মাসুদ সাঈদী : আজ ১৪ আগষ্ট ২০২৫। এক এক করে ৭৩০টি দিন পার হয়ে গেল আব্বাকে হারানোর। আমার পরম শ্রদ্ধেয় আব্বাকে আমি চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি। এখনো মনে হয় এক ধরনের ঘোরের মধ্যে আছি। আব্বার বিদায়ের শেষ সময়গুলো শুধু স্বপ্নের মত মনে হয়। মনে হয় একটা দুঃস্বপ্ন দেখে মাত্রই জেগে উঠলাম।

মাঝে মাঝে চিৎকার করে ডুঁকরে কেঁদে উঠি। বুকভরা যন্ত্রণাগুলো অশ্রু হয়ে অনবরত ঝরতে থাকে চোখের কোণ বেয়ে। বুকে জমে থাকা ব্যথাটা একটু হালকা হয়। কিছু সময় পর আবারও বুকটা ভারী হয়ে যায়, মনে হয় যেন বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাবে আমার। আব্বার হাজারো, লাখো স্মৃতি প্রতিনিয়তই এসে ভিড় জমায় আমার মনের কোণে। আর আমি প্রতিদিনই অস্থির হয়ে আব্বাকে খুঁজতে থাকি। কিন্তু না! আব্বা নেই, কোথাও নেই। কোথায় চলে গেলে তুমি আমাকে ফেলে?

মনে হয় আব্বাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারতাম! তার বুকে মাথা রেখে বাবা বাবা বলে চিৎকার করে মনের যত ব্যাথা আছে একটু দূর করতে পারতাম! কিন্তু সে সুযোগ যে আমাদের আর নেই। আমরা যে আব্বার স্নেহ, ভালোবাসা থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়ে গেলাম। আব্বা যে আমাদেরকে ইয়াতিম করে রেখে তার প্রিয় মুনিবের ডাকে সাড়া দিয়ে পরকালীন জীবনের বাসিন্দা হয়ে গেছেন! জায়নামাজে, সেজদায় শুধু আব্বা আব্বা বলে চিৎকার করে পরম করুনাময় আমার মহান রবের কাছে এই দোয়াই করছি,- "রব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সগিরা।"

১৩ আগষ্ট ২০২৩, রবিবার। আমি তখন জরুরী কিছু কাজে রামপুরার একটি অফিসে অবস্থান করছিলাম। কাজের এক ফাঁকে আসরের নামাজের আজান হয়ে গেল। ঐ অফিসেই নামাজের সুন্দর ব্যবস্থা ছিল। নির্ধারিত সময়েই আমরা নামাজে দাঁড়ালাম। নামাজের শেষ রাকাতে শেষ বৈঠকে বসা আমি। এমন সময় আমার মোবাইল ফোনে রিং বেজে উঠল। সালাম ফিরিয়ে কিছু দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে কলটা শেষ হয়ে গেল। একটু পরেই কলটা আবার এলো। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একজন সালাম দিয়ে বললো, 'ভাই! স্যারকে (আল্লামা সাঈদী) একটা এম্বুলেন্সে করে জরুরীভাবে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।' তাঁর কি হয়েছে, কেন হাসপাতাল নেয়া হচ্ছে, কখন নিয়ে গেছেÑ তিনি এ ব্যাপারে কিছুই জানাতে পারলেন না আমাকে। মোবাইল কল দাতা কাশিমপুর কারাগারের একজন রক্ষী। তার কথা শুনে আমার হাত পা অবশ হয়ে এলো। কপাল ভিজে গেল ঘামে। ভীষণ রকম অস্থিরতা অনুভব করতে লাগলাম। কল দাতার কল কেটে মনে মনে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে কারা কর্তৃপক্ষের (সুপার ও জেলার) সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা শুরু করলাম। তাদের কেউই আমার ফোন রিসিভ করলেন না। ঐ সময়ে আমার অস্থিরতা আর ব্যকুলতা কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিল তা ব্যাখ্যা করার ভাষা এই মুহুর্তে আমার জানা নেই। কাঁপা হাতে আবারো ফোন করলাম। নাহ! ফোন তারা ধরলেনই না।

আমার মেঝো ভাই (শামীম সাঈদী) তখন দেশের বাহিরে। ছোট ভাই নাসিম সাঈদীকে বিষয়টি জানিয়ে রামপুরা থেকে বের হয়ে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে দৌঁড়াতে শুরু করলাম। আর অস্থির হয়ে ফোনে কারা কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন জায়গায় অনুমান নির্ভর কল দিতে লাগলাম শুধু এইটুকু তথ্য জানার জন্য যে, আব্বাকে তারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? কেন নিয়ে যাচ্ছে? কিন্তু কোনভাবেই তা জানতে পারলাম না। এমনকি কারা কর্তৃপক্ষও নিজ থেকে আমাকে বিষয়টি জানানোর কোন প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো না।

আমি ভাবতে লাগলাম তারা আব্বাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে! আমি অনুমান করলাম- যেহেতু আব্বা হার্টের পেশেন্ট তাই তারা মোহাম্মদপুরের হৃদরোগ ইন্সটিটিউট, মিরপুরের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন এবং শাহবাগের পিজি হাসপাতাল- এই ৩টি হাসপাতালের যে কোন একটিতে নিয়ে যেতে পারে। আমি সংগঠনকে পুরো বিষয়টি অবহিত করলাম। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন এবং পিজি হাসপাতালে আমাদের স্বজন ও সাংগঠনিক নেতৃবৃন্দ চলে গেলেন আর আমি রওয়ানা করলাম মোহাম্মাদপুরের হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ৮:১০ মিনিট। তখনো কোন কনফার্ম নিউজ আমার কাছে নেই যে- আব্বাকে তারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে!

আমি রামপুরা থেকে হাতিরঝিল হয়ে খুব অল্প সময়েই পৌঁছে গেলাম হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে। ওখানে পৌঁছে দেখলাম কারা কর্তৃপক্ষ আব্বাকে নিয়ে তখনো সেখানে পৌঁছায়নি। আমি অপেক্ষায় রইলাম। বারবার ঘড়ি দেখছি। অপেক্ষার প্রহর যেন আর শেষই হচ্ছেনা। প্রতিটি মিনিট আমার কাছে ঘন্টার মতো মনে হচ্ছে। আমার দুঃশ্চিন্তা শুধু বাড়ছেই। আমি ভেবেই পাচ্ছিনা- আসরের সময় আব্বাকে নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ কাশিমপুর থেকে রওয়ানা করলে কাশিমপুর থেকে মোহাম্মদপুর আসতে এত সময় লাগছে কেন? হিসেব বলছে- আসরের পর রওয়ানা করলে সাড়ে ৬ থেকে ৭টার মধ্যে আব্বাকে বহনকারী গাড়ি ঢাকায় পৌঁছে যাওয়ার কথা। খুব বেশি সাড়ে ৭টা হতে পারে কিংবা ৮টা হতে পারে (যদিও তা কখনোই হওয়ার কথা নয়)! অথচ আমার ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে নয়টার মতো বাজে! রাত ১০.০০ টারও কিছু সময় পর আমি নিশ্চিত হলাম আব্বাকে মোহাম্মাদপুরের হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে নয় বরং শাহবাগের পিজি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। খবরটি কনফার্ম হওয়ার পরপরই খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে মোহাম্মদপুর থেকে আমি হাজির হয়ে গেলাম পিজিতে। এরই মধ্যে আমার ছোট ভাই নাসীম সাঈদীসহ নিকট আতœীয় স্বজন ও সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এসে হাজির হলেন পিজি হাসপাতালে।

