মীম মিজান

বিশ্বসাহিত্যে কেবল সৌন্দর্যের অন্বেষণই কবিতার কাজ নয়; অনেক সময় কবিতা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক প্রতিবাদ, আত্মমুক্তির আহ্বান এবং সামাজিক পরিবর্তনের অস্ত্র। বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯–১৯৭৬) এবং ফারসি সাহিত্যের বিপ্লবী কবি ফাররুখি ইয়াজদি (১৮৮৯–১৯৩৯) দুই ভিন্ন মাটির সন্তান হয়েও তাঁদের কবিতা এক অভিন্ন চেতনার ভাষ্য বহন করে। আর সমুচ্চারণ করে বিদ্রোহ, সাম্য, প্রেম ও আত্মার মুক্তির।

উভয়ের কবিতা যেন সমাজের নিপীড়নের বিরুদ্ধে রক্তজাগ্রত উচ্চারণ। তাদের মধ্যে রয়েছে সময়ের অভিন্নতা, কাব্যিক প্রতিবাদী মনোভঙ্গি, গভীর প্রেমানুভব এবং আধ্যাত্মিক সংবেদনশীলতা।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও কবির জীবন:

নজরুল জন্মগ্রহণ করেন ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনে; শৈশবে ধর্মীয় শিক্ষা, সেনাবাহিনীতে কাজ, পরে সাংবাদিকতা ও সাহিত্যজগতে প্রবেশ তাঁকে গড়ে তোলে এক বহুমাত্রিক লেখকে। তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কারাবরণ করেন, যার মধ্যেই তিনি লেখেন অমর কবিতা “রাজবন্দীর জবানবন্দি”।

অন্যদিকে ফাররুখি ইয়াজদি, জন্ম ইরানের ইয়াজদ শহরে। তিনি কনস্টিটিউশনাল রেভলিউশন তথা সাংবিধানিক বিপ্লবের ধারায় বেড়ে ওঠেন এবং পরবর্তীতে পহলভি শাসকের কঠোর সমালোচক হয়ে ওঠেন। তাঁর কবিতা রাজনৈতিক প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। অনেকবার কারারুদ্ধ হয়েছেন, এমনকি সুঁই-সুতো দিয়ে তাঁর প্রতিবাদী ঠোঁটদ্বয়কে সেলাই করে দেয়া হয়েছিলো। শেষমেশ ১৯৩৯ সনে কারাগারেই শহীদ। এয়ার ইঞ্জেকশন পুশ করে তাকে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশে যেমন গুম বা আয়নাঘরের বন্দীদের কোনও লাশ বা কবর মেলে না, ঠিক তেমনই তাঁর লাশ বা কবরের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায় না। অথচ এখন তিনি তাজুশ শুয়ারা বা কবি সম্রাট তথা কবিকূল শিরোমণি হিসেবে সমাদৃত।

এই দুই কবির জীবনই শাসকের রোষানলে পড়ে কবিতা ও অস্তিত্বের লড়াইয়ের ইতিহাস রচনা করেছে।

বিদ্রোহ ও প্রতিরোধের কবিতা:

কাজী নজরুলের সবচেয়ে আলোচিত ও প্রতীকী কবিতা “বিদ্রোহী”-তে তাঁর আত্মপ্রতিষ্ঠা এবং প্রতিবাদী চেতনার চূড়ান্ত প্রকাশ পাওয়া যায়:

“আমি চির-বিদ্রোহী বীর

বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!”

এখানে কবির ব্যক্তিগত ‘আমি’ এক সর্বজনীন মুক্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। ব্রিটিশ উপনিবেশিকতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সামাজিক বৈষম্য সবকিছুর বিরুদ্ধে তিনি এক বিপ্লবী উচ্চারণ তৈরি করেন।

ফাররুখি ইয়াজদির বিখ্যাত কবিতা জেন্দান নামে বা কারাগারের পত্র-তে পাওয়া যায় একই রকম তীব্র প্রতিবাদ:

“বিয়া ত গোলে বারাফশনিম ও মি দার সগের আন্দাজিম

ফালাক র শাফাক বোশকাফিম ও তরহি নো দারান্দজিম”

অর্থাৎ,

আসো, ফুল ছড়িয়ে দিই, সুরা ঢেলে দিই

আকাশের ছাদ ভেঙে ফেলি, নতুন এক বিশ্ব রচনা করি।

এই আকাক্সক্ষা কেবল সৌন্দর্যের নয়, বরং ধ্বংস ও নির্মাণের বিপ্লবী স্বপ্ন। কবির স্বপ্ন এক নতুন সমাজ ব্যবস্থার যেখানে শোষণহীন ও স্বাধীনতা থাকবে।

প্রেমের মধ্যে বিপ্লব:

দুই কবির কবিতায় প্রেম শুধু হৃদয়ের অনুভূতি নয়, বরং অনেক সময় রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক মুক্তির পথপ্রদর্শক।

নজরুলের দারুণ প্রেমের কবিতা “ভাঙার গান”-এ যেমন পাওয়া যায় প্রেমিকের জন্য একধরনের সাম্যবাদী আকুতি:

“তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়

সে কি মোর অপরাধ?”

