মো. রবিন ইসলাম

সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো দোভাষী পুথির উদ্ভবেও যুগ বিভাগ কাজ করে। পুথিসাহিত্য বাংলা সাহিত্যের একটা বিরাট জায়গা অধিকার করে আছে। মুসলমান কবিরা দোভাষী পুথি সাহিত্যে বিশেষ অবদান রেখেছেন। ছাপাখানা প্রচলিত হওয়ার আগে হাতে লেখা গ্রন্থই পুথি নামে পরিচিত ছিল। তারা ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্নের চেষ্টা করে। সে সময় এদেশে ইরানি শিয়াদের মাধ্যমে ফারসি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। তখন ছাপাখানার মাধ্যমে গ্রন্থ প্রচলিত হয়। এ গ্রন্থই দোভাষী পুথি নামে পরিচিত। বাংলা সাহিত্যে দোভাষী পুথি সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৮০০ সাল পর্যন্ত সময়কে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মধ্যযুগ বলে ধরা হলেও মূলত ভারতচন্দ্রের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মধ্যযুগের অবসান হয়। ভারতচন্দ্র ছিলেন মধ্যেযুগের সর্বশেষ শক্তিমান কবি। তাঁর মৃত্যুর পর বাংলা সাহিত্যে শূন্যতা দেখা দেয়। এ সময়ে হিন্দুসমাজে কবিগান ও মুসলমান সমাজে পুথি রচনা শুরু হয়। কবিগান রচয়িতাদের বলা হতো কবিওয়ালা আর পুথি রচয়িতাদের বলা হতো শায়ের। কবিওয়ালা ও শায়েরদের শিক্ষা ছিল অপ্রতুল। কবিগণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গান রচনা করতেন। সেই গান উপস্থিত জনগণের সামনে পরিবেশ করা হতো। কবিগণ পৌরাণিক, সামাজিক এবং সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে আসরে উপস্থিত জনগণের মাঝে ছড়া আকারে পরিবেশ করতেন এবং সুর ও সংগীতের মাধ্যমে তা গেয়ে শোনাতেন।

মধ্যযুগের শেষ পাদে দোভাষী পুথির প্রচলন শুরু হয়। কবি ভারতচন্দ্রের মৃত্যুর পর তার অঞ্চলে ইসমাইল গাজীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে বড় পীরের আস্তানা। ইসমাইল গাজী সবার কাছে বড় খাঁ গাজী নামে পরিচিত ছিলেন। আঠারো শতকে এ বড় খাঁ গাজীকে কেন্দ্র করে ভুরুসুট মান্দারনে পুথি সাহিত্যের কেন্দ্র গড়ে ওঠে।

মুসলমান সমাজে আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি মিশ্রিত এক ধরনের কাব্য রচিত হয়। এ কাব্যগুলো অলৌকিকতায় পরিপূর্ণ। ইসলামের নবী-খলিফাদের কিংবা বীরযোদ্ধাদের যুদ্ধ এবং বীরত্ব বা প্রেম কাহিনী নিয়ে পুথিগুলো রচিত হয়। যারা এ কাব্য রচনা করতেন তারা শায়ের নামে পরিচিত। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এ কবিওয়ালা ও শায়েরগণ কাব্যচর্চা শুরু করেন। এই কাব্যচর্চা উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বহাল ছিল। এ সময়কে বাংলা সাহিত্যের অবক্ষয়ের যুগ বলে অনেকে মনে করে। এ অবক্ষয়ের যুগের নিদর্শন হলো পুথিসাহিত্য।

বাংলা সাহিত্যের কবিওয়ালা ও শায়েরদের উদ্ভব হয়েছে নানা কারণে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেন সুলতান ও সুবেদারগণ। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের ফলে বাংলায় এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং সংস্কৃতির বিকাশে বাধা নেমে আসে।

সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের পর ১৭৬০-১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময় বাংলা সাহিত্যে ক্রান্তিকাল বলে পরিচিত। এ সময়ে কোনো শক্তিমান সৃজনশীল কবির আবির্ভাব হয়নি। এ সময়ে রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে। রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার প্রভাব সমাজের ওপর পড়ে । বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা তখন খারাপের দিকে যায়। ইংরেজরা সমাজের মানুষের ওপর অমানবিক অত্যাচার শুরু করে। তাদের অত্যাচারে সমাজজীবন থেকে সুখ বিদায় নেয়। এ সময় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা প্রচলন করা হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সাধারণ কৃষক দরিদ্র ও ভূমিহীন হয়ে পড়ে। মুসলমানরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুসলমানরা শাসনক্ষমতা হারিয়ে সাধারণ প্রজায় পরিণত হয়। এ অরাজক পরিস্থিতিতে ভালো কোনো সাহিত্য নির্মিত হয়নি। ফলে অশিক্ষিত জনগণের আনন্দ দিতে পুথিসাহিত্য এ সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মধ্যযুগে যাঁরা দোভাষী পুথি সাহিত্যের ভান্ডার সমৃদ্ধ করেছেন তাঁদের মধ্যে শাহ মুহাম্মদ সগীর, শাহ গরীবুল্লাহ, দৌলত উজির বাহরাম খান, আলাওল, শেখ ফয়জুল্লাহ, মুহাম্মদ কবির, দোনাগাজী, কোরেশী মাগন ঠাকুর, আব্দুল হাকিম, সৈয়দ হামজা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের নাম উল্লেখযোগ্য। পুথি সাহিত্যের সাধারণত চার ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

* রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান-ইউসুফ-জুলেখা, লায়লী-মজনু, সয়ফুলমুলক-বদিউজ্জামাল, গুনে বকাওলী ইত্যাদি।

* যুদ্ধ সম্পর্কিত-জঙ্গনামা, আমীর হামজা, মক্তুল হোসেন, মোহাম্মদ হানিফার যুদ্ধে, সোনাভান, কারবালার যুদ্ধ ইত্যাদি।

* পির পাঁচালি-গাজী কালু, চম্পাবতী, সহ্যপীরের পাঁচালি, জৈগুনের পুথি, হাতেম তাই, মধুমালতী ইত্যাদি।

* ইসলাম ধর্ম, ইতিহাস নবী আওলিয়ার জীবনী ও বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান সম্পর্কিত-কাসাসুল আম্বিয়া, তাজকিরাতুল আউলিয়া, হাজার মাসলা, নূরনামা, নবী বংশ, নসিহত নামা ইত্যাদি। পুথিসাহিত্যের অনেক মুসলিম কবি ছিলেন। তবে তাঁদের মধ্যে দুজন বিশিষ্ট কবি হলেন শাহ গরীবুল্লাহ ও সৈয়দ হামজা। তাঁরা দুজনই ভুরুসুট মান্দারন এলাকার লোক ছিলেন।

শাহ গরীবুল্লাহ দোভাষী পুথি সাহিত্যের প্রথম কবি। তিনি হাফিজপুর গ্রামের অধিবাসী। গরীবুল্লাহ বড় খাঁ গাজীর ভক্ত ছিলেন। শাহ গরীবুল্লাহর শ্রেষ্ঠ রচনা ইউসুফ-জোলেখা। পবিত্র কোরআন ও বাইবেলে ইউসুফ. (আ) সাথে জোলেখার কাহিনি ভিত্তি করে এটি রচিত হয়। এটি ফারসি ভাষার কাব্য ছিল। ফারসি কাব্যের ভাবানুবাদ হিসেবে গরীবুল্লাহ এটি রচনা করেন।

সৈয়দ হামজা পুথি সাহিত্যের সবচেয়ে খ্যাতিমান কবি। তার ভাষা ছিল আবেগময়। তার উল্লেখযোগ্য পুথি হলো জৈগুনের পুথি। জৈগুনের পুথির কাহিনী হলো হানিফার সাথে বিবি জৈগুনের যুদ্ধ। জৈগুন যুদ্ধে হানিফার কাছে পরাজিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন।

মধ্যযুগের মানুষের মনে পুথি সাহিত্য বিশাল সাড়া জাগিয়েছিল। সাধারণ মানুষের মনের মধ্যে এ পুথি সাহিত্য জায়গা করে নেয়। পুথি সাহিত্যে মুসলমান কাহিনী ছিল বেশি এবং এর জনপ্রিয়তাও ছিল অনেক। আধুনিক যুগের শুরুতে বাংলা সাহিত্যে যে অবক্ষয় দেখা দিয়েছিল পুথি সাহিত্য সে স্থান পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিল।