চর মজলিসপুর গ্রামের এক কোণে মাটি আর ঘাসের গন্ধে ভরা এক কাঁচা বাড়ি। সেই বাড়িতেই থাকে মতি মিয়া, একজন সাধারণ কৃষক। দিন এনে দিন খায়, জীবনটা যেন প্রতিদিন নতুন লড়াই। ভোরবেলা যখন গ্রামের মসজিদে আজান হয়, তখনই মতি মিয়ার ঘুম ভাঙে। পুরনো লুঙ্গি আর মলিন শার্ট গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ে কাজের খোঁজে। কারো ধান কাটা, কারো জমিতে আগাছা তোলা, কারো ঘরে গরু ছাগল চরানোÍযেখানে কাজ মেলে, সেখানেই তার জীবন।

মতি মিয়ার সংসারে তিনটি মুখÑ স্ত্রী রহিমা, দুই ছেলে আর এক মেয়ে। বড় ছেলে রাজু ক্লাস ফোরে পড়ে, ছোট ছেলে সাজু মাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছে, আর মেয়ে রুবি এখনো ছোটÑ মায়ের আঁচল ছাড়ে না। সংসারের সব দায়িত্ব মতি মিয়ার কাঁধে। জমি নেই, গরু নেই, এমনকি একটা নিজস্ব নৌকাও নেই। তবুও প্রতিদিনের পরিশ্রমেই সংসারটাং কোনোরকমে টিকে আছে।

রহিমা সকাল সকাল উঠেই চুলায় আগুন ধরায়। আগুনের ধোঁয়া ঘর ভরে যায়, তবুও মুখে একটা শান্ত হাসি। আজ কী রান্না হবে সেটাই চিন্তা। চাল আছে আধা কেজি, আলু আছে তিনটা, পিঁয়াজের অর্ধেক টুকরোÑ এই দিয়ে পুরো পরিবারের ভাত হবে কি না সেই ভাবনা। মাঝে মাঝে মতি মিয়া হাটে গিয়ে ১০ টাকায় একটু কাঁচা মরিচ আর নুন এনে দেয়। তারপর আলু ভর্তা, একটু মরিচ আর নুন দিয়ে ভাতই তাদের রাজা ভোজন।

রহিমা প্রায়ই ভাবে, “বাচ্চাগুলারে একটু ডিম দিই, একটু দুধ দিই, শরীরটাও তো গড়তে হবে।” কিন্তু সে ভাবনাটা স্বপ্নের মতো। একদিন কাজ না পেলে মতি মিয়ার পকেটে একটা পয়সাও থাকে না। সেদিন হয়তো শুধু লবণ-ভাতেই দিন কাটে।

তবুও এই অভাবের সংসারে শান্তি আছে, ভালোবাসা আছে। সন্ধ্যায় কাজ শেষে মতি মিয়া বাড়ি ফেরে, পা ভিজে কাদামাটি জমে থাকে। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে রাজু “বাবা, আজ কি আমগাছের নিচে কাজ করছো?” সাজু বলে, “বাবা, আমার জন্য কি হাট থেকে কিছু এনেছো?” মতি মিয়া ব্যাগ থেকে একটা পাকা কাঁঠালের কোয়া বের করে দেয়। ছোট্ট মুখগুলো হাসিতে ভরে যায়। এই হাসিই তার পরিশ্রমের পুরস্কার।

রহিমা ছেলেমেয়েদের দেখে মনে মনে ভাবে, “অভাবের সংসার হলেও, এদের হাসি আমার পৃথিবীর সবচেয়ে দামি জিনিস।”

একদিন সকালে মতি মিয়া কাজ পেল না। চারদিকেই হালকা বৃষ্টি, নদীর পানি বেড়েছে, জমিগুলো কাদা হয়ে গেছে। কাজের লোক নিচ্ছে না কেউ। সে হাটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, হয়তো কেউ ডাকে। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে যায়, কেউ কাজ দেয় না। পেটের ভেতর তখন চোঁ চোঁ আওয়াজ। এক চা দোকানে গিয়ে এক কাপ চা চায়, কিন্তু পয়সা নেই। দোকানদার চেনে মতি মিয়াকে, বলে, “আচ্ছা, কাল দিলেই হবে মতি ভাই।”

সে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে ভাবেÑ “মানুষের দয়া দিয়েই বাঁচি।”

বিকেলে সে খালি হাতে বাড়ি ফেরে। রহিমা বুঝে ফেলে, আজ কাজ পায়নি। তবুও মুখে কিছু বলে না, শুধু বলে, “তুমি একটু বসো, আমি দেখি পোলাপানগুলারে খাইয়ে নিই।” হাঁড়িতে মাত্র এক কাপ চাল ছিল, সেটা পানি মিশিয়ে পায়েসের মতো করে রান্না করে চারজনের মধ্যে ভাগ করে দেয়। বাচ্চারা চুপচাপ খায়, কেউ কাঁদে না। এই ঘরে অভাব আছে, কিন্তু মনোবল আছে পাহাড়ের মতো।

পরদিন সকালেই আবার নতুন সূর্য ওঠে। মতি মিয়া ভাবল, আজ না হয় নদীর ধারে গিয়ে মাছ ধরবে। পুরনো জালটা নিয়ে গেল নদীর ঘাটে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে রইল, অবশেষে তিনটা ছোট মাছ ধরতে পারল। মনে মনে বলে উঠল, “আলহামদুলিল্লাহ! আজ অন্তত ছেলেমেয়েরা মাছ খেতে পারবে।”

বিকেলে রহিমা আগুন জ্বালিয়ে সেই তিনটা মাছ দিয়ে তরকারি রান্না করল। ঘ্রাণে ভরে গেল ছোট্ট ঘরটা। বাচ্চারা খুশিতে চিৎকার করে উঠল, “আজ মাছ! আজ মাছ!”

