তাজ ইসলাম
‘কারার ঐ লৌহ-কপাট
ভেঙে ফেল্ কর রে লোপাট
রক্ত জমাট
শিকল-পূজোর পাষাণ-বেদী!
ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ
ধ্বংস-নিশান
উড়ুক প্রাচী’র প্রাচীর ভেদি।’
জুলাইয়ের দিনগুলোতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম’র কবিতা গান হয়ে যখন বেজে ওঠতো বুলন্দ আওয়াজে রক্ত তখন টগবগ করে নাচতো। গানের বাদ্যে দ্রিমদ্রিম শব্দে শরীরকে উদ্দীপ্ত করতো ড্রামের তালে তালে। কবিতা গান হয়ে, আন্দোলনে উজ্জীবিত হওয়ার মন্ত্র হয়ে হাজির হলো জুলাই বিপ্লবে।
জুলাই আমাদের চোখের সামনের ঘটনা। দূর অতীতের কোন ঘটনা না। গত বছরের জুলাই। ২০২৫ এর জুলাইয়ে মাত্র বছর পূর্তি হল।
কোটার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা ছাত্র সমাজের দ্রোহ। মুহূর্তে যা রূপ নিয়েছিল ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘ নামে। তারপর সব ইতিহাস। এক দফায় রফা হল। পলায়ন করল স্বৈরশাসক হাসিনা। টানা পনের বছর ক্ষমতায় ছিল শেখ হাসিনা। এই পনের বছরে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম খোদাই করে লিখে রাখলেন একজন স্বৈরাচার ও জঘন্য ফ্যাসিস্ট হিসেবে। তার পনের বছরের ইতিহাস হত্যা, গুম, আয়নাঘর, ভোট ডাকাতি, গণতন্ত্র হত্যাকারী নাগরিক অধিকার হরণকারীর ইতিহাস।
জুলাইয়ে কণ্ঠরোধ করতে ঘৃণ্যভাবে আখ্যায়িত করল নিরীহ ছাত্রদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে।
সময়টা ১৪ জুলাই ২০২৪ এর রাত। রাতে হাসিনার ট্যাগকে বা আওয়ামী ন্যারেটিভকে ভেঙেচুড়ে চুরমার করে দিয়ে পাল্টা স্লোগান তুলল ‘সঙ্গে থাকলে সঙ্গি, না থাকলেই জঙ্গি’।
ভয়াবহভাবে আওয়ামী ন্যারেটিভ মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য হল ছাত্রদের আকাশ বিদীর্ণ করা স্লোগান, ‘তুমি কে, আমি কে? রাজাকার, রাজাকার...! স্লোগানে।
পরের অংশে আছে কে বলেছে, কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।
কথায় কথায় বিরোধী দল, বিরোধী মতকে রাজাকার বলে কোণঠাসা করার অপরাজনীতি এক স্লোগানে বানের পানির সাথে খড়কুটো ভেসে যাওয়ার মতো ভেসে গেল। অবশেষে আওয়ামী লীগও থাকতে পারেনি। ভেসেই গেল জনস্রোতে লক্ষ্মণ সেন হয়ে।
জুলাইয়ে উদ্দীপক হিসেবে হাজির হয়েছিল কবিতা। এই কবিতা আন্দোলনে, মিছিলে ছিল স্লোগান হিসেবে। দেওয়ালে দেওয়ালে ছিল দেওয়াল লেখা হিসেবে।
গানে, আবৃত্তি নজরুল ইসলাম ছিলেন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে। নজরুলের গান যেন বিপ্লবের মন্ত্র, সময়ের অনিবার্য শব্দ বুলেট। ‘কারার ঐ লৌহকপাট ‘ সারাদেশে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে উচ্চারিত হয়েছে, উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে প্রাণে প্রাণে।
