দ্বিধা
সোলায়মান আহসান
বিউগলের শব্দ শুনি শুধু আজ
আমার অস্তিত্ব জুড়ে, সারাক্ষণ দিনরাত
চলে যুদ্ধের মহড়া, আয়োজন;
আমার চোখে, মুখে ভীরুতার যে বিনয় ছিলো
ভাষায় যে আমন্ত্রণের উদারতা ছিলো
ইশারায় নতজানু প্রণয় ও প্রেম ছিলো
তা এখন সম্পূর্ণ অন্তর্হিত
কী এক বেদনা, কী এক চিত্তবিভ্রাটমনস্কতা
আমাকে উন্মন ব্যাকুল করে তুলছে
আমাকে বেপরোয়া আত্মবিনাশী করে তুলছে, নিয়ত
আমাকে মন্থন করছে সামুদ্রিক উচ্ছ্বলতায় বারংবার;
ঘুমে কিংবা জাগরণে
অষ্টপ্রহর শুনি অস্তিত্বের সমর সজ্জা
তপ্ত বিউগলের ধ্বনি
শুনি দূরাগত রণতরীর নোঙ্গর ছাড়ার সিটি ধ্বনি
কী করে পালাই তবে আমি
ফুলশয্যার আমন্ত্রণ রেখে?
কবিতার কল্পকথা
তুহীন বিশ্বাস
একটি কবিতা হতে পারে...
ভালোবাসার গল্প কিংবা সহস্র পৃষ্ঠার উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি,
হতে পারে আকাশ আর মাটির মেলবন্ধনের হাতিয়ার
কষ্ট কিংবা নষ্টের বিরুদ্ধে লড়তে শেখার মূলমন্ত্র ;
আবার একটি শব্দ ধ্বংসযজ্ঞের কারণ হয়ে যেতে পারে নিমিষেই।
কবিতার আঁচলে বন্দী হতে পারে পৃথিবীর সকল মায়া-মমতা
ভুলিয়ে দিতে পারে হারানো দিনের যন্ত্রণা মিশ্রিত ডায়েরির গল্প,
শব্দের শিকলে বাঁধা পড়তে পারে সম্পর্কের সুখের মুহূর্তগুলো ;
অথবা জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে স্বপ্নে গড়া প্রাসাদ।
হয়তো তুমি-ই আমার কবিতার কল্পকথা হয়ে গেছো নীরব ছায়ায়
মনের আগুনে পুড়িয়ে দিতে, নয়তো শান্তির ডালার মায়ায়।
করজোড়ে দাঁড়িয়ে থেকে
মোহাম্মদ ইসমাইল
চোখে চোখ রেখে এতো স্পর্ধা দেখাও কেন?
বিনয়ের সৌন্দর্য নিয়ে নিজেকে অপ্রকাশিত রাখতে যেন
মানুষের সেই শ্রেয়তর সুন্দরের জন্ম!
আদর্শিক শক্তির কাছে পেশিশক্তি সবসময়ই নগণ্য।
বিনীত করজোড়ে দাঁড়িয়ে থেকে-
বন্ধু তোমার স্নেহধন্য ঐ বুকে
মানুষের মনুষ্যত্বকে তাই আজীবন
করতে চাই শুধু ধারণ!
তুলনা
আবুল খায়ের বুলবুল
বাতাসের ঝিরঝির ছোঁয়ায় জানি ভোরের শিশির ঝরে,
বাধা আর ব্যারিকেডে কিন্তু সাহস হারায় না বীর,
শিশির দুর্বল বলে বাতাসের ত্রাসে ঝরে
বীরের সাহস সীমাহীন বলে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে
মিথ্যার মিষ্টি প্রলোভনে হারায় না নিজেকে
পাখিরা নীড় হারা হলে গাছ ছেড়ে চলে যায়
বীরেরা গৃহহারা হলেও নির্ঘুম থাকে
অধিকার স্বাধিকার আদায়ে তারা অনড় থাকে
নিদ্রা ক্ষুধাও তাদের অগ্রযাত্রা থামাতে পারে না
ফুল স্বেচ্ছায় যেমন সুবাস বিলায়
আবার মৌমাছিকেও সে মধু নিতে বারণ করে না
বীরেরাও ঠিক তাই,
নিন্দা অপবাদে ওরা নুয়ে পড়ে না,
ওরা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে লক্ষে পৌঁছোয়
ফুল পাখি শিশির মানুষকে আনন্দ দিলেও
জীবন ও জাতি বিনির্মাণে
শার্দূল মানুষ বীরের সাথে কারো তুলনা হয় না।
একটি মৃত ফড়িং এবং আমি
মান্নান নূর
সেদিন ঠিক দুপুর। বৈশাখের কাঠফাটা রোদ্দুরে দেখলাম-
একটা ফড়িং আরেকটা ফড়িংকে হত্যা করছে। কী নির্মম!
