রক্তাক্ত স্বদেশ

সাজ্জাদ বিপ্লব

আমার মতো একদিন ঘুরে দাঁড়াবে-

রক্তাক্ত স্বদেশ

তার পীঠে তখনো লালজবার মতো ঘা থাকবে

হাতে হয়তো অদৃশ্য হাতকড়া

সামনে তাক করা অজস্র ফ্যাসিবাদী রাইফেল

কণ্ঠনালীর উপর প্রভুদের পা

তবু, মরতে গিয়ে একদিন ঠিক দাঁড়িয়ে যাবে

খাঁড়া আলিফের মতো

যেমন আমি দাঁড়িয়ে আছি, হিম্মত নিয়ে,

স্বৈরাচার পিরামিডের সামনে।

হ্যাশট্যাগের যুগে কবিতা

তোরাব আল হাবীব

পাঠকের কবিতা পড়ার সময় কই আজকাল?

চোখ চায় স্ক্রল, আঙুল খোঁজে রিলÑ

একদিন হয়তো আর কবিতা লিখবো না,

লিখে ফেলবো কেবল হ্যাশট্যাগÑ

#ভালোবাসা #বেদনা #নৈঃশব্দ্য।

ছন্দের অতলে ডুবতে চায় না কেউ,

আলোর বন্যায় চোখ ধাঁধায়, অন্তর্দৃষ্টি শুকায়।

কবিতা পড়তে লাগে ধৈর্যর প্রশিক্ষণÑ

সে পাঠ তো এখন বিলুপ্তপ্রায়!

কবিতা খেয়ে মানুষ বাঁচে নাÑ

তাই তাকে ঠেলে দেওয়া হয় বিজ্ঞাপন-বোঝাই দেয়ালে।

অন্তরস্পর্শী পঙ্ক্তি আজ পাঠচ্যুত,

চোখ চায় ফিল্টার, মন চায় ফ্ল্যাশÑ

অনুভূতির বদলে ভাইরালই এখন ব্যাকরণ।

আবার বিপ্লব

হাসনাইন ইকবাল

পাঁচ আগস্টের মতো

একদিন বেরিয়ে পড়বো আবার!

বিদায় নিয়ে

বিদায় দিয়ে

এক অনিশ্চিত লক্ষ্যপানে!

যেভাবে পাখিরা বেরিয়ে পড়ে-

শিকার হবার সমূহ সম্ভাবনা মাথায় নিয়ে

যেভাবে মাছেরা নানাবিধ শঙ্কায় ফেরে

জলের অতলে- শিকারী কুমির ও জেলেদের

নানাবিধ ফাঁদ জেনে না জেনে,

সেভাবেই আবার বেরিয়ে পড়বো-

জনাকীর্ণ এই নির্জনে!

আমার নিরস্ত্র হাতই হাতিয়ার হবে-

নখ ও নখড়ে গেঁথে নেবো-

কিছু বিষবাহী সচতুর জানোয়ার-দেহ!

ছত্রিশ জুলাইয়ের মতো

আবার বেরিয়ে পড়বো একদিন- সকালের নাস্তার বাসন ফেলে,

পেছনে রেখে যাবো শিশুদের কান্নার আর্তনাদ!

রেখে যাবো প্রিয়তমা স্ত্রীর সজল চোখের হাহাকার!

বয়োঃবৃদ্ধ পিতা দোদুল্যমান সিদ্ধান্তে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকবেন,

মা ইশরাক নামাজের সিজদায় কেঁপে কেঁপে উঠবেন-

ঝড়ে পড়া বাঁশপাতাটির মতো!

আমি বেরিয়ে পড়বো জুলাইয়ের দিনগুলোর মতো-

ফেরা না ফেরার এক অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়ে!

রক্তেস্নাত রাজপথে শেয়ালের হুক্কাহুয়া,

পুলিশের গুলীতে অক্ষিগোলক ছিটকে পড়া

কোটরের শূন্য গহ্বরে ক্রমাগত ঠোকর দিচ্ছে শকুনের পাল!

