শরীফ আবদুল গোফরান

কবি ফররুখ আহমদ নির্মল মন নিয়ে ভালোবাসেন প্রকৃতিকে। সব বিষয়ে লিখেছেন ছড়া-কবিতা। তার মন শিশুদের জন্য গভীর মায়ায় ছলকে ওঠে। ফলে শিশুদের জন্য তার হাত থেকে ঝরে পড়ে মজাদার ছড়া, কবিতা, গল্প ও নাটক।

শিশু সাহিত্য ফররুখ আহমদ আসেন পাখির বাসা নিয়ে। এই কবি বিচিত্র পাখ-পাখালির জগৎকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন। পাখির বিচিত্র প্রসঙ্গ তার শিশু সাহিত্যে ব্যাপক স্থান জুড়ে আছে। তিনি পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে যেমনি কবিতার রাজ্যে ঘুরে বেড়াতেন তেমনি ছড়া সাহিত্যে ছোটদের সাথী করে নিতে ভুল করেননি। তার পাখি বিষয়ক ছড়াগুলো পাখির জীবনে বিচিত্র প্রসঙ্গ শিশু-কিশোরদের ভাবিয়ে তুলেছে, আন্দোলিত করেছে। ফলে তিনি যেন প্রকৃতির অপার রহস্য ‘পাখির বাসা’ নিয়ে হাজির হয়েছেন ছোট্ট শিশু-কিশোরদের মাঝে। ‘পাখির বাসা’ গ্রন্থে কবি সাতরঙা কবিতা নিয়ে উপস্থিত হন ছোটদের কাছে। পাখির বাসার বর্ণনা গানে গানে রূপ লাভ করেছে। যেমনÑ

আয়গো তোরা ঝিমিয়ে পড়া দিনটাতে

পাখির বাসা খুঁজতে যাবো একসাথে

কোন বাসাটা ঝিঙে মাচায়

ফিঙে থাকে কোন বাসাটায়

কোন বাসাতে দোয়েল ফেরে

সাঁঝ রাতে।

কবির পাঁচ মিশালীতে ঝড়-বষ্টি ও ঋতু সম্পর্কীয় ছড়া বর্ণিত আছে। যেমনÑ

বৃষ্টি এলো কাশ বনে

জাগলো সাড়া ঘাস বনে

বকের ছানা কোথায়রে

লুকিয়ে গেল বাঁশ বনে।

রূপকাহিনীতে রূপকথার রাজপুত্র-রাজকন্যা, কবির চোখে শাহজাদা-সাহেবজাদী। সিতারাও শাহীন ইতিহাসের বীরপুরুষ, নেতা , সাহসী নায়ক সম্পর্কে কবিতায় বর্ণিত হয়েছে।

‘চলার গান-এ দেশ ও জাতি বিষয়ক কবিতারাজী রয়েছে। দেশ ও জাতির মান, সবুজ পতাকা, আদর্শ, সম্মুখে চলার গান ইত্যাদি এতে রয়েছে। যেমন-

শুনবো না আর পিছন টান

মানবো না আর বান তুফান

ডাকছে খুন রক্তারুন

ভবিষ্যতের পথ উজ্জ্বল

সামনে চল সামনে চল।

শিশু সাহিত্য রচনায় কবি ফররুখ আহমদের ভাষা ও শব্দের উপর আশ্চর্য দখল। ছন্দ ও শব্দ চয়নে কবির পাণ্ডিত্য ছোটদের আনন্দের খোরাক জোগায়।

তার শিক্ষাপ্রদ এসব রচনা ছোটদের ভাবিয়ে তোলে। জাগরণী গান গেয়ে শক্তি, সাহস ও বীরত্বের কথায় আন্দোলিত করেছেন ছোট শিশু-কিশোরদের মনকে। ফলে কল্পনার জগৎ বেষ্টন করে আছে তার শিশু সাহিত্য।

শিশু সাহিত্যের কবি ফররুখ আহমদের দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘হরফের ছড়া’। একটি হরফ বা অক্ষর দিয়ে এক একটি ছড়া, যার প্রতিটি শব্দ চয়ন করা হয়েছে শিশুর পরিচিত জগৎ থেকে। চিত্রধর্মী প্রতিটি ছড়ায় শিশুর চেনা জগৎ ও পারিপার্শিকতা থেকে উপাদান সংগৃহীত হয়েছে। যেমনÑ