এখানে প্রেমিকাকে চাওয়ার মধ্যে মানবিক মর্যাদা ও সমতা প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা রয়ে যায়।

ফাররুখি ইয়াজদি বিদ্রোহী, তবে প্রেমহীন নন। যে বিদ্রোহী সে তুমুল প্রেমিকও। কেননা, সে দেশ মাতৃকাকে অসম্ভব ভালোবাসে বলে স্বৈরাচারের রক্তচক্ষুকে ভয় পায় না। জীবনের মায়া অতি তুচ্ছ। তাই ফাররুখি অন্যতম প্রেমিক কবি। এমনই ভাস্বর প্রেম তাঁর কবিতায় দেখা যায়:

“তু এই পরি কুজায়ি

কে শাবে দেরাজ দরাম”

অর্থাৎ

কোথায়, আমার স্বপ্নের প্রেয়সী

একা, শূন্য, কীভাবে কাটাই দীর্ঘ নিশি।

এই রাত্রি যেন কেবল প্রণয়ের নয়, বরং রাজনৈতিক অন্ধকার ও আত্মিক একাকিত্বেরও প্রতীক। এখানে স্পষ্ট যে, স্বাধীনতা বা সার্বভৌমত্ব এবং নাগরিক অধিকারের দলিল সংবিধান প্রেয়সী। তার অভাবেই নাগরিক জীননে অন্ধকার নিশি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর।

আধ্যাত্মিকতা ও আত্মানুসন্ধান:

উভয় কবির কবিতায় রয়েছে সুফিবাদী ছোঁয়া এবং আত্মানুসন্ধান। নজরুল যেমন ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে কলম ধরেন, তেমনই তাঁর অনেক কবিতা সুফি কাব্য-ধারার অনুস্মারক। নজরুলকে খোদ ভারতের লোকজন কিংবদন্তি সংগীতজ্ঞ হিসেবে সম্মান দেন। এখনও নজরুলকে কেউই ইসলামি গানের সংখ্যা আবেদনে অতিক্রম করতে পারেনি। আধ্যাত্মিকতার এক পরম পুষ্পবাগ হচ্ছে নজরুলের সংগীত।

নজরুলের এমনই সংগীত-

‘মসজিদের পাশে আমার কবর দিও ভাই’:

‘যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।’

এই সংগীতে ইহকালীন সফর শেষ করে যে পরকালীন সৌভাগ্যময় সময় ও অবস্থানের কথা উৎসারিত হয়েছে, তেমনি আত্মিক জাগরণ ও ধার্মিক ভালোবাসার চমৎকার মিশেল একীভূত হয়েছে।

ফাররুখি ইয়াজদি নজরুলের মতো তীব্র খোদাপ্রেম রাখেননি। তবে ধর্মীয় আবহ তাঁকে স্পর্শ করেছে। ফলে নিজ কবিতায় ইশক-ই-হাকিকির তথা পরমের প্রেমের ভাবনা প্রস্ফুটিত হয়েছে। যেমন:

“আগার যে বাহরে তু মি সুজাম, বেগু তু বাহরে কে কি সুজি?”

অর্থাৎ,

যদি পুড়ে যাই প্রিয়া, তোমার প্রেম চেয়ে

কেনো তবে ভুলে থাকো, কার প্রেম পেয়ে।

এখানে প্রশ্নটি আবরণে মোড়ানো। আর সেই আবরণের মধ্যে লুকিয়ে আছে স্রষ্টা আর সৃষ্টির পারস্পরিক সম্পর্কের সুলুকসন্ধান। এমন সুলুকসন্ধানই ফাররুখিকে করেছে অন্যতম প্রিয় কবির মূর্ত প্রতীক।

সাম্যবাদ, মানবমুক্তি ও প্রগতিশীলতা:

নজরুল গোটা জীবনই কাটিয়ে দিলেন সাম্যবাদ নিয়ে। উঁচুনিচু, ধনী-নির্ধন, ব্রাহ্মণ্-নমশুদ্র ইত্যাদির বিরুদ্ধে খড়গহস্ত ছিলেন। লেখার অনেকাংশেই প্রোজ্জ্বল উদাহরণ দিয়েছেন তিন। কোনও আড়াল আবডাল করেননি। স্পষ্টভাবে সাম্যের গান গেয়েছেন:

“গাহি সাম্যের গান-

যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান!”