ততক্ষণে ঢাকার চারিদিকে খবর ছড়িয়ে পড়েছে আল্লামা সাঈদী অসুস্থ এবং তাকে পিজিতে নিয়ে আসা হচ্ছে। আব্বাকে নিয়ে আসার খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই মানুষের ভিড় জমতে থাকে পিজি হাসপাতালের সামনে। সংগঠন, মিডিয়াকর্মী, ভক্ত অনুরাগী ছাড়াও পিজির আশেপাশের এলাকার ব্যাপক মানুষ এসে জড়ো হতে থাকে হাসপাতালের সামনে। আব্বার অপেক্ষায় সবার দৃষ্টি পিজির মূল গেটের দিকে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুরোধ, প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মানুষের ভীড় বাড়তেই থাকে। হাজারো মানুষ অপেক্ষা করতে থাকে আব্বাকে এক নজর দেখার জন্য। অবশেষে রাত ১১:০০ টার দিকে এম্বুলেন্সের আওয়াজ ভেসে আসল পিজির মূল গেটের দিক থেকে। সাথে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিশাল বহর। আব্বাকে বহন করা এম্বুলেন্স ঢুকল পিজির গেট দিয়ে। সবার চোখ সেই এম্বুলেন্সের দিকে। এম্বুলেন্সের গ্লাসের ভেতর থেকেও যদি একবার তাদের প্রিয় আল্লামাকে দেখা যায়- এই আশায়। সবার উদ্বেগ উৎকন্ঠা! কেমন আছেন আমাদের আল্লামা? এম্বুলেন্স সোজা পিজি হাসপাতালের ডি ব্লকের ইমার্জেন্সির সামনে গিয়ে থামল। সবাই দৌড়ে সেখানে হাজির হওয়ার চেষ্টা করলেন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আটকে দিলেন সবাইকে। এক পলক দেখার জন্য দূর থেকে সবার দৃষ্টি এম্বুলেন্সের দরজার দিকে। সবার আশা তিনি বের হবেন, আল্লামাকে এক নজর দেখে সবাই চোখ জুড়াবেন, পিপাসার্তরা হৃদয়ের হাহাকার মিটাবেন। তার চেয়েও বেশী উৎকন্ঠার বিষয় জনতার হৃদয়ে- কি অবস্থায় দেখবেন তারা তাদের প্রিয় আল্লামাকে!

গাড়ির দরজা খুলল। দু'জন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের কাঁধে ভর করে আব্বা নামলেন। জনতার আল্লামা! মেহেদি মাখানো লাল দাড়িতে আব্বার চেহারাটা খুব মায়াবী লাগছিল। দু'জনের কাঁধে ভর করে নেমেই স্বভাবসূলভ ভঙ্গিতে কাউকে আগে সালাম দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে তিনি হাত নেড়ে সবার উদ্দেশ্যে বললেন- ‘আসসালামু আলাইকুম।' মুহুর্তের মধ্যে একটা শোরগোল পড়ে গেল। গভীর রজনীতে হাসপাতাল কাঁপিয়ে জনতা সমস্বরে উত্তর দিল 'ওয়ালাইকুম আসসালাম।' মনে হল যেন সালামের উত্তরের এই আওয়াজ আকাশ বাতাস ভেদ করে সাত আসমান পার হয়ে রব্বে কারীমের আরশে আজীম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। আব্বার মুখে তখন সেই ভুবন কাড়া হাসি। আব্বার হাসিমাখা অথচ ভীষন কষ্টের ছাপ চেহারায় দেখে উপস্থিত জনতা আর নিজেদেরকে আর সংবরণ করতে পারলেন না। ডুকরে কেঁদে উঠলো সবাই। সবার চোখ ভিজে গেল। ঐ অবস্থার মধ্যেও কয়েক শব্দের কুশলও বিনিময় করলেন আব্বা সবার সাথে। তখনও বুঝাই গেলনা আওয়ামী সরকারের ভাষায় তার 'ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাক' হয়েছে!

১৩ বছর কারাগারে থাকা অবস্থায় বহুবার আব্বাকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। কোনোবার এমন হয়নি যে, আব্বাকে হাসপাতালে আনা হয়েছে অথচ আমি উপস্থিত নেই। আব্বাকে হাসপাতালে আনলে বরাবর আমি যেটা করতাম তা হলো- আব্বাকে বহনকারী গাড়ি হাসপাতালের গেটে পৌঁছালে আমি গাড়ির দরজার কাছে এগিয়ে যেতাম। আব্বার হাত ধরে তাকে গাড়ি থেকে নামাতাম। এরপর পাশাপাশি হেঁটে আব্বার শারিরীক অবস্থা জানতে জানতে ডাক্তারের চেম্বারের দিকে যেতাম, একই সাথে আব্বার শরীরে কোন সমস্যা আছে কি না? থাকলে কি সমস্যা? কি কষ্ট হচ্ছে?Ñ এসব প্রশ্ন করে করে আব্বার কাছ থেকে তার পূর্ণ শারিরীক অবস্থার বিবরণ জেনে নিতাম। কিন্তু এই শেষবার ছিল সম্পূর্ণ ব্যাতিক্রম। আব্বাকে হাসপাতালে নিয়ে আসার আগেই গোটা হাসপাতাল জুড়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি দেখে আমি ভীষন অবাক হয়েছিলাম। আর আব্বার গাড়ি যখন হাসপাতালে এসে পৌঁছালো তখন পুরো গাড়িটাকেই আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ঘিরে ফেললো। তবুও ঐ অবস্থার মধ্যেই আমি আব্বার দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাকে এক প্রকার ধাক্কা দিয়েই আব্বার কাছ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। ওদের আচরণে আব্বা ভীষন কষ্ট পেলেন। ধমকের সুরে প্রতিবাদ করলেন। আমাকে কাছে আসতে দিতে বললেন। কিন্তু কোন কথাই তারা শুনলো না। আমি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের মধ্যে ভীষন তাড়াহুড়া লক্ষ্য করলাম। ওদের রুক্ষ আচরণে আমি হতবাক হলাম। তবু ভাবলাম, যাক! হাসপাতালে যখন আব্বাকে এনেছে- আজকের রাতটা যাক। আগামীকাল ইনশাআল্লাহ আব্বার সাথে দেখা করবো, কথা বলবো, আর আব্বার শারিরীক অবস্থার বিস্তারিত জেনে নিব। আব্বাকে হঠাৎ করে কেন হাসপাতালে নিয়ে এলো তাও জেনে নিব। কিন্তু কে জানতো, আব্বার শারিরীক অবস্থার খোঁজ নেওয়া বা আব্বার সাথে দেখা করার 'আগামীকাল'Ñ আমার জীবনে আর কোনোদিন আসবে না।

এম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে হুইল চেয়ারে বসিয়ে দ্রুত আব্বাকে নিয়ে যাওয়া হল ইমার্জেন্সিতে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু লোক ছাড়া আর কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হলো না। তারা ভিতরে ঢুকেই ডি- ব্লকের মূল গেট বন্ধ করে দিল। আমি পাগলের মত পেছন পেছন ছুটেছিলাম ইমার্জেন্সির দিকে, কিন্তু ঢুকতে পারলাম না। ইমার্জেন্সির চেকআপ প্রক্রিয়ায় সবমিলিয়ে সময় লেগেছে ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের মত। এর ফাঁকে আব্বার সাথে কোনরকম আলাপ কিংবা খোঁজ খবর নেয়ার কোন সুযোগই তারা আমাকে দিলনা!