ক-য়ের কাছে কলমিলতা

কলমিলতা কয়না কথা

কোকিল ফিঙে দূর থেকে

কলমি ফুলের রঙ দেখে।

ঝ-য়ের কাছে ঝিঙে

ঝিঙে লতা ফিঙে

ঝিঙে লতা জড়িয়ে গেলো

কালো গরুর শিঙে।

ব-য়ের কাছে বনবিড়াল

আনলো ডেকে সাত শিয়াল

বোল-বোল-বোল আমের বোল

বাদুর এসে বাজায় ঢোল।

কবি ফররুখ আহমদের শিশু সাহিত্যে প্রকাশিত তৃতীয় গ্রন্থ ‘ছড়ার আসর’ ১ম খণ্ড। আমার মনে হয়েছে কবির সৃষ্টি শিশু সাহিত্যের মধ্যে তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি এই শিশু ছড়াগুলো।

কবির ছন্দে গাঁথা অধিকাংশ রচনাই হয়েছে গান, মিষ্টি গীতি ভাবনার রূপায়ন। শব্দচয়ন, ছন্দ, লালিত্য, সঙ্গীতময়তা সকল দিক দিয়েই ফররুখ আহমদের শিশুদের জন্য রচিত ছড়া গতিময়, সমৃদ্ধ ও প্রাণচঞ্চল। তিনি কল্পনার রাজ্যে হলদি কোটার দেশে যান।

মেহেদী পাতায় হাত রাঙান। সেখানে আছে সাঁঝের পরী, সোনার কাঠি-রূপার কাঠি, জন্তু-জানোয়ার, পশু-পাখি, এসব নিয়ে শিশুদের যে চিরচেনা জগৎ সেখান থেকেই কবি তাঁর ছড়ার পাত্র-পাত্রী নির্বাচন করেছেন। যেমন-

মাঘ মাসে আবছায়া কুয়াশার পাখা

ঢেকে ফেলে আসমান কালি জুলি মাখা

ঝোলা খুলে হিম হাওয়া ছায়ে ক্ষণে ক্ষণে

রাত্তিরে কাঁপে বাঘ সুন্দর বনে।

কবি ফররুখ আহমদের চতুর্থ গ্রন্থ ‘নতুন লেখা।’ এই গ্রন্থের কবিতাগুলো পাঁচটি ভাগে বিভক্ত। নতুন লেখা, রংতামাশা, সবুজ নিশান, কিসসা সোনার সন্ধ্যা, রাসূলে খোদা। কবি এই গ্রন্থে প্রকৃতির বিচিত্র ভাবের সমারোহ ছন্দে, গানে, কল্পনায়, বাস্তবে যেমন প্রকাশ করেছেন, তেমনি দেশ-জাতি, সমাজ, ধর্ম, নীতির ব্যাখ্যাও করেছেন। ছোটদের মনোরাজ্যে দুর্নীতিকে পুণ্যময় ছবি পরিস্ফুটন করতে চেয়েছেন। অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দিয়ে কবি সত্যের সন্ধান করেছেন। ফলে আল্লাহ রাসূল ও মহাপুরুষদের মহৎ ভাবনা উৎসাহিত হয়েছে তার ছড়ায় অনেক পংক্তিতে। তাছাড়া হাসি ও কৌতুকময়তা ফররুখ আহমদের শিশু সাহিত্যের এক প্রবলতম লক্ষণ।

হক বাতিলের দ্বন্দ্বে ও ভাই

ভয় কিছু নাই, ভয় কিছু নাই

সত্য পথে সহায় খোদা

অভয় বিজয় তাঁর কাছে পাই।...