বিপ্লবের পত্র-পল্লব ছিঁড়ে কারা যেন চড়ুইভাতি খাচ্ছে-

লেফট রাইট শব্দে আমার উঠোনে ঠিকই ধূলিঝড় ওঠে,

অথচ কম্পন ওঠে না পরাজিতের হৃদয়ে!

আবার বেরিয়ে পড়বো-

সড়কের দুইপাশ থেকে জনতার স্রোত এসে মিলিত হবে মিছিলে

নির্মাণাধীন ভবনের শ্রমিকরা নির্মাণ সামগ্রীর বাঁশ এগিয়ে দেবে

বর্গী তাড়ানোর লক্ষ্যে

রিকশা ও ভ্যানের চালকরা লাকড়ির গজারি কাঠ নিয়ে আসবে,

তারপর বিলি করবে হাতে হাতে,

সড়কের দুইপাশের ভবন থেকে নারীরা এগিয়ে দেবে পানি!

আমাদের জনস্রোত দেখে পরাজিত নেড়ি কুত্তার মতো

পালিয়ে যাবে নবাগত তস্কর ও তক্ষকের বাহিনী!

আবার বেরিয়ে পড়বো-

আগস্ট বিপ্লবের মতো একাকী!

পথে যেতে যেতে সহচর নেবো খুঁজে,

আমাদের পদশব্দে খুনীরা পালায়-

চোরেরা গর্তে লুকায়!

যুদ্ধ-মৃত্যু-যুদ্ধ

হৃদয় পান্ডে

যুদ্ধ শেষ হয় না।

শুধু মৃতদেহ বদলায়, পটভূমি পাল্টায়,

অস্ত্রের ধরন আধুনিক হয়।

একটা মৃত্যু থেকে আরেকটা যুদ্ধের জন্ম হয়,

আর প্রতিটি যুদ্ধ আবার নতুন কিছু মৃত্যুর প্রতিশ্রুতি।

শিশুরা বড় হয় যুদ্ধের গল্প শুনে,

তারপর অস্ত্র তুলে নেয়

বেঁচে থাকার জন্য বা মরার জন্য।

মৃত্যুরা জমা হয় রাষ্ট্রের পুরস্কার ঘরে,

আর যুদ্ধ ফিরে আসে, ধীরে, নিঃশব্দে, নতুন নামে।

পুনরাবৃত্তি চলে,

যুদ্ধ-মৃত্যু-যুদ্ধ

এই তিন শব্দই ইতিহাসের আসল ব্যাকরণ।

১৯ জুলাই

শওকত এয়াকুব

দেশের কোথাও শান্তি নেই।

রক্তের দাগ লেগেছে ষোলশহর রেলস্টেশন,দুই নাম্বার গেইট,

মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, নিউমার্কেট মোড়ে।

সারাদিন রাস্তায় টহল দিচ্ছে পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী।