ইমার্জেন্সি রুমে নেওয়ার কিছুক্ষন পর সেখানে পিজি হাসপাতালের কার্ডিওলজী বিভাগের প্রধান ডা. চৌধুরী মেশকাত আহমেদ এলেন। তার সাথে এলেন পিজি হাসপাতালের ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এসএম মোস্তফা জামান (এরা কেউই আমাদের পূর্ব পরিচিত নয়। এ দু'জনেরই পরিচয় আমি পরে জানতে পেরেছি)সহ আরো অনেকে চিকিৎসক। তারা ইমার্জেন্সি রুমের বন্ধ দরজার ভিতরে কি আলোচনা করলেন আর কি সিদ্ধান্ত নিলেন তা আমি বা আমরা জানতেই পারলাম না। তাদের তো উচিত ছিল- এই আলোচনা করার সময় রুগীর সন্তান হিসেবে আমাকে সাথে নিয়ে আলোচনা করার, আমাকে বিস্তারিত জানিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। কিন্তু তারা তা করেনি। শুধু তাই নয়, আব্বার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে আমাকে কোনো কিছু না জানিয়েই ইমার্জেন্সী রুম থেকে তারা বেরিয়ে যান। বাইরে দেশের প্রায় সকল ইলেক্ট্রনিক, প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়ার সাংবাদিকগন আব্বার শারীরিক অবস্থা জানার জন্য অপেক্ষমান ছিলেন। তারা রুম থেকে বের হতেই সাংবাদিকগণ ঐ দু'জন চিকিৎসককে ঘিরে ধরলেন। ডা. চৌধুরী মেশকাত আহমেদ সাংবাদিকদের সাথে কথা না নলে চলে গেলেন আর ডা. এসএম মোস্তফা জামান সাংবাদিকদের ব্রীফ করা শুরু করলেন। তখন আমি জানতে পারলাম এরা চিকিৎসক এবং এদের দু'জনকে আব্বার চিকিৎসার জন্য এপয়েন্ট করা হয়েছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের ডা. এস এম মোস্তফা জামান বললেন, 'দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী আমার অধীনে কার্ডিয়াক ইমার্জেন্সিতে ভর্তি রয়েছেন। কিছুক্ষণ আগে আমি খবর পেয়ে এখানে এসেছি। বর্তমানে তার শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। প্রাথমিক ইসিজিতে উনার হার্ট অ্যাটাক পাওয়া গেছে। এর আগেও উনার হার্টে রিং পরানো হয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছিল তার প্রাইমারি পিসিআই লাগবে। অর্থাৎ সাথে সাথে রোগীকে এনজিওগ্রাম করে রিং বসানোর প্রয়োজন হতে পারে। তবে আপাতত লাগবে না বলে মনে হচ্ছে না। তবে তার শারীরিক অবস্থার বিষয়ে এখনও সুস্পষ্ট মন্তব্য করা যাচ্ছে। তাকে আমরা কনজারবেটিভ ম্যানেজমেন্টে রাখছি।'

সাংবাদিকদের সাথে ব্রিফিং শেষ হলে ডা. এস এম মোস্তফা জামানের সামনে গিয়ে আমি দাঁড়ালাম। তাকে আমি আমার পরিচয় দিলাম। সোজাসাপ্টা জানতে চাইলাম, 'আপনি বলছেন আমার আব্বার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। যদি তাই হয় তাহলে আপনারা এখনো তার এনজিওগ্রাম করছেন না কেন? কেন সময় নষ্ট করছেন? ডা. এস এম মোস্তফা জামান জবাবে বললেন, 'ঠিক এই মূহুর্তে আপনার আব্বার বুকে ব্যথা নেই, তাই এনজিওগ্রাম না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।'

তখন না বুঝলেও এখন বেশ বুঝতে পারছিÑ তাদের রিপোর্ট (!) অনুযায়ী আব্বার হার্ট অ্যাটাক হলেও ডাক্তাররা আব্বার প্রাইমারি পিসিআই (চৎরসধৎু চবৎপঁঃধহবড়ঁং ঈড়ৎড়হধৎু ওহঃবৎাবহঃরড়হ- চঈও) অর্থ্যাৎ সাথে সাথে এনজিওগ্রাম কেন করলো না? কেন তার মতো বিশ্ববিখ্যাত একজনের মানুষের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করলো না? কেন হাসপাতালে এতো কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল? কেন একটিবারের জন্যও আমাকে আব্বার সাথে দেখা জরডে দেওয়া হয়নি? কেন আব্বার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে আমাকে একটুও জানতে দেওয়া হয়নি?Ñ তা এখন বেশ বুঝতে পারছি।

পিজির চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নিলেন প্রাথমিক চেকআপের পর আব্বাকে সিসিইউতে স্থানান্তর করবে। আমরা রুমের সামনে অপেক্ষমান। হঠাৎ রুমের দরজা খুলে গেল। আব্বা হুইল চেয়ারে ঠিক দরজার দিকে মুখ করেই বসা ছিলেন। সামনেই আমরা কয়েকজন দাঁড়ানো। দরজা খোলার সাথে সাথে আব্বা আমাকে দেখে এক অমায়িক হাসি দিলেন। আমাকে দেখে আব্বা কতটা তৃপ্ত হলেন তা আমি তার মিষ্টি হাসি দেখেই অনুমান করতে পেরেছিলাম। আব্বা ভরসা পেলেন তার সন্তান তার কাছেই আছে, তার পাশেই আছে! আমি হুইল চেয়ারে বসা আব্বার ডান হাতটা শক্ত করে ধরলাম। আব্বা আমার থেকেও বেশি শক্ত করে আমার হাতটা ধরলেন। আমার দু'চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো। আহ! এই তো আমার মহান পিতা। আমার ভালবাসা। আমি আমার সমস্ত আবেগ, ভালবাসা আর শ্রদ্ধা দিয়ে আব্বার হাতটা ধরে রাখলাম। কে জানতো- আব্বার এই হাত ধরাটাই আমার শেষবারের মতো ধরা!

আব্বাকে ইমারজেন্সি থেকে বের করে দোতলায় সিসিইউর দিকে নিয়ে যাওয়া শুরু করলো। হুইল চেয়ারে বসা আব্বার হাত ধরে আমি আব্বার সাথেই লিফটে উঠতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমাকে লিফটে ঢুকতেই দিলনা! আব্বার পবিত্র হাতটা আমি ছেড়ে দিলাম। লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

আমি দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেলাম। লিফটের বরাবর সামনেই সিসিইউ। লিফট থেকে নামিয়ে আব্বাকে সিসিইউর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আব্বা অপলক আমার দিকে চেয়ে আছেন। আমি দৌঁড়ে গিয়ে আব্বার হাতে লম্বা করে একটা চুমু দিলাম। আব্বা গভীর মমতায় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমাকে এক প্রকার ঠেলেই সরিয়ে দেওয়া হল আব্বার কাছ থেকে। আব্বার কাছে আর যেতে দিচ্ছেনা আমাকে! আমি দূর থেকে ‘আব্বা আব্বা ’বলে চিৎকার করে শুধু আব্বার চোখে চোখে থাকার চেষ্টা করছি। সিসিইউতে আব্বাকে ঢুকিয়ে ফেলা হচ্ছে। আব্বা ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। দূর থেকে চিৎকার দিয়ে আমি বললাম, ‘আব্বা আমরা সবাই আছি এখানে। আমরা আছি আব্বা। আপনাকে মহান আল্লাহর হাতে সোপর্দ করলাম।’ আব্বা পেছন দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তখনো অপলক তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। সেই তাকানোটাই যে আব্বার বিদায়ী চাহনি ছিল, আব্বার অসীম দৃঢ়তা আর হাসিমুখ দেখে আমি সেটা অনুমানই করতে পারিনি।

আব্বাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে লিফট, ইমার্জেন্সি এবং সিসিইউ এই তিন জায়গায় নেয়ার পথে যতদুর সুযোগ পেয়েছি গভীরভাবে আব্বাকে পর্যবেক্ষন করার চেষ্টা করেছি, আব্বার সত্যিকারের শারিরীক অবস্থা বুঝার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ঐ তিন জায়গায় আব্বাকে দেখার সময়গুলো ছিল চোখের পলক ফেলার মতো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আব্বাকে ওরা আমার চোখের দৃষ্টি সীমার বাইরে নিয়ে গেছে, তাই সঠিক করে আব্বার শারিরীক অবস্থা বুঝার মতো কোনো সময়-ই আসলে আমি পাইনি।

সিসিইউতে প্রবেশের আগে আমার দিকে আব্বা হাসিমুখে তাকিয়েছিলেন। খুব ইচ্ছা করছিলো আব্বাকে একটু জড়িয়ে ধরি, আব্বার পবিত্র হাতে একটু চুমু খাই। কিন্তু আব্বার কাছাকাছিও ওরা আমাকে যেতে দিল না। সন্তান হয়েও বাবার প্রতি আমার কোন অধিকারই যেন ছিলনা সেদিন। ছিলনা একটু স্পর্শ করার কোনো অধিকার কিংবা একটু কুশলাদি জিজ্ঞেস করার!

আব্বাকে সিসিইউর ভেতরে নেয়া হল। দরজা মিলিয়ে যাচ্ছে। আব্বা তখনো হাসিমুখে ঘাড় বাঁকিয়ে আমাদের দিকেই দৃষ্টি নিবন্ধ করে রেখেছিলেন। আমরা একদমই বুঝতে পারিনি যে আব্বা তার সন্তান, স্বজনদের শেষবারের মত মন ভরে দেখে নিচ্ছেন। আহ্!

সিসিইউ রুমের দরজা মিলে গেল। আব্বা আমাদের চোখের অন্তরালে চলে গেলেন। আব্বা দুনিয়ার অন্তরালে যাওয়ার আগ মুহুর্তে এভাবেই আমাদের চোখেরও অন্তরালে চলে গেলেন। এই যে যাওয়া- এটাই যে শেষ যাওয়া, এটাই যে শেষ দেখা, এটা কেন আমি সেদিন একটুও বুঝতে পারলামনা? আব্বাকে দেখে সেদিন এমন কিছু কেন আমি অনুমান করতে পারলামনা? আব্বা তার প্রিয় মুনিবের ডাকে সাড়া দেবেন, আব্বা তার এই মায়ার বাঁধনকে চিরতরে ছিন্ন করে তার রবের সাক্ষাতে যাত্রা শুরু করবেন, এটা যদি সেদিন ঘুর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারতাম, তাহলে নিজের হায়াতের বিনিময়ে পরম দয়ালু আমার মহান মালিকে কাছে আব্বার হায়াত ভিক্ষা চাইতাম!

আব্বা.....! সেই যে আপনার শেষ চাহনি, ঘাড় বাঁকিয়ে শেষ তাকানো, জ্বল জ্বল করা মায়াবী চেহারা, আমাকে যে এক সেকেন্ডের জন্যও স্থির থাকতে দেয় না। আপনি কেন তাকিয়ে ছিলেন এভাবে আমার দিকে? আমি যে এখন এক যন্ত্রনাকাতর চাতক পাখি হয়ে আছি আব্বা। আমার অস্থির বেদনাবিধুর মন-মস্তিস্ককে কোনকিছু দিয়েই বুঝিয়ে রাখতে পারিনা আব্বা....।

আব্বা.... আব্বা....। আহ্ ..... আব্বা!

সিসিইউতে নিয়ে তারা আব্বাকে আমাদের চোখের অন্তরাল করে ফেলল। এরপর থেকে শুরু হল আব্বাকে এক নজর দেখা ও তার সর্বশেষ শারীরিক অবস্থার খোঁজ নেওয়ার জন্য আমার দৌড়ঝাঁপ। আব্বা সিসিইউতে কেমন আছেন? কেমন কাটাচ্ছেন? চিকিৎসা কেমন চলছে? কি কষ্ট নিয়ে আব্বা এখানে এলেন? আসলেই কি বুকে কোন ব্যাথা ছিলো কি না? শারীরিক অবস্থা কেমন যাচ্ছে আব্বার?Ñ তা জানার এবং কাছে থেকে একটিবার আব্বাকে স্বচক্ষে দেখার জন্য কত অনুরোধ, কত আবদার, কত অনুনয় যে করেছি তাদের কাছে- সে কেবল আমার আল্লাহ স্বয়ং স্বাক্ষী। হাসপাতালের সামনে সিঁড়িতে, ফ্লোরে রাত দিন এক পায়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি- কখন আব্বাকে এক নজর দেখার ডাক পাব। চিকিৎসাধীন বাবাকে মৃত্যুর আগে একটিবারের জন্যও তার সন্তানদের দেখার সুযোগ দেওয়া হয়না- পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম দ্বিতীয় কোন ঘটনা আছে কিনা আমার জানা নেই। নিশ্চয়ই ইতিহাসের কালো পাতায় আওয়ামী জালিমদের আর খুনি হাসিনার এই বর্বরতা জঘণ্য ইতিহাস হিসেবেই লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে যতবারই অনুরোধ করেছি ততবারই তারা এই কর্তৃপক্ষ সেই কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে বলে বারবারই আমাকে পাশ কাটিয়ে গেছে। 'তারা আব্বার সাথে আমার দেখা করিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন'- বলে এক মিথ্যা আশ্বাসে ভুলিয়ে রেখেছিলেন আমাকে। আমি চাতক পাখির মত কখনো ফ্লোরে, কখনো সিঁড়িতে বসে অপেক্ষা করেছি কখন ডাক আসবে, কখন আব্বাকে এক নজর দেখে আমার হৃদয়ের হাহাকার মিটাবো! কিন্তু সারারাত চেষ্টা করেও আব্বার সাথে সাক্ষাৎ তো বহু দূরের কথাÑ আব্বার শারীরিক অবস্থারও সঠিক কোনো খবর সংগ্রহ করতে পারলাম না আমি।

১৪ আগষ্ট ২০২৩, সোমবার। আগের দিন সারারাত নির্ঘুম কাটানোর পর ভোর হতেই আমি সিসিইউতে আবার ঢোকার চেষ্টা করলাম। দোতলায় সিসিইউর সামনে গিয়ে দেখি পঞ্চাশের অধিক পুলিশ সেখানে অবস্থান নিয়েছে। শুধু তাই নয়, সিসিইউর প্রবেশ মুখে পুলিশ চেকপোষ্ট বসিয়েছি। আমি অবাক হয়ে গেলাম! এত কঠিন নিরাপত্তা বেষ্টনী কেন?Ñ এমন আগে তো কখনো হয়নি! এখন কি এমন হলো যে এত কঠোর অবস্থানে পুলিশ!!

আব্বার খোঁজ নেওয়ার বা আব্বার সাথে দেখা করার চেষ্টা বারবার করেও ব্যার্থ হলাম। কি করবো? আমার কি করা উচিত?Ñ ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। হঠাৎ মনে পড়লো ডা. চৌধুরী মেশকাত আহমেদের কথা। গত রাতেই শুনেছিলাম তিনি পিজি হাসপাতালের কার্ডিওলজী বিভাগের প্রধান এবং আব্বা তার অধীনেই ভর্তি আছেন। মনে হলো তার কাছে যাইÑ তিনি তো আব্বার খবর আমাকে জানাতে পারবেন, দেখা করার ব্যবস্থাও করতে পারবেন। দৌড়ে গেলাম মেশকাত সাহেবের রুমে। কিন্তু তাকে পেলাম না, তিনি তখনো অফিসে আসেন নি। কি আর করা! হাসপাতালের ডি ব্লকের নীচে একটি সিঁড়ি আছে। আমি সেই সিঁড়িতে গিয়ে বসে পড়লাম যাতে করে ডা. মেশকাতকে যখনই রুমে ঢুকবেন আমি যেন তাকে মিস না করি। সম্ভবত সকাল ১১টার দিকে ডা. মেশকাত তার অফিসে এলেন। তিনি অফিসে ঢোকার কিছু পরেই আমি তার রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখানে গিয়ে হতবাক হয়ে গেলাম আমি! তার রুমের সামনেও অনেক পুলিশ। আমি ভেবে পেলাম না এই সাজ সাজ রব কিসের জন্য। রুমে ঢুকতে গিয়েই পুলিশী বাধার মুখে পড়লাম। কোথায় যাবো, কার কাছে যাবো? কেন যাবো?Ñ এমন হাজারো প্রশ্ন তাদের! আমি আমার পরিচয় দিলাম, কার কাছে যাবো তাও জানালাম। তারা শুনে বললো অপেক্ষা করুন, সাক্ষাতের অনুমতি আনতে হবে- এই বলে একজন পুলিশ সদস্য রুমের ভিতরে চলে গেল। আমি একা বাইরে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম- একজন অসুস্থ মানুষের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নেওয়ার জন্য ডাক্তারের অফিসে ঢুকতেও পুলিশের অনুমতি লাগবে? ডা. মেশকাত তো সরকারের মন্ত্রী না এমপি না, কোনো সচিব না কিংবা ভিআইপি প্রোটোকল পাওয়ার মতো কোনো ব্যাক্তিও না! তাহলে? এই লোককে এত পাহারায় রাখার কারন কি? কোথায় যেন একটা রহস্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু ভেবে পাচ্ছিলাম না রহস্যটা কি! অনেক সময় পর একজন রুম থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। আমি রুমে ঢুকে দেখি সেখানেও পুলিশে ভরা। ডা. মেশকাতের সাথে দু'জন লোককে বসা দেখলাম। আমাকে বসতে বলার পর একজন তার পরিচয় দিলেন যে তিনি পিজি হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. রেজাউর রহমান, আর অন্যজন গতরাতে সাংবাদিকদের ব্রীফ করা সেই ডা. এস এম মোস্তফা জামান। আমি আব্বার শারীরিক অবস্থার কথা সরাসরি ডা. মেশকাত আহমেদের কাছে জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, স্যার আগের থেকে সুস্থ আছেন। এবার আমি বললাম, 'আমি আব্বার সাথে দেখা করতে চাই এবং তা এখনই। আমি তার মুখ থেকেই শুনতে চাই তিনি কেমন আছেন এবং কেনই বা তাকে এখানে আনা হয়েছে।' এ পর্যায়ে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. রেজাউর রহমান বললেন, 'আমরা আপনাকে দেখা করার ব্যবস্থা করছি। আপনি বাইরে অপেক্ষা করুন।'

সরল বিশ্বাসে আমি বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ঘন্টা পেরিয়ে গেল কিন্তু না ডা. মেশকাত আহমেদ আমাকে কোনো খবর দিলেন না ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. রেজাউর রহমান আমাকে কোনো খবর দিলেন! আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না এখন আমার কি করণীয়। হঠাৎ করে মাথায় একটা চিন্তা চলে এলো। আমি ভারপ্রাপ্ত আমীরে জামায়াত অধ্যাপক মুজিবর রহমান চাচাকে ফোন দিলাম (আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান তখন আওয়ামী জালিমের রোষানলে কারাগারে ছিলেন)। আব্বার শারীরিক অবস্থা, দেখা করতে না দেওয়া, ডাক্তার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতা ইত্যাদি সবকিছুই আমি তাকে খুলে বললাম। একই সাথে আমি ভারপ্রাপ্ত আমীরে জামায়াতের কাছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারের নিকট দু'টি আবেদন করার অনুমতি চাইলাম। তিনি জানতে চাইলেন কেমন আবেদন? জবাবে আমি বললাম, প্রথম আবেদনটি হলোÑ আম্মাসহ আমাদের পরিবারের অন্য সকল সদস্যদের আব্বার সাথে হাসপাতালে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য আবেদন। আর দ্বিতীয় আবেদনটি হলো- বয়স ও অসুস্থতা বিবেচনায় আব্বার সার্বক্ষনিক দেখভাল ও সার্বিক সহযোগিতার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে আমি অথবা যে কোনো একজন এটেনডেন্ট হিসেবে থাকার অনুমতি চেয়ে আবেদন। ভারপ্রাপ্ত আমীরে জামায়াত বললেন, প্রথম আবেদনটি না হয় ঠিক আছে কিন্তু দ্বিতীয় আবেদনটি কেন গ্রহণ করবে? যুক্তি কি? রেফারেন্স কি? আমি বললাম, চাচা! যুক্তি তো অসংখ্য আছে। আমি দু'টি ঘটনা রেফারেন্স হিসেবে আপনাকে বলতে পারি। ১. ট্রাইব্যুনালের অর্ডার। ২০১২ সালের ১৩ জুন আমার বড় ভাই রাফীক বিন সাঈদীর ইন্তেকালের পর আব্বা অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাকে ইব্রাহীম কার্ডিয়াক হাসপাতালে নেওয়া হলে তার হার্টে নতুন করে ৩টি মেজর ব্লক ধরা পড়ে এবং চিকিৎসকগণ তাৎক্ষনিক ৩টি রিং পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। বড় সন্তানের (রাফীক বিন সাঈদী) মৃত্যুর অসহনীয় যন্ত্রণা আর হার্টে ৩টি রিং পড়ানোর মতো ধকল সামলানো একা আব্বার পক্ষে খুব কঠিন ছিল। তাই তখন আইনজীবীদের মাধ্যমে আব্বার সঙ্গে সার্বক্ষনিক একজন এটেনডেন্ট থাকার অনুমতি চেয়ে আমি আবেদন করেছিলাম এবং শুনানী শেষে ট্রাইব্যুনাল সেই আবেদন মঞ্জুরও করেছিল। ঐ সময়ে আব্বা যতদিন হাসপাতালে ছিলেন ততদিন আব্বার সাথে একজন এটেনডেন্টও ছিলেন। ২. সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে থাকা অবস্থায় তার সেবা-যতœ করার জন্য, সার্বিক দেখভালের জন্য সরকার একজন এটেনডেন্ট থাকার অনুমতি দিয়েছিল। সুতরাং দু'টি রেফারেন্স আমাদের সামনে আছে, আমরা আব্বার জন্য একজন এটেনডেন্ট চেয়ে আবেদন করতে পারি। আমার সব কথা শুনে ভারপ্রাপ্ত আমীরে জামায়াত বললেন, 'আইনজীবী ও নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলে আমি তোমাকে জানাচ্ছি।'

এদিকে আমি বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ডা. মেশকাত আহমেদের সাথে দেখা করেছিলাম। ডা. মেশকাত আহমেদ ও হাসপাতালের পরিচালক রেজাউর রহমান বলেছিলেন 'আমার সঙ্গে আব্বার সাক্ষাতের ব্যবস্থা নাকি তারা করছেন।' বেলা গড়িয়ে ঘড়িতে ১টার মতো বাজে। তখনো তাদের দু'জনের কেউই আমাকে কোনো ম্যাসেজ না দেওয়ায় আমি আবার ডা. মেশকাত আহমেদের রুমে গেলাম। গিয়ে দেখি তিনি রুমে নেই। অফিস একেবারেই ফাঁকা। সেখান থেকে নেমে আমি সোজা চলে এলাম হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ রেজাউর রহমানের অফিসে। এখানে এসে রেজাউর রহমানের পাশে বসা দেখলাম ডা. এস এম মোস্তফা জামানকে। এখানে গিয়ে রেজাউর রহমানকে পেলাম ঠিকই কিন্তু তিনি তখন সরকারের বিভিন্ন সংস্থা আর সাংবাদিকদের সাথে কথা বলা নিয়ে ব্যাস্ত। আমাকে সময় দেওয়ার মতো সময় তার কোথায়! তবুও আল্লাহর সাহায্যে ধৈর্য নিয়ে দাঁতে দাঁত কামড়ে বসে আছি। আব্বার কোনো খবর জানতে পারছিনা, তাকে দেখতে পারছিনা- এটাতে এমনিতে আমার মন খারাপ হয়ে আছে, তার মধ্যে দেখছি পরিচালক সাহেব তার রুমে থাকা লোকজনের সাথে চা-নাস্তা আর গল্পে সময় পার করছেন। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছিল আমার, ঠিক এমন সময় ভারপ্রাপ্ত আমীরে জামায়াতের ফোন এলো। তিনি জানালেন আমার দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী দু'টি আবেদনই করা যাবে, কোন সমস্যা নেই। তিনি একই সাথে এটাও জানালেন যে, তিনি ইতিমধ্যেই আবেদন লেখা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন পৌঁছানোর জন্য দু'জন ল'ইয়ারকে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। আমি আলহামদুলিল্লাহ বলে চাচাকে শুকরিয়া জানিয়ে ফোন নিয়ে রুমের বাইরে চলে এলাম।

ভর দুপুর বেলা। বাইরে তখন প্রচন্ড রোদ। পরিচালকের রুম থেকে বেরিয়ে আমি একা উ™£ান্তের মতো হাঁটছি। খুব অসহায় মনে হচ্ছিল নিজেকে। আব্বার সকল মামলা সব জায়গাতে (জজ কোর্ট, সিএমএম কোর্ট, ট্রাইব্যুনাল, হাইকোর্ট, আপীল বিভাগ) আমিই একা বছরের পর বছর পরিচালনা করেছি। দৌঁড়িয়েছি, সিনিয়র-জুনিয়র ল'ইয়ারদের চেম্বারে গিয়েছি, অসম্ভব পরিশ্রম করেছি কিন্তু আজকের মতো এতটা অসহায় আর দূর্বল আর কখনোই মনে হয়নি। অজানা আতংক পেয়ে বসেছিল আমাকে। এর আগেও বহুবার আব্বাকে তার চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আনা হয়েছে। প্রত্যেকবার আমিই কোন ডাক্তারের কাছে আব্বাকে নিয়ে যাব তা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছি, আব্বা হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই চেম্বারে ডাক্তারের অবস্থান কনফার্ম করেছি। কারাগার থেকে আব্বাকে আনা-নেওয়ার গাড়ি ঠিক করেছি, আদালতের অনুমতি নিয়ে প্রিজন ভ্যানের পরিবর্তে আব্বার কিছুটা আরামের জন্য মাইক্রোবাসের ব্যবস্থা করেছি, দীর্ঘ ১৩ বছর (আমার বিদেশে সফরকালীন সময় বাদে) কারাগারে আব্বার প্রতিদিনের সেবনের ঔষধ ও সাপ্তাহিক শুকনা খাবার পৌঁছে দিয়েছি। এমনকি মহামারী করোনা চলাকালীন সময়ের প্রায় দুই বছর (যখন লক ডাউন ছিল তখনও) একাধারে একা গাড়ি চালিয়ে গাজিপুরের কাশিমপুরে গিয়ে আব্বার খাবার, ঔষধ সব পৌঁছে দিয়েছিÑ কিন্তু আজকের মতো এত অসহায়, এত একাকী, এত আতংক আমি এর আগে কখনোই অনুভব করিনি। তখন আমার মনের মধ্যে কি চলছিল তা আর এখন বলে বুঝাতে পারবো না। গত রাতের (১৩ আগষ্ট ২০২৩) পুলিশের আচরণ, আমাকে দেখা করতে দেওয়া তো দূর আব্বার কাছাকাছিও আসতে না দেওয়া, আব্বার চিকিৎসার কোন খবর আমাকে না জানানো, আব্বাকে রাখা সিসিইউর সামনে বিপুল সংখ্যক পুলিশের কঠোর অবস্থান, ডা.মেশকাত আহমেদের রুমের সামনে পুলিশের অবস্থান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা (রাত পেরিয়ে দুপুর গড়িয়ে গেলেও আব্বার মতো বিশ্বব্যাপি সমাদৃত নন্দিত একজন মানুষের চিকিৎসায় কোনো মেডিকেল বোর্ড গঠন না করা) ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে আমি ভীষন রকম আতংকগ্রস্থ/পেরেশান ছিলাম।

দুপুর ২টা থেকে আড়াইটার দিকে দু'জন ল'ইয়ার আমার কাছে এলেন। ততক্ষনে মোবাইলে দুটি আবেদনেরই আমি ড্রাফ্ট করে ফেলেছিলাম। ল'ইয়াররা আসতেই তাদেরকে মেইল করে তা দিয়ে দিলাম। তারা দেখে সামান্য কিছু কারেকশন করলেন। সচিবালয়ে প্রবেশ গেট বন্ধ হয়ে যেতে পারে এই চিন্তায় দ্রুতই ল'ইয়ারদেরকে সচিবালয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলাম। এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে রিসিভ কপি নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করলাম। তারা দু'জনই যথাময়েই সচিবালয়ে পৌঁছালেন, আবেদন জমা দিলেন এবং সংশ্লিষ্ট সেকশন থেকে আবেদনের রিসিভ কপি সংগ্রহ করলেন।

আমার ছোট চাচা হুমায়ুন কবির সাঈদীর ইন্তেকালের পর তার নামাজে জানাজায় আব্বার অংশগ্রহণের লক্ষ্যে প্যারলে মুক্তির আবেদন করেছিলাম। কাজটি সহজ ও তরান্বিত করার জন্য আমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর নাম্বার তখন সংগ্রহ করেছিলাম। তাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর মোবাইল নাম্বার আমার কাছে ছিল। আমি সেই নাম্বারে তাকে ফোন দিলাম। ফোন ধরলেন তিনিই। আমি সব বিষয় তাকে খুলে বললাম এবং আমার করা আবেদন দু'টি তার অফিসে জমা দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে আজকের মধ্যেই সে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ করলাম। তিনি সব শুনে আমাকে মোবাইল ফোনে লাইনে রেখেই আমার করা আবেদনের কাগজ আনালেন এবং বললেন, 'কোনো চিন্তা করবেন না। তিনি সুস্থ হয়ে যাবেন। আপনার করা আবেদন দুটি এখন আমার হাতে। আমি দু'টি আবেদনের ব্যাপারে দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিব। এবং আমার অফিস আপনাকে জানাবে।' তার এমন কথা শুনে আমার মন কিছুটা হালকা হয়ে এলো। দুঃশ্চিন্তার ভাব কিছুটা কমে এলো। শুধু তাই নয়, বাসায় ফোন করে আম্মাকে বললাম প্রস্তুত থাকতে। আমার সাথে থাকা ছোট ভাই নাসীম সাঈদীকেও খবরটি জানালাম। বড় ভাই শামীম সাঈদী তখন দেশের বাইরে থাকায় এবং ঐ দেশের সাথে আমাদের দেশের সময়ের বিরাট ব্যবধান থাকায় তাকে সব খবর বা আপডেট জানাতে পারছিলাম না। দুঃশ্চিন্তায় দুঃশ্চিন্তায় সারাদিন অভুক্ত আমি তাও ভুলে গিয়েছিলাম।