কাজী নজরুলের বিপ্লবী গান জুলাই বিপ্লবের মিছিলে মিছিলে উচ্চারিত হত।
‘এই শিকল পরা ছল’ সহ অন্য অনেক জনপ্রিয় গানই সেদিন আন্দোলনকারীদের পছন্দের তালিকায় ছিল। আবৃত্তিকারদের কণ্ঠেও উচ্চারণের প্রথম তালিকায় ছিল নজরুলের কবিতা। গান আবৃত্তি ছাড়া দেওয়ালে দেওয়ালে জ্বলজ্বল হরফে লেখা কাঁচা হাতের এসব লেখা গ্রাফিতি নামে বহুল পরিচিত।
‘বল বীর-/বল উন্নত মম শির।’
‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর।
তোরা সব জয়ধ্বনি কর।’
‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল-বোশেখীর ঝড়।’
‘নাচে ঐ কাল-বোশেখী,/ কাটাবি কাল বসে কি?/ দে রে দেখি/ ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি’
‘এই শিকল পরা ছল’
নজরুলের কবিতার এসব চরণ এখনো রাজধানীর দেওয়ালে দেওয়ালে শোভা পাচ্ছে।
জুলাইয়ের মহানায়ক শহীদ আবু সাঈদের প্রসারিত দুই হাতের ছবির লাল সূর্যের বুকে
‘চির উন্নত মম শীর’ কাব্যাংশ অন্যরকম আলো ছড়ায়।
শিল্প সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম কবিতা। কবিতা জুলাই বিপ্লবে অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে হাজির থেকেছে। গান, কবিতা, ছড়া, স্লোগান সব কবিতারই অংশ। জুলাই বিপ্লবে কবিতা বিপ্লবীদের মুখে মুখে ছিল অগ্নিঝরা উচ্চারণে।
মজার বিষয় হল এইসব স্লোগান সময়ের তাগিদে রাজপথেই সৃষ্টি, রাজপথেই প্রয়োগ। সারাদেশে উচ্চারিত হয় এমন স্লোগান হাজার হাজার। সব হয়তো আমাদের কারও পক্ষে এককভাবে বলা সম্ভব না। আমরা অগণিত স্লোগানের বহুল প্রচারিত ও অধিক শ্রুত কিছু স্লোগান উদ্ধৃত করছি আলোচ্য আলোচনায়।
‘কথায় কথায় বাংলা ছাড়
বাংলা কি তর বাপদাদার
এই দেশ আমার দেশ
বাংলাদেশ বাংলাদেশ’
এই স্লোগানটি কার সৃষ্টি আমরা জানি না। জানা প্রায় অসম্ভব। এটি হাসিনা বা ফ্যাসিস্টের মুখের উপর ছুঁড়ে মারা তীব্র বুলেট স্লোগান।
আন্দোলন দমন করার জন্য ফ্যাসিস্ট হাসিনা ছাত্রদের বুকে গুলি ছুঁড়ে। জুলাইয়ে শহীদ হয় দুই হাজারের অধিক তরতাজা প্রাণ। হাসিনার বিরুদ্ধে কতটা ক্ষোভ ও দ্রোহ জমা ছিল দেশবাসীর বুকে! সেই দ্রোহ প্রকাশ করতে কতটা অকুতোভয় ছিল বিপ্লবীরা তা খুব অল্পকথায় প্রকাশ পায় যখন উচ্চারিত হয়,
‘বুকের ভেতর তুমুল ঝড়
বুক পেতেছি গুলি কর।’
‘দিয়েছি তো রক্ত আরও দিব রক্ত/ রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়।
এই স্লোগান হাসিনার দমন পীড়নকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে তাদের দৃঢ় অবস্থান জানিয়ে দেয়।
মিছিল শুধু মিছিল নয়, মিছিলের স্লোগান শুধু গতানুগতিক শব্দ বন্ধনী নয়। স্লোগানেই প্রকাশ করে অনেক না বলা কথা। ছোট এই স্লোগানটি আগে আমরা আওড়িয়ে নিই
‘আমার ভাই কবরে
খুনি কেন বাইরে? ‘।
এমন আরেকটি স্লোগান-
‘কে এসেছে কে এসেছে?
