ড. ফজলুল হক তুহিন

ইতিহাস যেমন পরিবর্তনশীল, একজন ইতিহাসচেতন কবির কাব্যে ইতিহাসচেতনার গতিস্রোতও তেমনি সর্বদা অগ্রগামী। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অপরিহার্য ও ঐতিহ্যবোধে উজ্জীবিত কবি আল মাহমুদের কবিতায় এমন বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। প্রথম পর্যায়ের কবিতা থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ের কবিতায় ইতিহাসচেতনা ব্যাপকতা ও বৈচিত্র্য লাভ করে। তৃতীয় পর্যায়ে এসে ইতিহাসচেতনার চেয়ে ঐতিহ্যবোধ বেশি মাত্রায় প্রয়োগ হয়েছে। তবে ইতিহাস চেতনা পূর্বের থেকে ভিন্ন মাত্রায় রূপলাভ করে।

আল মাহমুদ বাংলা চতুর্দশ শতাব্দী অতিক্রম করতে দেখেছেন; আবার বিংশ শতাব্দীও অস্ত গিয়েছে তার চোখের সামনে। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় ‘শতাব্দীসন্ধির নৃত্য’ অবলোকন ও অনুভব করেছেন। ইতিহাসচেতন কবির বুকের জমিনে বিনাশী সমকাল গভীর ক্ষতচিহ্ন রেখে যায়। কবির ভাষায়: “আধুনিক কবির প্রধান বিষয় হলো তার সময়। নিজের কালের চাকা নিজের বুকের ওপর দিয়ে গড়িয়ে যাওয়ার যন্ত্রণাকে বর্ণনা করার নামই হল আধুনিকতা। আমার সময়ের চাকা আমার অস্তিত্বের ভেতর একটি গভীর ক্ষতচিহ্ন রেখে চলে যাচ্ছে। এর আনন্দ-বেদনা-মর্মর ধ্বনি আমার মর্মে লেগে আছে।’’ [আল মাহমুদ: সাক্ষাৎকার, ২০০৩] অর্থাৎ বৈনাশিক কালের আশা ও প্রাপ্তি, সাধনা ও ব্যর্থতা অনুভব করে কবি যেমন কালজ, তেমনি অবিনাশী ঐতিহ্য ধারণ করে কালোত্তর। অস্তগামী শতাব্দীর শেষ রশ্মি কবির উপলব্ধিতে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের ভাবনা নিয়ে বিচ্ছুরিত।

ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা নই। কিন্তু জেনো কবির নয়ন

ভেদ করে গ্রহান্তর, পার হয় সমস্ত উদ্যম,

কেন এত রক্ত তবে, কেন এত মৃত্যুর বয়ন

তাঁত বুনে ব্যর্থতার? নক্সা তোলে তোমারই প্রথম।

আরও শতবর্ষ বড়ো ক্লান্তিকর। রক্তক্লেদমাখা

একটি তারার ভাগ্য মানুষের করায়ত্ত নয়,

তাহলে অদৃশ্য মানো, অদৃষ্টেই মেলে দাও পাখা

মানো যে নিয়ত্তা তিনি, তার হাতে জয়-পরাজয়।

[‘শতাব্দীর শেষ রশ্মি’, দ্বিতীয় ভাঙন]

কবি বিশ শতকে অবলোকন করেছেন মানুষের রক্তাক্ত, মৃত্যুময় ও ব্যর্থ জীবনের চিত্রাবলী। কবি নিজেকে ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা না বললেও মহাবিশ্বে তিনি সর্বভেদি দৃষ্টির অধিকারী হিসেবে চিহ্নিত করেন। সেজন্যে আগামী একশত বছরব্যাপী মানুষের জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণা-ব্যর্থতার কথা ভেবে কবি উদ্বিগ্ন। তবে মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেহেতু সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্রের ভাগ্য, তাই কবি অদৃশ্য স্রষ্টার প্রতি আস্থাশীল হতে বলেছেন। আবার বিশ শতকের অভিজ্ঞতায় কবি মানুষের দুর্ভাগ্য, দুরাবস্থা ও অস্তিত্ববিনাশী ভূমিকায় বিজ্ঞানকে অবতীর্ণ হতে দেখেছেন। একুশ শতকের পৃথিবীতে শান্তিপূর্ণভাবে স্বস্তি ও সুখের সাথে বসবাস করতে হলে মানুষের কল্যাণেই ‘পরম বিজ্ঞান’কে নিয়োজিত করতে হবে। অতিক্রম করে যেতে হবে প্রযুক্তি বা যন্ত্রের আধিপত্য। কবি অতীত ও বর্তমানের কুশ্রীতা ও প্রাণঘাতি কার্যক্রম পেছনে ফেলে সুস্থ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ পৃথিবীর নির্মাণের আহ্বান জানান।