এই উচ্চারণ ইসলামের সুমহান চেতনার এক নিখুঁত নিদর্শন।

ফাররুখি ইয়াজদিকে আজ ইরানসহ গোটা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষ অত্যন্ত প্রিয় ও নিজের কবি মনে করেন। কেননা, ছত্রে ছত্রে সাম্যবাদ, সাধারণ মানুষের অধিকার ঝংকৃত হয়েছে। ফলে তাঁর লেখা এক রাজনৈতিক শ্লোগান পরিণত হয়েছিল। ইরানের বিপ্লবী আওয়াজের এক উচ্চকিত কণ্ঠ তিনি। যেমন বলছেন:

“নাহ শারকি, না গারবি, জমহুরি ভকয়ি।”

অর্থাৎ, পূর্ব বা পশ্চিমে কাজ নেই, তুই স্বৈরাচার

প্রকৃত প্রজাতন্ত্রই চাই, না কোনও কাজার।

প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও সাম্যবাদী চিন্তার লালনকারীগণের চাওয়া দেশের মানুষকে দেশের যোগ্য শাসকই সেবা দিবে। শোষণ নয়। এই চেতনা বা বিশ্বাস বা ধারণা কোনও ফিরিঙ্গ দেশ তথা পশ্চিম থেকে মানেন না। কিংবা পূর্ব চিন ও অন্যান্য স্বৈরাচারকেও মানেন না। এর মানে স্বতন্ত্র দেশ, স্বতন্ত্র শাসনতন্ত্র।

কবিতার ভাষা, ছন্দ ও কৌশলগত ব্যবহারে সাযুজ্য:

নজরুলের ভাষা যেমন বাংলা সাহিত্যে আরবি-ফারসি, হিন্দি-উর্দু আর সংস্কৃতের মিশ্রণে এক নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছে, তেমনি ফাররুখি ইয়াজদির ফারসি কবিতায় ব্যবহৃত ভাষা ছিল পরিশীলিত, কিন্তু প্রতিবাদী কণ্ঠে দৃপ্ত। নজরুল কাব্যের ভাষা নিয়ে নিরীক্ষা করেছেন। পক্ষান্তরে ফাররুখি তেমন নিরীক্ষা চালাননি।

“এই বেদনার নিশীথ-তমসা-তীরে

বিরহী চক্রবাক খুঁজে খুঁজে ফিরে

কোথায় প্রভাতের সূর্যোদয়ের সাথে

ডাকে সাথী আর মিলন মোহনাতে।”

চক্রবাক কবিতায় নজরুল বিরহ বেদনাকে কীভাবে মুড়িয়ে দিয়েছেন অন্ধকার থেকে আলোকোজ্জ্বল মুক্তির প্রথম প্রহর অরুণোদয় দিয়ে। রূপক ব্যবহারে নজরুলের প্রাতিষ্ঠানিকতা অনস্বীকার্য। তেমনি ফাররুখি ইয়াজজি চিত্রকল্প ও রূপক নির্মাণে রেখেছেন শৈল্পিক অবদান। যেমন:

“অন দাস্তে দোস্তি কে দারে আউয়াল নেগার দদ

ব দুশমানি বে খুন দেলে অখার নেগার দদ

দিদি কে বগেবান জাফাপিশে অকেবাত

বারবদে অশইয়ানে চান্দিন হেজার দদ”

অর্থাৎ

তোমার যে প্রেমের হাত, দিয়েছিলে প্রথমে

সেই হাত রক্ত ঝড়ালো, নদী থেকে নয় কমে

নিষ্ঠুর মালি, কীভাবে পারলে তুমি অমন কাজ

হাজার পাখির বাসা নষ্ট, দিয়েছো বিরান সাজ

নজরুল নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। আর ফাররুখি উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা নির্মাণে সচেতন ছিলেন।

কবিদের প্রভাব ও উত্তরাধিকার:

দুই কবিই তাঁদের নিজ নিজ সাহিত্যে বিপ্লবের কণ্ঠস্বর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। নজরুলকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তাঁর কবিতা আজও মানবিকতার প্রতীক।

ফাররুখি ইয়াজদির, যদিও তাঁর জীবনে কখনো সরকারি স্বীকৃতি পাননি, কিন্তু ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লব তাঁর কবিতাকে নতুন করে পাঠ করায়Ñ তাঁর কণ্ঠ হয়ে ওঠে প্রতিবাদের পূর্বাভাস।

কাজী নজরুল ইসলাম ও ফাররুখি ইয়াজদিÑ দুই কবির কাব্য ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতিতে জন্ম নিয়েছে, কিন্তু তাঁদের কাব্যচেতনায় রয়েছে অসাধারণ সাযুজ্য।

তাঁরা প্রেমের, আত্মার এবং রাজনীতির কবি। তাঁদের কবিতা শুধু শিল্প নয়এ এক জীবনদর্শন, এক বিপ্লবী মানবতাবোধের উচ্চারণ।

তাঁদের কবিতা আজও প্রাসঙ্গিক, যখন দুনিয়াজুড়ে চলমান নিপীড়ন, অসাম্য ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে আমরা নতুন প্রতিরোধ গড়তে চাই।