বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাবেক প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের বিষয়ে স্মৃতিচারণ করে তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে বলেন,ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের নাম অনেক আগে থেকে শুনতাম। তবে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ২০০৯ সালে। তখন আমি বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে কাজ করি। গুলশানে ম্যাডাম জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে আসতেন রাজ্জাক সাহেব। তিনি তখন জামায়াতে ইসলামীর আলোচিত নেতা ও উচ্চ আদালতের তুখোড় আইনজীবী হিশেবে মশহুর। জামায়াত তখন বিএনপির নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোটের শরিক।
স্যুট-টাই পরা সুবেশধারী দীর্ঘদেহী ঋজু মানুষ ব্যারিস্টার রাজ্জাক খুব ধীর লয়ে স্পষ্ট উচ্চারণে থেমে থেমে গুছিয়ে কথা বলতেন। তাকে নিরহংকার নিপাট ভদ্রলোক বলে মনে হতো আমার। তার বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কণ্ঠস্বর এখনো কানে বাজে।
রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গে আমার খুব অল্পস্বল্প কথা হতো। কিন্তু কেন তিনি আমাকে পছন্দ ও বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন তা জানিনা। একদিন তিনি আমাকে তার নিজের ল চেম্বারে দাওয়াত দিলেন। বললেন, একটা বিষয়ে কথা বলতে চান আমার সঙ্গে। আমি গিয়েছিলাম। তিনি স্ন্যাক্স আইটেম দিয়ে অনাড়ম্বর দুপুরের খাবারের আয়োজন করেছিলেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে রাজ্জাক সাহেব বললেন, আপনার বুদ্ধিমত্তা ও সুবিবেচনাবোধকে আমি শ্রদ্ধা করি। তাই খুব গুরুতর একটা বিষয়ে আপনার পরামর্শ চাই।
ব্যারিস্টার রাজ্জাক সেদিন আমায় বলেছিলেন, বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলন, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে ধ্বংস করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটা আওয়ামী লীগ সরকারেও নয়, মূলতঃ ইন্ডিয়ান এজেন্ডা। আওয়ামী নেতৃত্ব ও সরকারের এর বাইরে যাবার উপায় নেই। এই এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য শিগগিরই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বৈরী ভূমিকার দায়ে জামায়াতের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের অভিযুক্ত করে প্রাণদণ্ড দেওয়া হবে। নাৎসী জার্মানীর কায়দায় জামায়াত নেতাদের 'জুডিশিয়াল কিলিং'-এর সব আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার ব্যাপারে জামায়াতের মূল্যায়নের সঙ্গে একমত নই। তবে কেউ অবিচার ও অন্যায়ের শিকার হোক, সেটাও সমর্থন করিনা। সেদিন আমার বুদ্ধিতে কুলায় এমন কিছু পরামর্শ রাজ্জাক সাহেবকে দিয়ে এসেছিলাম। তিনি মনযোগ দিয়ে শুনেছিলেন এবং বলেছিলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে জামায়াতের জন্য এগুলোই সবচে' ভালো করণীয় বলে তিনিও মনে করেন।
পরবর্তীকালে রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে আলাপ হলে তিনি ম্লান হেসে খুব বিষণ্ণ হয়ে বলতেন, "শেষরক্ষা হবে বলে মনে হচ্ছে না।" জামায়াত রাজ্জাক সাহেবের মতামতের সঙ্গে একমত হয়নি এবং তিনিও দলকে কনভিন্স করতে পারেন নি। রাজ্জাক সাহেব মনে করতেন, জামায়াত নেতারা পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে না পেরে এক অনিবার্য কুরবানির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
রাজ্জাক সাহেব এরপর কোনো লাভ হবেনা জেনেও দলের অভিযুক্ত নেতাদের পক্ষে আইনি লড়াই চালিয়ে যান এবং এক পর্যায়ে নিজেই বিপন্ন হয়ে পড়ে দেশত্যাগ করেন। জামায়াতের সংগে ভিন্নমত তাকে নতুন দল গঠনের দিকেও ঠেলে দেয়। কিন্তু ইতোমধ্যেই তিনি যেভাবে ভগ্নস্বাস্থ্য ও ভগ্নহৃদয় হয়ে পড়েছিলেন তাতে তার পক্ষে আর এ.বি পার্টির নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতনের পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। দেশের এই মুক্ত পরিবেশ যেন সৃষ্টিই হয়েছিল আব্দুর রাজ্জাকের মতো ভূমিপুত্রকে স্বদেশের মাটিতে মৃত্যুবরণের সুযোগ দেওয়ার জন্যই। তার পারলৌকিক মুক্তির জন্য আমি আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের দরবারে মুনাজাত করি।