আল মাহমুদ কবিতায় জীবন ও চারপাশের প্রকৃতিতে ইতিহাসের স্রোত উপলব্ধি করেন। কবির বয়স যখন ষাটোর্ধ্ব তখন তিনি শরীরে সময়ের ছাপচিহ্ন বা গ্লানি অনুভব করেন। যাপিত জীবনের হাজার বিস্মৃতি যেন আবারো জেগে ওঠে, তারা কবিকে বিদ্ধ করে অতীতের জগতে নিয়ে যায়। এই যে বর্তমানের অতীত থেকে বহমানতা বা কালস্রোত, একে কবির কাছে ‘পানির মতো’ মনে হয়েছে ‘উড়াল কাব্যে’র “চতুর্দশপদী” কবিতায়। নদীর পানির স্রোতধারা ও মহাবিশ্বের কালস্রোত একই ধর্মে প্রবহমান। সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে বর্তমান হয়ে ভবিষ্যতের দিকে তার যাত্রা। কিন্তু মানুষের ও কবির জীবন অতীতের স্মৃতিসহ বর্তমানেই সমাপ্তি ঘটে। প্রকৃতির কোনো কোনো উৎসধারারও অবসান হয় কালস্রোতের।

সময়ের প্রাণরস? প্রকৃতির নিগূঢ় ভেষজে

যৌবন ফেরে না আর। চারপাশে ঝরে যাওয়া সমাপ্তির গান

মর্মবেদনার মত; বালি ওড়ে কীর্তিনাশা নদীর বিরান

পেট থেকে কাদাখোঁচা পাখি এক কাদাখুঁচে আহার্যের খোঁজে।

নদীর মৃত্যুর পর তার সিক্ত তলপেট ঘেটে

যা পেয়েছি এঁটোকাঁটা সময়ের জিহ্বা নেয় চেটে।

[‘চতুর্দশ পদী’, উড়ালকাব্য]

সময়ের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা বা শোষণ ক্ষমতার কারণে কবির জীবন যেমন সমাপ্তির দিকে বেগবান, তেমনি নদীর মরণ ও পরবর্তী অবশিষ্টও কালের গহ্বরে বিলীয়মান। অর্থাৎ প্রকৃতি ও জীবনের সূচনা অতীত কালে এবং সমাপ্তি এগিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যৎ পানে। বর্তমান বিজ্ঞানে অতীত ও ভবিষ্যৎ কালের মধ্যে কোনো পার্থক্য করে না। স্টিফেন ডব্লুউ হকিং-এর মতে:

বিজ্ঞানের বিধি কালের অগ্রগতি ও পশ্চাত গতির ভেতর কোনো পার্থক্য করে না। কিন্তু কালের অন্তত এমন তিনটি তীর রয়েছে যেগুলি অতীত এবং ভবিষ্যতের ভিতর পার্থক্য করে। সেগুলো হলো তাপগতীয় তীর অর্থাৎ যে অভিমুখে বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পায়, মনস্তাত্ত্বিক তীর অর্থাৎ কালের যে অভিমুখে আমরা অতীত স্মরণ করি কিন্তু ভবিষ্যৎ স্মরণ করি না এবং মহাবিশ্বতত্ত্বভিত্তিক তীর অর্থাৎ যে অভিমুখে মহাবিশ্ব সঙ্কুচিত না হয়ে সম্প্রসারিত হয়।

অর্থাৎ মহাবিশ্ব অতীতে আরম্ভ হয়ে ভবিষ্যতের দিকে একটা পরিসমাপ্তির জন্যে অগ্রসরমান। বিজ্ঞানে তাই অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে পার্থক্য স্বীকার করে না। আল মাহমুদ তাঁর কবিতায় সময়ের এই স্রোতকে একই দৃষ্টিতে ‘পানির মত’ বলেছেন। এক কথায়, কালস্রোত নদীর পানির মতই একটা প্রবহমান ধারা।

অখণ্ড ও বহমান সময়ের ধারণা কবির ইতিহাস চেতনার ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে ‘না কোনো শূন্যতা মানি না’ কাব্যের ‘‘মানুষের দীর্ঘশ্বাস’’ কবিতায়। বর্তমান সময়ের বিক্ষুব্ধ, সন্ত্রাস কবলিত ও হতাশাগ্রস্ত জীবনের অতীত সিঁড়িগুলোর কথা কবি বর্ণনা করেন। কবির যাত্রারম্ভ হয় বেবিলন থেকে। কালের ক্ষয়ে তাঁর ইন্দ্রিয়গুলো অকেজো হয়ে গেছে। শ্রবণ শক্তির ক্ষয়প্রাপ্তির কারণে মানুষের কান্নাভরা নগরগুলোর মধ্য দিয়ে পার হয়ে গেলেও কবি শুনতে পাননি মানুষের মর্মবেদনা। দৃষ্টিশক্তি প্রায় শূন্যে চলে আসায় কবি মানুষের দুর্দশা দেখতে পাননি। এই না পারার ব্যর্থতা তাকে মর্মে মর্মে পীড়া ও দুঃখ দিয়েছে। তবু কবি জীবনের গন্তব্যের অন্বেষণে প্রাচীন সভ্যতা থেকে তাঁর বসবাসের নগর ঢাকায় এসে পৌঁছিয়েছেন।