মতি মিয়া হেসে বলে, “দেখো, জীবনটা কেমন মজার জিনিস। অভাব আছে, তবু আনন্দ মরে না।”

গ্রামের মানুষজন জানে, মতি মিয়া কষ্ট করে, কিন্তু কখনও কারও কাছে ভিক্ষা চায় না। তার আত্মসম্মান পাহাড়ের মতো উঁচু। কেউ সাহায্য করতে চায়, সে বলে, “না ভাই, আজ না পারলে কাল পারব।

একদিন গ্রামের এক ধনী কৃষক তার জমিতে ধান কাটার জন্য দশজন মজুর চাইল। মতি মিয়াও সেখানে কাজ পেল। পুরো দিন কাজ শেষে সে মজুরি পেল ৪০০ টাকা। সেই টাকাটা হাতে নিয়ে মনে হলো, যেন সারা পৃথিবীর সুখ পেয়েছে।

বাজার থেকে আধা কেজি গরুর মাংস, কিছু চাল আর তেল কিনে বাড়ি ফিরল। রহিমার চোখে পানি চলে এল। “এইতো, ঈদের আগেই আজ আমাদের ঘরে মাংস পড়বে!”

সেদিন রাতে পুরো পরিবার একসাথে বসে খাওয়া দাওয়া করল। ঘরের বাতাসে সুখের সুবাস। রাজু বলে, “বাবা, একদিন আমিও অনেক টাকা রোজগার করব।” মতি মিয়া মৃদু হেসে বলে, “তুই যদি ভালো মানুষ হোস, তাতেই আমি খুশি।”

দিন যায়, মাস যায়। বন্যা এলে আবার চর ভেসে যায়, কাদায় ঘর ডুবে যায়, তবুও এই মানুষগুলোর হাসি ফুরায় না। নদী কেড়ে নেয় ফসল, কিন্তু কেড়ে নিতে পারে না তাদের সাহস। রহিমা প্রায়ই বলে, “আমরা অভাবে আছি, কিন্তু আমাদের মনটা অভাবে নাই। আমরা একসাথে আছি, এটাই বড় আশীর্বাদ।”

শীতের সকালে মতি মিয়া ছেঁড়া কম্বল জড়িয়ে মাঠে যায়।

কুয়াশায় ডুবে থাকে গ্রাম, ঘাসের ওপর শিশির বিন্দু ঝলমল করে। কাজের মাঝে মাঝে সে থেমে যায়, আকাশের দিকে তাকায় “হে আল্লাহ, আর একটু রিজিক দাও, যাতে এই পোলাপানগুলারে মানুষ বানাতে পারি।”

কখনও সে ভাবে, যদি একটুখানি জমি পেত, তাহলে নিজে ফসল ফলাত। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখনো স্বপ্নই। তবু সে হাল ছাড়ে না। প্রতিদিন সকাল মানে তার কাছে নতুন আশা।

একদিন হঠাৎ রহিমা অসুস্থ হলো। জ্বরে কাঁপছে, শরীর দুর্বল। ডাক্তার দেখানো দরকার, কিন্তু টাকাই নেই। মতি মিয়া গ্রামের হাটে গিয়ে এক লোকের কাছে ২০০ টাকা ধার চাইল। লোকটা বলল, “তুমি তো সৎ মানুষ, ফেরত পাবে বলেই দিচ্ছি।” সে টাকাটা নিয়ে ওষুধ কিনে এল। রাতে রহিমার গায়ে হাত রাখলÑ “তুমি সুস্থ হইলে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।” রহিমা মৃদু হাসল, “তুমি থাকলে আমি কষ্ট পাই না।”

এইভাবেই দিনগুলো কেটে যায়। অভাবের মধ্যে থেকেও মতি মিয়ার ঘরটা শান্তির ঘর। তার সন্তানরা বুঝে গেছেÑ দারিদ্র্য লজ্জার নয়, পরিশ্রমই জীবনের গৌরব।

একদিন রাজু স্কুল থেকে ফিরে বাবাকে বলল, “বাবা, আজ আমাদের ক্লাসে স্যার বলেছে, যার বাবা পরিশ্রম করে, সে-ই আসল বীর।” মতি মিয়া মৃদু হেসে বলল, “বাবা, কাজই মানুষকে বড় করে, কথায় নয়।”

চর মজলিসপুরের মাটি, নদী আর কুয়াশা মিলে গড়ে তুলেছে এমন সব মানুষ, যারা অভাবের মধ্যেও আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখে। মতি মিয়া তাদেরই একজন। তার হাতে টাকা নেই, কিন্তু আছে পরিশ্রম; ঘরে খাবার কম, কিন্তু আছে ভালোবাসা; জীবনে কষ্ট আছে, কিন্তু আছে আশার আলো।

রাতের শেষে যখন ঘুম আসে, সে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে

“আমার সংসার ছোট, কিন্তু সুখের। আল্লাহ যতটুকু দিয়েছেন, তাতে আমি ধন্য।”

এভাবেই চলতে থাকে মতি মিয়ার জীবনের চাকাÑ অভাবের সংসার, কিন্তু ভালোবাসায় পূর্ণ এক পৃথিবী।