আমি সিসিইউতে ওঠার সিড়িতে বসে রইলাম। উপরে ওঠার কোনো সুযোগ নেই, কারন গোটা সিসিইউ'র এলাকা আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এক প্রকার ঘিরে ফেলেছে।বিকেল ৫টার মতো বেজে গেল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয় থেকে আমার আবেদন মঞ্জুরের কোনো খবর তখনো এলো না। আমি বারবার ঘড়ি দেখছি। মনে হচ্ছিল সময় যেন কোথাও আটকে গেছে। এদিকে হঠাৎ করেই হাসপাতাল কম্পাউন্ডে বেশ কিছু স্ট্যান্ডওয়ালা গাড়ি ঢুকতে দেখলাম। অফিসিয়াল ড্রেসের ও সিভিল পোষাকের অনেক নতুন অফিসারকে দেখলাম। পাল্লা দিয়ে বেড়ে যাচ্ছিল ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়ার সাংবাদিকের সংখ্যা। সাথে বাড়ছিল আল্লামা সাঈদীকে ভালবাসার মানুষের সংখ্যাও। ঘড়ির কাটা যখন ৬টা ছুঁয়ে ফেললো এবং আব্বার সাথে সাক্ষাতের তখনো কোন সুযোগ আমরা পরিবারের সদস্যরা পেলাম নাÑ তখন বুঝলাম আমাদেরকে পরিকল্পিতভাবেই আব্বার সাক্ষাত সঙ্গে করতে দেওয়া হচ্ছেনা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আমার সাথে শুধু মিষ্টি কথার অভিনয় করেছেন আর আমি তার অভিনয়কে সহমর্মিতা ভেবেছিলাম!

মাগরিবের পরপরই আব্বার দ্বিতীয়বার হার্ট অ্যাটাকের খবর ভেসে বেড়াচ্ছিল বাতাসে। পাগলের মত ছুটোছুটি করেও হাসপাতাল কতৃপক্ষের কাছ থেকে কোন খবর বের করতে পারলাম না। দায়িত্বরত প্রশাসনের লোকজনের কাছে গিয়ে বিষয়টির সত্যতা জানতে চাইলে তারা জানালেন যে, তিনি একেবারেই নাকি স্বাভাবিক আছেন। তারা দেখে এসেই নাকি আমাকে জানাচ্ছেন। কিন্তু তাদের চোখে চোখ রেখে আমি আশ্বস্ত হতে পারলাম না, তাদের চেহারায় বা অভিব্যক্তিতে তাদের কথার সত্যতা খুঁজে পেলাম না। এরই মধ্যে হাসপাতালের পরিবেশ ভারি হতে শুরু করলো। কিছুক্ষন পরপরই সরকার এবং পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের গাড়ি হাসপাতাল চত্ত্বরে আসতে শুরু করলো। হাসপাতালের চারিদিকে বিপুল পরিমানে পুলিশ মোতায়েন করা হলো। হাসপাতালের ডাক্তার আর প্রশাসনের লোকদের ছুটোছুটি দেখতে পেলাম।

আব্বাকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর থেকে নিয়ে আব্বার দুনিয়ার সফর শেষ করা পর্যন্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিংবা কর্তব্যরত চিকিৎসকগণ আব্বার চিকিৎসার বিষয়ে আমার/আমাদের সংগে একটিবারের জন্যও কোন আলোচনা করেনি, আব্বার পুরনো রোগ কিংবা চিকিৎসা সম্পর্কেও আমাদের কাছে কিছু জানতে চায়নি, তারা আব্বার কি চিকিৎসা করছেন সে সম্পর্কেও আমাদেরকে পরিস্কার করে কিছু বলেননি, তারা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আব্বার শারিরীক অবস্থার আপডেটও আমাদেরকে জানায়নি, সন্ধ্যার পর থেকে আব্বার শারিরীক অবস্থার অবনতি হচ্ছিলো- সেই খবরটিও আমাদেরকে জানায়নি, দ্বিতীয়বার আবারো আব্বার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে বা কার্ডিয়াক এরেষ্ট হয়েছে- সেটিও তারা অফিসিয়ালি আমাদেরকে কিছু জানায়নি, শেষ পর্যন্ত আব্বাকে তারা লাইফ সাপোর্টে নিয়েছে- এই বিষয়েও আমাকে/আমাদেরকে অবহিত করেনি, এমনকি লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার বিষয়েমআমাদের কাছ থেকে কোন লিখিত বা মৌখিক অনুমতিও নেয়নি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আব্বার গোটা চিকিৎসা প্রক্রিয়াটাই ছিলো রহস্যজনক এবং সন্দেহজনক। কেন তারা আব্বার চিকিৎসা সম্পর্কে আমাদেরকে অন্ধকারে রেখেছে বা কেনই বা তারা আমাদেরকে কোনকিছু জানতেই দেয়নি- সেইসবের জবাব নিশ্চয়ই স্বৈরাচার হাসিনা ও আওয়ামীলীগকে এই জাতির কাছে দিতেই হবে।

হাজারো ভাবনা, অস্থিরতা আর ছুটোছুটির মধ্যেই এশার আযান হয়ে গেল। সকল অস্থিরতা এক দিকে রেখে মনের প্রশান্তি আর আব্বার দ্রুত সুস্থতা ও নেক হায়াত কামনায় মালিকের দরবারে সেজদা দেয়ার জন্য ছোট ভাই নাসীম সাঈদীকে নিয়ে পিজি হাসপাতালের মসজিদের দিকে ছুটলাম। কাকতালীয় কিনা জানিনা ইমাম সাহেব শাহাদাতের আয়াত ধরলেন। তিনি সূরা আলে ইমরানের ১৬৭ নাম্বার আয়াত থেকে তেলাওয়াত শুরু করলেন। যখন তিনি এই আয়াত তেলাওয়াত করছিলেনÑ

وَ لَا تَحۡسَبَنَّ الَّذِیۡنَ قُتِلُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ اَمۡوَاتًا ؕ بَلۡ اَحۡیَآءٌ عِنۡدَ رَبِّهِمۡ یُرۡزَقُوۡنَ

(অর্থ: আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে কখনোই মৃত মনে করো না; বরং তারা জীবিত এবং তাদের রবের কাছ থেকে তারা জীবিকা-প্রাপ্ত হয়ে থাকে।) মনের অজান্তেই অনর্গল চোখ বেয়ে পানি গড়াতে লাগল নামাজের ভেতরেই। মনে হচ্ছিল ভেতরটা ধুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে। নামাজের ভেতরেই চিৎকার দিতে ইচ্ছে করছিল। চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারছিলাম না, টপটপ করে দাড়ি ভিজে পাঞ্জাবীতে পড়ছিলো। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিলো। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে চোখের পানিতে নামাজ শেষ করলাম। মুনাজাতরত অবস্থায়ই একজন পুলিশ অফিসার এসে আমাকে সালাম জানালেন। বললেন, রমনা জোনের এডিসি হারুন অর রশীদ ও শাহবাগ থানার ওসি নূর মোহাম্মাদ আমার সাথে কথা বলার মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি মসজিদ থেকে বেড়িয়ে দেখলাম তারা অল্প দূরেই দাঁড়িয়ে আছেন। আমি কান্নাভেজা চোখ সামলে তাদের কাছে যাওয়ার পর তারা তাদের সাথে আমাকে সিসিইউতে যেতে বললেন। আমি ধরেই নিলামÑ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে আব্বার সাথে সাক্ষাতের অনুমতি বুঝি পাওয়া গেল! আমার ছোট ভাই নাসিম সাঈদীকে ছাড়া আমি যেতে রাজি হলাম না। নাসিম তখন মসজিদেই নামাজরত ছিলো। আব্বার সাথে সাক্ষাত হবে আমাদের, ওকে ছাড়া কিভাবে যাই? সাক্ষাতের জন্য তারা আমাদের ডেকেছে, দীর্ঘ প্রতিক্ষার প্রহর শেষ হয়েছে আমাদের। আব্বাকে একনজর দেখতে যাচ্ছি আমরা। শাহবাগ থানার ওসি আমাদেরকে নিয়ে মানুষের ভিড় ঠেলে উপরে দোতালায় সিসিইউর সামনে চলে আসলেন। সেখানে আরো কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তা অপেক্ষমান ছিলেন। দীর্ঘক্ষনের উদ্বেগ উৎকন্ঠা নিয়ে আব্বার রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা। বহুল প্রতিক্ষিত ডাক আমাদের জন্য।

কিন্তু ডেকে নিয়ে তারা যে সংবাদটি জানাল, সেটি বইবার মত ক্ষমতা আমাদের ছিল না। পৃথিবী সমান ওজনদার এক ভয়াবহ দুঃসংবাদ তারা দিল আমাদেরকে। আমার পরম শ্রদ্ধেয় আব্বার ইন্তেকালের দুঃসংবাদ দিল তারা আমাদেরকে। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিঊন। আব্বা এ দুনিয়াতে আর বেঁচে নেই। মাথা ঘুরতে লাগল। চোখ ঝাপসা হয়ে আসল। হাত-পা অকেজো হয়ে যেতে লাগল। এত ওজনী এই দুর্বিষহ সংবাদ বহন করার মত শক্তি কি আমার আছে! এ কি শুনছি আমি! এটা হতে পারেনা। চিৎকার করে বলে উঠলাম, কি বলছেন আপনারা এসব। ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার দিলাম। প্রশাসনিক লোকদের শোরগোলে আমার সেই চিৎকার হারিয়ে গেল। তাদের কথা মিথ্যা মনে হল। আমি আব্বাকে দেখতে চাইলাম। ওরা আমাকে আব্বার কাছে নিয়ে গেল। সাদা একটি কাপড় দিয়ে কোরআনের পাখির সমস্ত শরীর ঢেকে রেখেছে ওরা। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এই সাদা কাপড়ে ঢাকা আছে কোটি মানুষের ভালবাসা! আমি মাথার কাছের কাপড় সরালাম। কী সুন্দর করে হাসি মুখে ঘুমিয়ে আছেন আমার বাবা! আমি তার কপালে চুমু দিলাম। আমি তার পা দু'টি ধরলাম। লম্বা করে চুমু দিলাম তার পবিত্র দু'পায়ে।

আমার চোখের পানি ফোটায় ফোটায় আব্বার পায়ে পড়তে লাগলাম। আর আমি আব্বাকে ডাকতে লাগলাম, আব্বা.... আব্বা.... আব্বা..... আব্বা..... !

আব্বা হারিয়ে গেলেন চিরতরে। বাবা হারা পৃথিবীর লাখো বনি আদমের কাতারে আজকের এইদিনে আমিও শামিল হয়ে ছিলাম। মুক্ত আব্বাকে দেখার স্বপ্ন আর পূরণ হলোনা আমার। আমার এ স্বপ্ন এক মহা শোকে পরিণত হয়ে আরেক দীর্ঘ অপেক্ষার সূচনা করল।

আওয়ামী লীগ ও তাদের গোলাম শেখ হাসিনা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে কথিত যুদ্ধপরাধের সাজানো বিচারের নামে বিচারিক হত্যা (ঔঁফরপরধষ করষষরহম) করতে চেয়েছিল, কিন্তু আল্লাহ তায়ালার দয়ায় বিশ্বব্যাপি সচেতন মানুষের প্রতিবাদ ও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের কারনে ভারতের গোলাম শেখ হাসিনা আল্লামা সাঈদীকে কথিত বিচারের নামে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করতে পারেনি। অবশেষে খুনি হাসিনা আল্লামা সাঈদীকে চিকিৎসার নামে হত্যার (গবফরপধষ করষষরহম) পথ বেছে নিয়েছিল।

শেষ কথা : ২০১০ সাল থেকে প্রথমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও পরে কাশিমপুর কারাগারে আব্বাকে দেখতে প্রতি মাসে একবার (আমাদের জন্য বানানো কারা কর্তৃপক্ষের রীতি) যাওয়া আমাদের প্রতি মাসের মূল কাজ ছিলো। যত ব্যস্ততা থাকুক, যত জরুরী বিষয়ই থাকুক- আব্বার সাথে সাক্ষাতের দিনে আমি কোন কাজই রাখতাম না। এখন কাশিমপুরে যাওয়ার অপেক্ষায় আর দিন গুণতে হয়না আমার! সেখানে গিয়ে আব্বার সাথে সাক্ষাতের আবেদন জমা দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়েও থাকতে হয়না আমার! আব্বাকে নিয়ে আর কোনো কাজ নেই আমার, এখন আমার অখন্ড অবসর!

আব্বাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার প্রতিবাদে যারা শহীদ হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন, হাসপাতাল থেকে শুরু করে জানাযা ও দাফনে যারা সময় দিয়েছেন, কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন, বহু শত মাইল পাড়ি দিয়ে জানাযায় এসেছেন, আমাদের শান্তনা জুগিয়েছেন, এখনো আল্লাহর দরবারে আব্বার জন্য কেঁদে কেঁদে দোয়া করে যাচ্ছেন- তাদের সকলকে আমাদের পরিবারে পক্ষ থেকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এবং আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে সকলের উত্তম জাযা কামনা করছি।

আব্বার সারাজীবনের তামান্না ছিল শাহাদাত। সারাজীবন লক্ষ লক্ষ মানুষকে সাথে নিয়ে মুনাজাতে আব্বা আল্লাহর কাছে শাহাদাত ভিক্ষা চেয়েছেন। আব্বার এই চাওয়ার মধ্যে কোনো ভনিতা ছিল না, বরং তিনি কায়মনেই তা চাইতেন। আল্লাহর রাসূল সা. এর হাদীস অনুযায়ী আমার সম্মানিত পিতা শহীদ। সাহল ইবনু হুনায়ফ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'যে ব্যক্তি সত্যিকারে আল্লাহর নিকট শাহাদাত প্রার্থনা করে আল্লাহ তা’আলা তাকে শহীদের মর্যাদায় অভিষিক্ত করবেন যদিও সে আপন শয্যায় ইন্তিকাল করে।'-সহীহ মুসলিম। আমরা আল্লাহর জান্নাতে আমার শহীদ পিতার সাথে আবারও মিলিত হব ইনশাআল্লাহ, ইনশাআল্লাহ। এ জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের আদেশ নিষেধ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করে দ্বীন কায়েমের রাস্তায় সময় দিয়ে নিজেদেরকে জান্নাত হাসিলের যোগ্যতা অর্জন যেন করতে পারি- আপনাদের সকলের কাছে কায়মনবাক্যে সেই দোয়া চাচ্ছি। আল্লাহ এবং রাসুল (সাঃ) এর সাথে সাক্ষাতের একমাত্র জায়গাই যে জান্নাত। সে জান্নাতেই আমরা আব্বাকেও পাব ইনশাআল্লাহ।

আল্লাহ তায়ালা দয়া করে শহীদ আল্লামা সাঈদীর কবরটাকে কোরআনের নূর দিয়ে আলোকিত করে দিন, কোরআনের পাখিটাকে দয়া করে জান্নাতের পাখি বানিয়ে নিন, আল্লাহ তায়ালা তাঁর গোলামকে দয়া করে তাঁর কাছে একটি ঘর বানিয়ে দিন আর একান্ত দয়া পরবশে আমাদেরকে পিতা হারানোর যন্ত্রনাকর শোক সইবার তাওফিক দিন।

আব্বা! তোমার সাথে জান্নাতে সাক্ষাতের অপেক্ষায় আমি রইলাম।

মাসুদ সাঈদী

আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর তৃতীয় সন্তান

পিরোজপুর-১ আসনে জামায়াত মনোনীত এমপি পদপ্রার্থী ও

সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান, জিয়ানগর, পিরোজপুর।