মাথাটা নিয়ে উড়ে গেল। এর আগে এরকম নির্মমতা
আমি দেখিনি কোনোদিন। প্রথমে ভেবেছিলাম খেলা করছে,
কিন্তু না; আশ্চর্য যে, প্রথমে মুন্ডুটা আলাদা করে দেহটাকে
গাছের পাতায় আটকে রেখেছে। সে ফড়িং এর আর্তচিৎকারে
কী ছিলো আমি জানি না। তার প্রতিবাদের ভাষা কী ছিল
তাও আমার জানা নেই। তার অন্তিম মুহূর্তে হৃদয় উৎকলিত কোন কথাটা
বের হয়ে আসতে চাচ্ছিল তাও আমি বুঝতে পারিনি।
কতটা ঘৃণা ছুঁড়ে দিয়েছিল নির্দয় ঘাতক সীমার ফড়িংকে
তাও জানি না। জানি কেবল এ ফড়িং-এর মতো
আমাকেও হত্যা করছো তুমি প্রতিদিন-প্রতিনিয়ত,
বারংবার তিলে-তিলে হে ঘাতক জাসরিয়া।
মৃত্যুর রজ্জুকে বারবার আটকে দিচ্ছো গলায় এবং পাঁজরে
আমারও ফড়িং এর মতো স্পষ্ট কোনো ভাষা নেই
আর্তচিৎকার আছে অথচ সমস্ত শক্তি একত্রিত করেও বলতে পারছি না
আমাকে মেরো না, পানিবিহীন মাছের কাতরানি আছে
তবুও প্রতিবাদের কোনো ভাষা নেই, স্বপ্নের মতো চিৎকারের নৈঃশব্দ্য আছে
উদ্বারের কোনো রাস্তা নেই, কেবল অনুক্ত ভাষা
না প্রতিবাদ, না প্রতিহত। দেখো ফড়িং এর মতো তুমিও কতটা নির্দয়।
আমাকে ভালো না বাসো, ফিরে না আসো,
এ ভাবে হত্যা করার চেয়ে একেবারে মেরে ফেললেই তো আমি বেঁচে যাই!
কিন্তু না; মৃত ফড়িংটার দেহ পাতায় ঝুলে আছে,
আর আমি, ধুকধুকে প্রাণ নিয়ে দেহের খোলসে ঝুলছি।
শূন্যতার অন্তরালে
মুহাম্মদ রফিক ইসলাম
কালবৈশাখী ঝড়ের মতো ধেয়ে আসছে
যেন ভাঙনের প্রলয়
মাথার উপর থেকে যেন ভেঙে যাচ্ছে আকাশ
ছায়াটুকু গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে লুটিয়ে পড়ছে
নিস্তব্ধ বুকের আনাচে-কানাচে
পায়ের নিচ থেকে যেন সরে যাচ্ছে মাটি
দিব্যি দেবে যাচ্ছি
শূন্য থেকে শূন্যতার দিকে...
বাবা, আপনাকে হারানোর মধ্যদিয়েই
বুঝতে শিখি
শূন্যস্থানে শূন্যতা ছাড়া আর কিছু নেই।
মৃত্যুর আগে
আহাম্মদ উল্লাহ
মরে গেলে দেখা হবে না বহুদিন
বহুদিন কথা হবে না,
মানুষ তুমি হেঁটে যাবে আমার পাশ দিয়ে
কিংবা আমি।
জৈবসারে গজাবে তরুলতা, ঘাসফুল
ঢেকে দিবে আমার কিংবা তোমার হৃদয়।
খবর নাও,মানুষ ;
পাশে শুয়ে আছে মৃত,
টাঙানো সাইনবোর্ডের মতোন জীবন যান্ত্রিক।
তৃষ্ণার জল হও, কালো পানকৌড়ির মতোন
ডুবে-ভিজে-মিশে যাও, হৃদয়ের ভিতর।
বলো, “আছি।”
মরে গেলে দেখা হবে না বহুদিন
বহুদিন পর দেখা হবে সমতল মাঠে,
হাশরের হিসেব-নিকেশে।
বৃষ্টি ছোঁয়া
স্বর্ণা তালুকদার
সুপ্ত মেঘ বৃষ্টির কামনার দহনে
পিপাসা নোঙর ফেলে গহীনে
শ্বাসরুদ্ধকর উষ্ণ বায়ুর আঁখিতে
নদীতে উঠা জোয়ার ভাটাতে
স্রোতধারা নিক্কন বাজে জলে,
প্রজাপতির মনন সুরভি ফুলে
বৃষ্টি প্রেম বিলাসি রজনীতে
জোসনা আলো মাখে গায়ে
আষাঢ় শ্রাবণ ঋতু বদলে
পাখিরা গায় সুকন্ঠে কলরোলে।