কলরব মুখর নগরগুলোই ছিল আমার গন্তব্য। বেবিলন

থেকে আমার শুরু, তারপর ক্রমাগত ধ্বংসের মধ্যে এখন

আমি যে শহরে এসে দাঁড়িয়েছি, তার নাম ঢাকা মহানগরী।

আমি এখানে আর কোনো শব্দ শুনতে পাই না। কত বোমা ছিন্ন-ভিন্ন

করে দিচ্ছে মানুষের রক্ত-মাংস।

[‘মানুষের দীর্ঘশ্বাস’, না কোনো শূন্যতা মানি না]

কবির মাঝে যে ভ্রমণপ্রিয় ও অনন্ত সত্তা বিরাজ করে, সেই সত্তাই সভ্যতার পথপরিক্রমা শেষ করে একটা গন্তব্য পাবার আশায় বর্তমানে ঢাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। কবি সব সময় ভাবতেন নৈঃশব্দই শেষ ঠিকানা। কিন্তু কবি বিনাশপ্রাপ্ত ও অবলুপ্ত সভ্যতার মহানগরীগুলোর ভেতরে মানুষের চিরজায়মান কলরব অর্থাৎ মানবিক অভিব্যক্তির অনুভব করেন, তাই তাঁর কাছে মানুষের জন্যে একটা শান্তিময় ‘গন্তব্য’ বা ‘শেষ ঠিকানা’ শেষ পর্যন্ত অধরাই থেকে গেছে। ইতিহাসের পথ পাড়ি দিয়ে সমকালে কবি নিরাশায় নিমগ্ন। ফলে কবি শুনতে পান না মানুষের আর্তনাদ, যন্ত্রণা ও দুঃখÑ বর্তমানে এসে যেন সেই বহমান মানবিক বোধের স্রোত থেমে গেছে।

কবি ইতিহাসচেতনায় সময়ের ধারণা প্রকাশ করেন ‘বারুদগন্ধী মানুষের দেশ’ কাব্যে। মানুষ সময়কে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নামে বিভক্ত করে নিয়েছে। কবি নিজেকে সেই ‘ধুনকর’রূপে চিহ্নিত করেন যে তার নারীর জন্যে মেঘমালা ধুনে যায়। পৃথিবীর মানুষের অন্যায়-জুলুম-ক্লেদ সবকিছুর অভিযোগ মেঘের বালিশে ঠেস দেয়া তার নারীর কাছে নীল প্লেটে জমা হয়। কবি অবিরাম ধুনে যান সেই চঞ্চল ও গতিশীল মেঘপুঞ্জ। এই নারী আসলে ইতিহাসের চলমান মানবিক অভিব্যক্তির আধার বা প্রতীক। কবিও ইতিহাসের অমর সত্তারূপে সেই অনুভূতির ধারক।

ফের আমি ধুনকর, ধুনযন্ত্রে তুলি দ্রিম দ্রিম

আমার আরম্ভ নেই, শেষ নেই, আমিই আদিম।

[‘আমি সেই ধুনকর’, বারুদ গন্ধী মানুষের দেশ]

অনন্ত ও সৃজনশীল যে সত্তা কবি ধারণ করে আছেন, সেই সত্তাই কল্পনায়, স্বপ্নে, মনের সত্যে চিরকাল কার্যকর। একবার অতীতে, অন্যবার বর্তমানে, আবার ভবিষ্যতে গমন করতে তাঁর বাধা নেই। কারণ সৃষ্টিশীল সত্তার কোনো মৃত্যু নেই। সেদিক থেকে একে কবি-আত্মাও বলা যায়। কারণ আত্মার কোনো বিনাশ নেই, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ নেই। আত্মা অবিনশ্বর ও আদিমÑ যার সূচনা ও শেষ বলতে কিছু নেই। তাই কবি সময়ের অখণ্ডতা ও আত্মার অমরত্বের যুগ্মরূপ ধারণ করেছেন এবং নিজেকে ‘আমিই আদিম’ বলে পরিচয় দিয়েছেন। সেই সঙ্গে রোমান্টিক মনোভাবের তীব্র প্রকাশ ঘটেছে তাঁর এই কাব্যে। কেননা রোমান্টিক মন দূর ইতিহাসের পথের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপে অভ্যস্ত।

আল মাহমুদ ইতিহাসচেতনাকে ব্যক্তিক প্রেম, প্রকৃতি, সমাজ ও রাজনীতি ভাবনার অন্তর্দেশে প্রবাহিত করেন। মহাকালের সঙ্গে কবির উক্তি ও উপলব্ধির যোগসূত্র স্থাপন করেন নিজস্ব আঙ্গিকে। তবে সবকিছুর কেন্দ্রে তাঁর বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মাটি, মানুষ, সমাজ ও সংস্কৃতির কল্যাণকামী আকাক্সক্ষা বর্তমান।