বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার ‘প্রিয় ভাই ব্যারিষ্টার আব্দুর রাজ্জাক এর বিদায় ও কিছু স্মৃতি’ শিরোনামে তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে দেয়া স্ট্যাটাসে বলেন,

বাংলাদেশের আইন ও রাজনৈতিক অঙ্গনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ভাই তাঁর রবের সান্নিধ্যে চলে গিয়েছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন...।

০৪ মে বিকাল ৪.৩০টায় আমরা তাঁকে হারিয়ে গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছি। মহান আল্লাহ তা'য়ালার কাছে তাঁর সারা জীবনের নেক কাজ কবুল করে তাঁর গুনাহখাতা মাফ করার জন্য কায়মনোবাক্যে মোনাজাত করছি। তিনি তাঁর আচার-আচরণে মানুষের সাথে যে সহচার্য দিয়ে মানুষকে তাঁর ভালোবাসায় আকৃষ্ট করেছেন সেটা অসাধারণ। আমার সাংগঠনিক জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রিয় এবং তাঁর জীবনের শৃঙ্খলা, মেধা, শিক্ষা, অধ্যাবসায় ও দেশের জন্য, রাজনীতির জন্য একজন অসাধারণ সংগ্রামী মানুষ হিসেবে তাঁর জীবনে শেখার অনেক কিছুই ছিল, যা আমাকে সাংগঠনিক জীবনে যথেষ্ট অনুপ্রেরণা দিয়েছে।

তাঁর সঙ্গে প্রবাস জীবনেও আমার সফরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেফ তাইয়েব এরদোগানের সঙ্গে ১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে আমরা একই সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মসূচিতে তাঁর অসাধারণ চিন্তা, সুচিন্তিত পরামর্শ, সাহসী উদ্যোগ, সাংগঠনিক অনেক নীতি নির্ধারণ ও পলিসি গ্রহণে অনেক ক্ষেত্রে তিনি কোরআন-হাদিস থেকে যেমন আধুনিক শিক্ষিত আইনজীবী হিসেবে যুক্তি দিতেন তেমনি অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে তিনি তথ্য-উপাত্ত দিয়ে চমৎকার উপস্থাপনা করতেন। কেন্দ্রীয় বৈঠকে যা আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতো।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমীর শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী রাহিমাহুল্লাহ সহ আমাদের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের ওপরে মিথ্যা মামলার খড়গ চাপিয়ে জুডিশিয়াল কিলিং এর ষড়যন্ত্র ফ্যাসিস্ট হাসিনা যখন করেছিলো, সেটার বিরুদ্ধে তিনি অসাধারণ আইনি লড়াইয়ে আমাদের লিগ্যাল ডিফেন্স টিমের প্রধান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

এই মামলার কাজে আমার ওপর সংগঠনের অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাঁর প্রচন্ড ব্যস্ততা ও পরিশ্রম দেখে যখন জিজ্ঞেস করতাম, এতো কাজের চাপ আপনি কি করে সামলাচ্ছেন, আপনার কষ্ট হয় না? তখন তিনি আমাকে বলতেন, মহান আল্লাহর রহমতে আমি একদল তরুণ ব্যারিস্টার ও আইনজীবীদের পেয়েছি, যারা আমাকে সব সময় সাহায্য করেন। আমার কোনো কষ্ট হয় না।

আলহামদুলিল্লাহ, সেই মামলায় সংগঠনের দেয়া দায়িত্ব পালনে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে আমিও তাঁর সঙ্গে গভীরভাবে মেশার সুযোগ পেয়েছি। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম, সাধনা, অধ্যাবসায়, প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস, আদালতে তাঁর অসাধারণ যুক্তিপূর্ণ উপস্থাপনা, দেশের আইন অঙ্গনের বিচারপতি, সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা এবং যে ভালোবাসা তিনি দেখিয়েছেন সেগুলো সারা দেশবাসী দেখতে পেরেছে।

আমি কারাগারে থাকাকালীন, আমার গোটা কারাজীবনে তিনি আমার পরিবারের, আমার আব্বা-আম্মাসহ সকলের কুশলাদি, খোঁজ-খবর রাখতেন এবং কারাগারে আমার খবরও রাখতেন। আমার আব্বা যখন অসুস্থ হলেন, তিনি বিদেশ থেকে ফোন করে আমার আব্বার কুশলাদি, স্বাস্থ্যের অবস্থা জানতেন। আমার আব্বাও পোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন এবং ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ভাইও প্রথম দিকে পোস্টেট ক্যান্সার এবং পরে তিনি পেইনক্যারিয়েস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ফলে অনেক ব্যস্ততার মধ্যে প্রবাস জীবন থেকে তিনি যখন ফোন করতেন, আমার পরিবারের আব্বা-আম্মা ও আমার নিজের খবর নিতেন, আমরা খুব আপ্লুত হতাম। তিনি কত বড় মাপের একজন মানুষ ছিলেন, আমাদের মতো একজন ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের প্রতি তাঁর যে আগ্রহ-আন্তরিকতা, এগুলো ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকবে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর এ সদাচরণের জন্য নেক বরকত এবং এর সুফল আখিরাতে দান করুন।

তিনি দেশে ফিরে এসে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর আমাদের কারাবন্দী মজলুম এটিএম আজহারুল ইসলাম ভাইয়ের মামলায় লড়াই করার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং আদালতে তিনি একদিন শুনানিতে অংশগ্রহণও করেছিলেন। এটিই তাঁর জীবদ্দশায় উচ্চ আদালতে মামলার শেষ শুনানি। তারপর তিনি আরো অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।

তিনি আজ চির বিদায় নিয়ে আল্লাহ তা'য়ালার কাছে হাজির হয়ে গিয়েছেন। তাঁর কৃতি ও সুযোগ্য দুই পুত্র ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক ও ব্যারিস্টার এহসান সিদ্দিক বাংলাদেশের আইন অঙ্গনে আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ভাইয়ের এই দুই কৃতি সন্তান পিতার মতোই সদালাপী, মিষ্টভাষী এবং বিনয়ী। যা আদালতে বিচারক ও আইনজীবীদেরকে মুগ্ধ করে। আমি আশা করি আব্দুর রাজ্জাক ভাইয়ের সুযোগ্য সন্তান হিসেবে তারাও সম্মানিত হবে এবং পিতাকেও সম্মানিত করবে।

আমি আব্দুর রাজ্জাক ভাইয়ের এ বিদায়ে তাঁর সাথে সাংগঠনিক জীবনের স্মৃতিগুলো গভীরভাবে স্মরণ করছি। মহান আল্লাহ তা'য়ালা তাঁকে ক্ষমা করুন এবং তাঁর অবদান, তাঁর দক্ষতা-যোগ্যতা ও অধ্যবসায় থেকে আমাদের সকলকে শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফিক আল্লাহ তা'য়ালা দান করুন।

আব্দুর রাজ্জাক ভাই ছাত্র জীবন থেকেই ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং তরুণ বয়সে ইসলামী আন্দোলনের জন্য লন্ডন থেকে তিনি দেশে ফিরে এসে ইসলামী আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন। অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। ইসলামী আন্দোলনে মেধাবী, বুদ্ধিমান, দক্ষ এবং উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের জন্য তিনি একটি উদাহরণ। আন্দোলনের জন্য নিজেকে কিভাবে বিলিয়ে দিতে হয় সেই উদাহরণ তিনি রেখে গিয়েছেন।

পরিশেষে আমরা তাঁর মাগফেরাত কামনা করছি এবং আল্লাহ তা'য়ালার কাছে তাঁর জন্য জান্নাতুল ফিরদাউসে উচ্চ মাকাম কামনা করছি। তাঁর শোকাহত স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, আত্নীয়-স্বজন ও সহকর্মীদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছি। রাব্বুল আলামীন যেন আমাদের সবাইকে উত্তম ধৈর্য ধারনের তাওফিক দান করেন। আমীন।।