সারাদেশে কারফিউ চলমান-

কিছুক্ষণ পরপর সাঁজোয়া জানের শব্দ শোনা যায় রাস্তায়।

মহাসড়কের পাশের দোকানপাট বন্ধ,

গলির দোকানগুলোর সাটার অর্ধেক বন্ধ।

সন্ধ্যা নামলে ভূতুড়ে নগরীতে পরিণত হয় সমস্ত শহর।

গুলীর শব্দে উধাও শহুরে কুকুর,

আশরাফুল মাখলুকাতের মৃত্যুতে

শহরের সমস্ত পাখি মূর্ছা যাচ্ছে।

কার্নিভাল

বশির আহমেদ

আমি আজ কোথাও নেই, থাকার কথাও ছিল না,

তাইতো পুনরায় নিজেকে পড়ছি শিখছি।

ফ্রাইডে এলে আনন্দ জমে,

খবরের পাতায় গেঁথে দেয় সুখের ঘ্রাণ।

নিজেকে ভেঙে চুরে প্রতিবার সাজাই সাজাতে হয়,

কলুইক্ষেতে ডুবে যায় আনন্দ বিকেল।

এলোমেলো বর্ষা বানে বিপর্যস্ত পূর্ণদৈর্ঘ্য জীবন,

কার্নিভালে দেখার মিনতি জানাই মৃত্যুর উপত্যকায়

বেঁচে থাকা অনাহারি মুখ।

বৃত্তবন্দি জীবন

নবী হোসেন নবীন

বৃত্ত যত বড়ই হোক

সে তার ব্যাসার্ধের কাছে ঋণী

বৃত্তের ব্যাসার্ধ চেনেন যিনি

বৃত্তের বৃত্তান্ত বোঝেন তিনি।

জীবনও বৃত্তের মতো

দায়ীত্বের ব্যাসার্ধ দ্বারা বন্দি

দায়ীত্বের সাথে যে করেছে জীবনের সন্ধি

সে জানে জীবনের পরিসর কত বৃহত্তর।

দায়ীত্বের সীমানা ছেড়ে

যে জীবন চলে যায় দূরে

সে এক ভবঘুরে।

দায়ীত্বের ব্যাসার্ধ জানে যে জীবন

মহাশূন্যও তার কাছে বৃত্তের মতন।

হে যুবক

সাগর আহমেদ

হে যুবক, তুমি প্রেমের রূপালী বসন্তে

চৌকস রাজপথে একা একা কেনো হাটো?

কেনোই বা আগ্রার মর্মর পাথরের তাজমহলের

নিঃসঙ্গ দেয়ালে রক্তাক্ত বিরহের পোস্টার সাঁটো।

চেয়ে দেখো প্রেমময় দখিনা হাওয়ায়

দুলে ওঠে হলুদিয়া করবি ফুল,

তথাপি তুমি থাকবে নিঃসঙ্গ মরুচারী

তথাপি করবে ভুল?

ঐ দেখো সোনালী রৌদ্রের ঝলমলে মানচিত্রে

উড়ে যায় প্রেমের রঙিন বেলুন,

আজ তাই মাতাও উল্লাসে

প্রেমের বুদবুদে টগবগে দুরন্ত খুন।

নেচে ওঠে না

আবুল কালাম তালুকদার

নিরানন্দ চোখে নেমে এসেছে অন্ধকার

ভাঙনের ব্যথায় কাঁদছে হৃদয়

হলুদ বিকেলে সুখ নেই বলে সু-স্বপ্নে আসে না রাত

চোখে দেখা পৃথিবী সুখে নেই বলে

নোনা জলে ভরে ওঠে চোখের জমিন

ভোরের টবে নিয়মের ফুল ফোটে না বলে

প্রজাপতির পাখায় ওড়ে না রঙিন স্বপ্ন।

অসহায়ের আর্তনাদে মানুষ কেঁদে ওঠে বলে

কষ্টের জানালা ভেদ কানে ভেসে আসে

শোকাহত পাখির দুঃখ গান

বুকের পাঁজর ছিঁড়ে দুঃখ বেরিয়ে আসে বলে

পেখম মেলে নেচে ওঠে না আনন্দ ময়ূর।

দর্জি

মতিউর রহমান

আমার দাদু দর্জি ছিলেন

দাদুর মতো আমার বাবাও

সারা জীবন জামাকাপড় সেলাই করে গেছেন

বাবার জীবনে জীবনভর শুধু দুঃখ কষ্ট

মেঘ পাতার ফাঁকে চাঁদের হাসি দেখিনি

তারপর বাবা হঠাৎই একদিন চলে গেলে

নিয়তির উঠোনে ঘনায় আঁধার

বাবার মতো আমিও দিনরাত

দুঃখ সেলাই করে যাই!