ফুল কে না ভালোবাসে। ফুলের প্রতি ছোট-বড় সবারই হৃদয়ের টান রয়েছে। তবে বড়দের তুলনায় ছোটরাই ফুলকে বেশি ভালোবাসে। কবি ফররুখ আহমদ ফুলকে অন্যদের তুলনায় একটু বেশিই ভালোবাসতেন। ফুল নিয়ে তার অনেক লেখা। এসব নিয়ে তার কাব্যগন্থ ‘ফুলের জলসা’। এতে তিনি ফুল নিয়ে হরেক রকম ছড়া লিখেছেন। যেমন-

ঝুমকো জবা বনের দুল

উঠলো ফুটে বনের ফুল

সবুজ পাতা ঘুমটা খুলে

ঝুমকো জবা হাওয়ায় দোলে

সেই দুলুনির তালে তালে

মন উড়ে যায় ডালে ডালে।

তিনি আরো লিখেন-

গুল মেহেরের ডালে রঙের আগুন লেগেছে

ঘুমন্ত সব ফুলকুঁড়িরা আবার জেগেছে।

কবি ফররুখ আহমদের শিশু সাহিত্য এতো অল্প কথায় প্রকাশ করা মোটেও সম্ভব নয়। এজন্য অনেক সময়ের প্রয়োজন। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা কবির পাখির বাসা, হরফের ছড়া, চিড়িয়াখানা, ফুলের ছড়া, সাঁঝ সকালের কিসসা, ছড়ার আসর, পোকামাকড়, খুশির ছড়া, নতুন লেখা, রংমশাল, নয়াজামাত, আমাদের শিশু সাহিত্যকে নতুন জগতের রাজপথের সন্ধান দিয়েছে। তিনি শিশু সাহিত্যের নয়া দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করেছেন।

কবি ফররুখ আহমদ বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন। কিন্তু তিনি যে আমাদের সঙ্গীত জগতেরও অন্যতম গীতিকার ছিলেন তা অনেকেই জানে না। তার সব গানই রেডিও পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা কেন্দ্র থেকে দেশের বিখ্যাত সুরকারদের দ্বারা সুরারোপিত হয়ে বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে প্রচারিত হয়েছে।

কবি ফররুখ আহমদের কর্মজীবনের দীর্ঘস্থায়ী কর্মক্ষেত্র ছিল বাংলাদেশ বেতার। তিনিন ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে প্রথম অনিয়মিত ও পরে নিয়মিত রেডিও পাকিস্তান ঢাকা এবং ১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হলে রেডিওর নিজস্ব শিল্পী হিসেবে আমৃত্যু নিয়োজিত ছিলেন। পেশাগত জীবনে রেডিওতে কাজ করার সুবাদে তিনি প্রচুর গান রচনা করেছিলেন। কবির লেখা বিশেষ বিশেষ কিছু গানের কথা আমি বলবো। তিনি ছোটদের জন্য তীতুমীরের উপর গান লিখেছিলেনÑ

দেশ-বিদেশের ভাই-বোনেরা শোন্

শোন্ কান পেতে আজ ধীর,

জেহাদ হবে এই আশাতে

বাঁশের কেল্লা গড়েন তীতুমীর।

নাইরে সময়, সময় যে আর নাই

আয়রে সবাই বুক বেঁধে দাঁড়াই।

কবি ফররুখ আহমদ ছোটদের উপদেশ দিয়ে নানা ধরনের গান লিখেছেন, যে গান গাইলে সবার মন আনন্দে নেচে ওঠে। জাগরণের সৃষ্টি হয়।

তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে

খোদার মদদ ছাড়া

তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে

নিজের পায়ে দাঁড়া।

পরের উপর ভরসা করে খয়ের

পথে যাসনে মরে

তোরা ভয়ের পথে যা বাজিয়ে

জয়ের নাকাড়া।

খোদার মদদ পেয়ে যারা

হলো জাহান জয়ী

তারা মাড়িয়ে গেলো মৃত্যুদুয়ার

রাত্রি তিমিরময়ী।

কবি ফররুখ আহমদ এমন মানুষই চেয়েছিলেন। যেসব মানুষ পেলে তিনি শান্তি রাজ্য গড়তে পারবেন। যে রাজ্যে মানুষ মানুষে কোনো তফাৎ থাকবে না। সত্যের নিশান পত পত করে উড়বে হাওয়ায়। সবুজ সবুজ স্বপ্নেরা খেলা করবে মানুষের মনের রাজ্যে। সেখানে বইবে শান্তির অনাবিল স্রোত। তাইতো তিনি আল্লাহর কাছেই সাহায্য চান। যেমন-

আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে

নোয়াই না শির সামনে পাছে

খোদার অভয় ঘিরে আছে

বিঘ্ন বিপদ করলো তাড়া।