পুলিশ এসেছে, পুলিশ এসেছে
কী করছে কী করছে
স্বৈরাচারের পা চাটছে’
কিংবা
সীমান্তে মানুষ মরে, বিজিবি এখানে কী করে?
এই যে অল্পকথায়, একেবারে খুব অল্পকথায় অনেককিছু বলে ফেলা এটাই কবিতার শক্তি। তা কবিতার যে ফর্মেই হাজির হোক। হোক তা ছড়া, হোক তা স্লোগান। মূলত সবই কবিতা জাত পঙক্তি।
‘দিল্লী না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা।’
‘দালালী না রাজপথ? রাজপথ রাজপথ।’
‘আপোষ না সংগ্রাম? সংগ্রাম।’
এই স্লোগানগুলো একটা দেশ, জাতি, দল ও আন্দোলনের লক্ষ ও দিক নির্ধারণ করে দেয়। গতি নির্দিষ্ট করে দেয়।
পনের বছরে স্বৈরাচার, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও তার ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সকল অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশের রাজনীতিতে দৈত্য ও দানবে রূপান্তরিত হয়েছিল।
জুলাইয়ের স্লোগান, গ্রাফিতি, দেওয়াল লিখন নিয়ে লেখতে গেলে কলেবর ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাবেই। তারপরও সব এক আলোচনায় নিয়ে আসা দুরূহ ব্যপার। খুব প্রচলিতগুলো তুলে আনতে গেলেও তা বিস্তৃত এক লেখায় রূপ নেবে। যা সহজ মনে হলেও জটিল কর্ম।
দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ নিজেদের মহাপরাক্রমশালী ভাবতে শুরু করে। ভাবতে থাকে অপরাজেয়। সেই আওয়ামী লীগ জুলাইয়ে শুরু হওয়া বিপ্লবে আগস্টের ৫ তারিখে পালিয়ে যায় বাংলার শত শত বছরের ঐতিহাসিক সমস্ত রেকর্ড ভঙ্গ করে। সংসদের ক্ষমতাসীন এমপি- মন্ত্রী, নেতানেত্রীসহ হাসিনা পালিয়ে যান। হাসিনা পালিয়ে আশ্রয় নেন তার ভরসারস্থল ভারতে। অন্যরা নানান দেশে। পালানোর সাথে সাথে বিপ্লবী স্লোগান, পলাইছেরে পলাইছে, শেখ হাসিনা পলাইছে’। ‘ছিঃ ছিঃ হাসিনা, লজ্জায় বাঁচি না ‘ উচ্চারিত হতে থাকে ঢাকাসহ সারাদেশের মিছিলে মিছিলে।
জুলাইয়ের হাজার হাজার স্বতঃস্ফূর্ত স্লোগান, দেওয়ালে লেখা কবিতা পঙক্তি আমাদের সংগ্রহ ও সংরক্ষিত করে রাখা অতীতের জন্য অতীব জরুরি। এখন এগুলো সংরক্ষণ না করলে এক সময় তা কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে। এগুলো সংরক্ষণ করতেই হবে। এগুলোই হবে সম্বৃদ্ধ ইতিহাসের অমূল্য অংশ।
পরিশেষ কথা:
এই স্লোগানগুলো এই সময়ে সৃষ্ট। মিছিল থেকেই তৈরি। আশা করা সঙ্গত যে আন্দোলন সংশ্লিষ্টদের দ্বারাই সৃষ্ট। এর রচয়িতাদের নাম হয়তো সংগ্রহ করা যেতেও পারে। এ বিষয়ে জুলাইয়ের অনেক সংগঠন আছে। তারা স্লোগানের স্রষ্টার নাম সংগ্রহ করতে পারলে বিষয়টি আরো সম্বৃদ্ধ হবে। না হলে এগুলো এক সময় লোকছড়ার পথ অনুসরণ করবে। তখন স্লোগান থাকবে, ছড়া থাকবে রচয়িতাগণ থেকে যাবে চিরকালের অজ্ঞাতে। যা কাম্য নয়।