা তুললেন। আমি তো লজ্জায় মরি। মল্লিক ভাইয়ের আমাকে অপমান করার কি দরকার ছিলো। মনে মনে বেশ রাগ হচ্ছিল। মল্লিক ভাইয়ের কথায় আজহার ভাই রাজি হয়ে গেল। আর বললেন যদি কোনো সহযোগিতা লাগে বলবেন। আমি কিছু বললাম না। সেখান থেকে বের হয়ে বাংলা সাহিত্য পরিষদে গেলাম। সেখানে আবদুল মান্নান তালিব ভাইয়ের সাথে কথা হলো। তালিব ভাই বেশ খুশি। বললেন কিছুক্ষণ পর মানছুর আসবে তার কাছে জানিয়ে দাও। মল্লিক ভাই বললেন, আমি তার সাথে কথা বলেছি। সে রাজি আছি। আর এভাবেই ‘প্রেক্ষণ’ আমার হয়ে গেলো।

আমি এমন অনেক বিষয়ের সাক্ষী হয়ে আছি। আমি যেনো এক সাক্ষীবৃক্ষ। খন্দকার মোমেন একজন সংগঠক ঠিকই কিন্তু তিনি প্রধানত সম্পাদক। তার ‘প্রেক্ষণ’ নিয়ে আমাদের বেশ অভিযোগ ছিলো। তার বেশ সমালোচনা করতাম। কেনো তিনি শুধু মরে যাওয়া কবি সাহিত্যকদের নিয়ে সংখ্যা করেন। কেনো আমরা যারা বেঁচে আছি তাদের লেখা নিয়ে সংখ্যা করেন না। বা একটি সাধারণ সংখ্যা করেন না।

একদিন বাংলাদেশ সংস্কৃতিকেন্দ্রে খন্দকার মোমেন আসলেন। যথাসময়ে আহমদ বাসির ও রেদওয়ানুল হক-ও এসে যোগ দিলো। কারণ সেদিন ছিলো বিপরীত উচ্চারণের সাহিত্য আড্ডা। আড্ডাবাজ মল্লিক ভাইয়ের সাথে যথারীতি আড্ডা জমে উঠলো। এমন সময় কথা উঠলো প্রেক্ষণ নিয়ে। তরুণদের তীর্যক সমালোচনায় বিদ্ধ প্রেক্ষণ সম্পাদক। তাঁকে প্রশ্ন করা হলো কেনো তিনি মরা মানুষদের নিয়ে কাজ করেন। প্রশ্নটা আমারই ছিলো। মল্লিকভাইয়ে স্বভাবসুলভ ক্ষেপে গেলেন। কেনো তাঁকে প্রশ্ন করলাম। মোমেনভাই মল্লিকভাইকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, আপনি ওদের থামাতে পারেন না। ওদের কথা আপনি শোনেন। আপনি যদি না শোনেন তবে আপনি কিসের লিডার। মল্লিক ভাই থেমে গেলেন। এরপর তিনি বললেন আপনাদের সকল প্রশ্নের জবাব আমি দিচ্ছি। আপনারা প্রশ্ন করেন। শিক্ষক মানুষ তো তাই তিনি উত্তর দিতে পছন্দ করেন। আমরা প্রশ্নেবান ছুটিয়ে দিলাম। কিন্তু সার কথা ঐ আমার প্রশ্ন। কেনো জীবিত মানুষদের নিয়ে তিনি সংখ্যা করেন না। খন্দকার মোমেন উত্তর দেন। আমি যদি কেনো জীবিত মানুষকে নিয়ে সংখ্যা করতে যাই তখন তার সমসাময়িক অনেকেই লেখা দিতে চান না। তারা ভাবে আমি কি তার থেকে কম নাকি। আমাকে নিয়ে তো আপনি কোনো সংখ্যা করেন না। আমি দমে যাই। এরপর কোনো বিষয় ভিত্তিক সংখ্যা করতে গেলে ক্রমাগত লেখা চেয়েও লেখা পাই না। অনেকে বলে আমি ফরমায়েসি লেখা লিখি না। এরকম অনেক বাধা আছে। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম যারা মরে গেছে তাদের নিয়ে লিখব। কারণ যে মরে যায় তার কোনো শত্রু থাকে না। তার সাথে কেউ প্রতিযোগিতা করে না। আরো একটি বিষয় হলো যারা আমাদের চিন্তা দর্শনের মানুষ। ঐতিহ্য ধারার লেখালেখি করেছে, তাদের নিয়ে তেমন কাজ নেই। তাদের সম্পর্কে যারা লিখছেন তাদের লেখা নিয়ে আমি মূলত সংকলন করি। আমি জানি এই কাজটি এক সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। কারণ যখন আপনি ইসমাইল হোসেন সিরাজীকে নিয়ে লিখতে যাবেন তখন তার সম্পর্কে এতো লেখা কোথায় পাবেন। তখন আপনি প্রক্ষণের কাছে যাবেন। আপনাদের কষ্টটি আমি কমিয়ে দিয়ে গেলাম। আর একদিন এই প্রেক্ষণ হিরকখন্ড হবে। তার একটি সংখ্যা আপনি খুঁজে পাবেন না। সেই সংখ্যাটি এতো দরকারী হবে যে আপনি এই সংখ্যাটি সংগ্রহে না রাখার জন্য আফেসোস করবেন।

