মোহছেনা পারভীন

আমি প্রথম যখন আয়নাঘরের কথা শুনেছিলাম তখন মনে করেছিলাম এটা আবার কেমন ঘর। হয়তো আয়না দিয়ে বাঁধানো কোন ঘর। যে ঘরের চারপাশে আয়না দিয়ে ঘেরা। ঘরটা বোধ হয় এমনি হবে। ধীরে ধীরে আমি আয়নাঘর সম্পর্কে জানতে পারলাম, এ ঘরে আয়না তো দূরের কথা এমনি ভয়াবহ এক অন্ধকার ঘর, যেখানে কোনো ছিদ্র পর্যন্ত নেই। কোনো পোকামাকড়ও বসবাসের যোগ্য নয়, মানুষ তো দূরের কথা। বাইরের আলো বাতাস যে ঘরে পৌঁছায় না সেটাই হচ্ছে আয়নাঘর। এভাবেই মোটামুটি আয়নাঘরের সংজ্ঞা আমার মনের মধ্যে প্রোথিত হয়েছে।

আমি বেসরকারি একটি স্কুলে শিক্ষকতা করি। স্কুল গাড়িটি আমার জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। আমার চিন্তাভাবনা, সুখ দুঃখের কথা স্মরণ, দোয়া দরুদ, বিভিন্ন কাজের প্ল্যানিং এই গাড়িতে বসেই করে থাকি জ্যামের কল্যাণে। আর একটু খোলাসা করে বলি, উত্তরা থেকে গুলশানে যাওয়া আসায় আমার অনেক সময় লেগে যায়। তাই আমার অনেক প্রয়োজনীয় কাজ, প্লান গাড়িতে বসেই করে থাকি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দেওয়া আমার ব্রেইন নামক কম্পিউটারে।

আয়নাঘরে যাদের গুম করে রাখা হয়েছে তাদের খবর আমরা জানতে পেরেছি সাংবাদিকদের মাধ্যমে। সাংবাদিকরা আমার কাছে সবচাইতে আপনজন। তারা ছাড়া যারা চাটুকার। সাংবাদিকদের জন্য আমি মন থেকে দোয়া করি। যারা আয়নাঘরের বাসিন্দা ছিলেন তারা সবাই আমাদের পরিচিত জন। কেউ কারো ভাই, কেউ কারো স্বামী, কারো ছেলে, কন্যা। মানসিক এবং শারীরিকভাবে এত দুর্বল ছিলাম যে গুমের শিকার পরিবারগুলোর কান্না সহ্য করতে পারিনি। মনের দিক থেকে ট্রমার মধ্য দিয়ে গিয়েছি। আর সেইসব পরিবারের কথা চিন্তা করেছি, যারা দুঃসহ একটি জীবন পার করছে। নিরীহ মানুষকে গুম করে নিয়ে জঙ্গি বানিয়ে ফেলছে। মানসিক এবং শারীরিকভাবে টর্চার করছে। এই খবরগুলো যখন মিডিয়াতে পাচ্ছিলাম শুধু পরিবারের লোকজন নয়, সারা বাংলাদেশ ট্রমাটাইজড হয়ে গিয়েছিল। এখনো মানসিকভাবে বিপর্যস্ত তারা।

আমি একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে গুমের প্রামাণ্য চিত্র দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছি না। যারা ভুক্তভোগী তাদের সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা, দিন, মাস, বছর কীভাবে কাটিয়েছে, সেই কথা ভেবে বিচলিত হয়ে পড়ছি। তাদের কষ্টের কাছে আমার খারাপ লাগা কোন ব্যাপার না। তাদের সময়গুলোকে তো আমরা আর ফেরত দিতে পারবো না। একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নিলাম। মনে মনে বললাম, আমাকে সাহসী হতে হবে। ভিতুদের জন্য এ পৃথিবী নয়। যারা ফিরে এসেছে তাদের সাক্ষাৎকার বিভিন্ন মিডিয়াতে দেখা শুরু করি। একেক জনের গল্প একেক রকম হলেও কষ্টটা সবার এক। সবার পরিবারের দৈন্যদশা প্রায় কাছাকাছি। অনেকের পরিবার ভেঙ্গে গেছে। অনেকের স্ত্রী স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে স্বাভাবিক জীবন হারিয়ে ফেলছে। গুমের শিকার পরিবারগুলোর কান্নায় ভারী হয়ে গেছে আকাশ বাতাস। তাদের সংসারে আনন্দ বলতে কিছুই ছিল না। ঈদের আনন্দ তো সুদূর পরাহত।

ইদানিং আমি মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বেশি চিন্তা করি । বিশেষ করে করোনার পর থেকে। শারীরিক স্বাস্থ্য ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব নয়। তাই আমার কাছে মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখন তো দেখছি পুরো দেশ মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত।

আমার মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়। আমাদের দেশ বাংলাদেশ। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা এই বাংলাদেশে এত নিষ্ঠুরতা! আমরাতো সবাই এই দেশেরি বাসিন্দা, সবাই সবার আপনজন। বিদেশের কোথাও তো আমরা এমন নিষ্ঠুরতা দেখিনি। শাহজালালের, শাহ মখদুমের, শাহ পরানের এই বাংলাদেশে বিদেশি প্রভুর মন রক্ষা করতে গিয়ে এইভাবে কোনো মানুষ নিষ্ঠুরতা চালাতে পারে! আমি তো হতবাক!

প্রামাণ্য চিত্রটি দেখতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে যারা আয়নাঘরের দায়িত্বে ছিল, যারা ছিলেন আয়নাঘরের মাস্টারমাইন্ড, নিরীহ মানুষদের যারা পাশবিক নির্যাতন করেছে তাদের সামনে কোন আয়না ছিল না! যদি থাকতো তাহলে তারা বুঝতে পারত, নিজেকে দেখতে পারতো তারা কত জঘন্য, তাদের বীভৎস চেহারা উন্মোচিত হতো । অনুশোচনার অনলে পুড়ে নিজেকে শোধরাতে পারতো। মানবিক হতে পারতো। কারণ সৃষ্টির সেরা মানুষ একে অপরকে কিংবা মুসলমান অপর মুসলমানকে কষ্ট দিতে পারে না। কবি বলেছেন, কারো মনে তুমি দিও না আঘাত সে আঘাত লাগে কাবার ঘরে।

মুমিনকে কষ্ট দিতে নিষেধ করেছেন প্রিয় নবি (সা.)। তিনি বলেছেন, তোমরা মুসলমানদের কষ্ট দেবে না, তাদের লজ্জা দেবে না এবং তাদের গোপন দোষ অনুসন্ধান করবে না। কেননা, যে মুসলিম ভাইয়ের গোপন দোষ অনুসন্ধান করে আল্লাহ তার গোপন দোষ প্রকাশ করে দেবেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মুসলমানকে কষ্ট দিতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ বলেন, অপরাধ না করা সত্ত্বেও যারা মুমিন পুরুষ ও নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।

মুমিনরা একজন আরেক জনের আয়নাস্বরূপ, সে তাকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। কিন্ত আয়নাঘরের পরিচালকদের মধ্যে তা দেখতে পাওয়া যায়নি। তাদের হাতে নির্যাতিত মজলুম ব্যক্তিদের শরীর, মুখের চেহারা এমন হয়েছে যে, অল্প বয়সের যে ছেলেটি গুম হয়েছে, সে যেন বৃদ্ধ হয়ে ঘরে ফিরেছে। ভিকটিম নিজেই নিজেকে চিনতে পারছে না, আর পরিবারের লোকজনতো বাকরুদ্ধ।

প্রত্যেক পরিবারের একটি স্বপ্ন থাকে। গুমের শিকার সকল মানুষের স্বপ্নগুলোকে যেন কচুকাটা করা হয়েছে। পরিবারের অন্য সদস্যদের স্বপ্নগুলো মুখ থুবড়ে আছে অজানা আশঙ্কায়। তারা তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে মানিয়ে নিতে পারছে না। আমরা যারা তাদের বিষয়ে সাংবাদিকদের কল্যাণে জানতে পারছি আমরাও সমব্যাথী হচ্ছি।

ক্লান্ত দুপুরে আমি বুকভরা কষ্ট নিয়ে লিখতে বসেছি। আমার লেখাটি লেখা হয়ে উঠলো কি না জানি না। শুধু লেখাটা আমার উদ্দেশ্য নয়, আমার উদ্দেশ্যটা ভিন্ন বৈকি। আর যেন গুম, খুনের কালচার চালু না হয়, সে কথাটি সহজভাবে বলা।

আমি আশাবাদী, আমরা বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছি। ন্যায়বিচার নিশ্চিত হলে নিরীহ মানুষগুলো আবার স্বপ্ন বুনতে শুরু করবে। তারা বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তুলবে। ছাত্র ও জনগণের দ্বারা নির্মূল হওয়া ফ্যাসিবাদ বাংলার জমিনে আসতে দিবে না।

জনগণের রায়ে পরবর্তীতে যারা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পাবেন, তাদের প্রতি আমার সবিনয় অনুরোধ আপনারা আপনাদের ক্ষমতার অপব্যাবহার করবেন না। হৃদয়ের ভেতর সত্য ও সুন্দরের আয়না রাখবেন। যে আয়নায় নিজেই নিজেকে দেখবেন। সূরা বনি ইসরাইলে বলা হয়েছে- “আপন কর্মের রেকর্ড পড়। আজ তোমার নিজের হিসাব করার জন্য নিজেই যথেষ্ট।’’

আর জনগণকে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। পরবর্তী সরকারের হৃদয় হবে একটা আয়না। সেই আয়নায় যেন জনগণের মুখ ছাড়া অন্য কিছু দেখা যায় না। আমার আজকের গল্পের শেষ কথা আগামীর নেতা যিনি হবেন, তিনি হবেন মানবিক। অধিকতর মানবিক।