সত্যি খন্দকার মোমেন আপনার কথা সত্যি হয়েছে। আপনার সম্পাদিত প্রেক্ষণ আজ হিরকখন্ড। অনেকেই প্রেক্ষণে জন্য আমার কাছে দারস্থ হয়। আমি তখন অসহায় ভাবে আপনার কথা চিন্তা করি।

খন্দকার মোমেন অসুস্থ। আমাকে দেখা করার জন্য তার খালাতো শালা মাহবুব আলম ভাইকে বলেন, আমি যেনো তার সঙ্গে দেখা করি। কিন্তু সময় পাই না। মাহবুব ভাইকে নিয়ে তার বাসায় যাই। মোমেন ভাই বেশ অসুস্থ। তার পা ভেঙে বসে আছে। ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিল রোগো আক্রান্ত। আমরা যাওয়াতে তিনি বেশ খুশি। চিৎকার করে ভাবিকে বলছেন তোমার ভাই আজ আমার ভাই আসছে। কি খাওয়াবো তাড়াতাড়ি করো। খুশির চোটে ভাঙা পা নিয়েই আমাদের জন্য নাস্তা নিয়ে আসেন। মিষ্টিসহ বিভিন্ন প্রকার নাস্তা। মোমেন ভাই গপাগপ দুইটি মিষ্টি খেয়ে নেন। নাস্তাও খাচ্ছেন বেশ। মাহবুব ভাইকে লক্ষ করে বলেন তিন মেহমানের কথা বলেছি। তোমার আপা তিন জনের নাস্তা দিয়েছে। আমাকে লক্ষ করে বলেন, আমাদের বাড়ির সবাইতো ডাক্তার তাই আমি হাসপাতালে থাকি। খাবার নিয়ে বেশ কড়াকড়ি। তোমাদের উছিলায় আমি বেশি করে খেয়ে নিলাম। বুঝতেই পারবে না। আমরা তো হেসে কুটি কুটি। মাহবুব ভাই বলে আমি আপাকে বলে দিবো। মোমেন ভাই বলে খেয়ে যখন ফেলেছি আমাকে তো আর ফাঁসি দিব না। তারপর অনেক কথা হলো। সাহিত্য সংস্কৃতির বিষয়াবলী নিয়ে। তিনি বলে আজকাল কেউ দেখাও করে না কথাও বলে না। তাই আপনারা কি করেন জানতে পারি না। বেশ শরমিন্দা হলাম। আমাদের পূর্বসুরিদের আমরা কিভাবে ট্রিট করছি। এর খেসারত একদিন আমাদের দিতে হবে তা বেশ বুঝতে পারছি। দলবাজিতে যারা সামনের সারিতে অবস্থান করে তারাই শুধু কিছুটা সুযোগ ও সহযোগিতা পান। কওমের জন্য কুরবানি দেয়া অনেক নিবৃতচারী সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতজন সম্পর্কে আমরা বেখবর থাকি। মাথা নিচু করে যখন স্বীকার করি মোমেন ভাই আমরা আসলে ভুল করে ফেলছি। মোমেন ভাই বলেন, আপনি কি আপনার থেকে বড় দায়িত্বশীলরা খবর নেয় না। এসব কথায় এক সময় পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। তখন খন্দকার মোমেন আমাকে প্রস্তাব দেন। প্রেক্ষণ পত্রিকাটি আমি আর চালাতে পারছি না। আপনাকে এর দায়িত্ব দিতে চাই। আমি সম্পাদক থাকব। আপনি এর নির্বাহী থাকবেন। আমি মরে গেলে আপনি এই পত্রিকার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেবেন। আমি বেঁচে থাকতে আমাকে বাদ দিবেন না। আমি বললাম ভাই এই পত্রিকার দায়িত্ব কি আমি নিতে পারবো। হা পারবেন বলেই তো আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি। মাহবুব আপনাকে নিয়ে আসছে। আমি হা না কিছু বলে চলে আসলাম। বাংলাদেশ সংস্কৃতিকেন্দ্রে এসে আলাপ করলাম। এর অর্থনৈতিক ব্যয় নিয়ে আলাপ তোললাম। হাসান মুর্তাজা ভাই একটি নোট দেয়ার কথা বললেন। আমি সেই আলোকে নোট তৈরি করে দিলাম। কিন্তু ফাউন্ডেশন এতে রাজি হলেন না। আমার অর্থনৈতিক অবস্থা সেই পর্যায়ে নেই যে আমি একটি পত্রিকা চালাতে পারবো। পেরেশান হয়ে গেলাম। সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্রের যাকিউল হক জাকীর সাথে আমার তখন বেশ ভালো সম্পর্ক। তাকে প্রস্তাবটি দিলাম। কিন্তু সেই সময়ের রাজনৈতিক অবস্থা তেমন ভালো ছিলো না বলে সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র এর দায়িত্ব নিতে রাজি হলো না। মোমেন ভাই ফোন করেন। আমি বলি, বিষয়টি নিয়ে দেখতেছি ভাই। দেখা আর শেষ হয় না। কিছুদিন পর আমি আর লজ্জায় ফোন ধরি না। মাহবুব ভাইকে দিয়ে বলে দেই আমার পক্ষে সম্ভব না, মোমেন ভাইকে বলবেন আমাকে ক্ষমা করে দিতে। ক্ষমা করবেন খন্দকার মোমেন, আমি সরাসরি আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে পারিনি।