চব্বিশে নতুন মন্ত্রবীজঃ স্বাধীনতা পরম্পরা

হাসান হাফিজ

‘স্বাধীনতা’ শব্দটি সর্বদা লিখিত হয়

রক্ত আর অগ্নির দহনে

ভাঙচুর তছনছ ল-ভ- করতে হয় কত কিছু

দ্রোহে ও স্বননে

তার ক্ষুধা সর্বগ্রাসীÑত্যাগ চায় ক্ষোভের ধোঁয়ায়

এত মূল্য এত বেশি ঋণ

মুক্তি ও পতাকা ওড়ে তেজি দৃপ্ত সাহসী হাওয়ায়

শূন্য হয় অগণন জননীর মমতাজড়ানো কোল-বুক

স্বাধীনতা তোমার পিপাসা

এত রক্ত দাবি করো,তারপর জয়ধ্বজা ঊর্ধে¦ তুলে ধরো

অগ্নিপরীক্ষায় পুড়ে পূরণ প্রত্যাশা।

‘স্বাধীনতা’ সেই কবে বাহান্নের রক্তসিঁড়ি পার হয়ে

বাষট্টি ছেষট্টি এলো ঊনসত্তর একাত্তর

ইস্পাতকঠিন যুদ্ধে প্রকম্পিত হলো গোটা বাংলা জনপদ

সে ছিল ধ্বংস ও মৃত্যু প্রলয়ের মহাঝড়

তারপর স্বাধীনতা সূর্যোদয়, স্বপ্নভঙ্গ দুর্ভিক্ষের থাবা

গণতন্ত্র উধাও বিলীন

পার হয়ে চড়াই উতরাই বাধা কালো স্বৈরাচার

ফুটে উঠলো নব্বইয়ের দ্রোহতপ্ত দিন

তারপরও আবার নতুন করে স্বৈরাচারী দৈত্য-

জেঁকে বসলো অনড় পাথর

জগদ্দল সেই হিং¯্র দানব হঠাতে ফের সর্বপ্লাবী অভ্যুত্থান

জনতা ও রাজপথ জ্বলন্ত জাগর

এভাবে চব্বিশ এলো সঙ্গে নিয়ে নতুনের স্বপ্ন মন্ত্রবীজ

চাই দৃঢ় ঐক্য ও সংহতি

হয়তো আরো দ্রোহ যুদ্ধ প্রয়োজন হতে পারে, হোক, তৈরি আছি

কাম্য নয় অন্ধকার আরো মৃত্যু লাঞ্ছনা দুর্গতি,

ঐক্যসুতো মালা গাঁথবে নানা মত নানা চিন্তা পথের সন্ধান

স্বাধীনতা সমুজ্জ্বল আকাক্সক্ষা সে আকাশের উদারতা দীপ্র ও মহান॥

ভেঙে পড়ো না হৃদয়

মোশাররফ হোসেন খান

ভেঙে পড়ো না হৃদয়।

দেখো, শরতের পাতা ঝরা শেষে পুনরায়

ডালে ডালে নতুন পাতার সবুজ আভাস।

রাতের পাখিরা জেগে গেছে

একটু পরেই কন্ঠে তুলে নেবে গান ঊষার প্রথম প্রহরে।

ক্লান্ত কৃষক---

ফসল ঘরে এলে সেও ভাটিয়ালি সুরের টানে উদ্বেল হয়ে উঠবে।

শীতের শুষ্ক মৌসুমে সকল জলাশয় শুকিয়ে যায়,

সামনেই শ্রাবণ---

কানায় কানায় আবারো ভরে উঠবে

সকল পুকুর খাল বিল নদী নালা।

বিশাল সমুদ্র---

তবুও সে মেটাতে পারে না জলতৃষ্ণা।

তৃষ্ণাতুরকে ফিরে আসতেই হয় সুস্বাদু পানির কাছে।

বসন্তকে থামাতে পারে না কেউ।

এভাবেই ফিরে আসবে প্রশান্তির প্রশস্ততা।

ভরাট গোলার মত ভরে উঠবে স্বর্ণ-হৃদয়।

থোকা থোকা বেদনারা লুকিয়ে যাবে দুধ ভরা সোনালী ধানের ভিড়ে।

ভেঙে পড়ো না হৃদয়---

প্রত্যুষের প্রাতস্বরে তুমিও অভিষিক্ত হবে

জোয়ার উথলে ওঠা কপোতাক্ষর মতো।

ভেঙে পোড়ো না হৃদয়---

বসন্ত আসবে!

পরিচয়

সায়ীদ আবুবকর

আমার কোথাও যাওয়ার নেই। আমি এইখানে পড়ে আছি

বট-পাকুড়ের নিচে, হিজলছায়ায়, বঙ্গ-উপসাগরের পাড়ে

কত কাল মহাকাল। নুহের নগর থেকে আমি আসিয়াছি;

আমার শরীরে হ্যামের শোণিতধারা। আমার অস্থিতে-হাড়ে

তাঁর পুত্র হিন্দের উজ্জ্বল উপস্থিতি, যাঁহার ঔরশে ছিলো বঙ।

পিতা বঙ থেকে আমি এই বঙ্গে, বয়ে যাই তাঁরই উত্তরাধিকার।

আমার কোথাও যাওয়ার নেই। পাখি আর আকাশের নানা রঙ

দেখে দেখে আমার দিবস কাটে। কিভাবে হরিণ বাঘের শিকার

হয় বনে-আমি তাও দেখি। কখনো আনন্দে হাসি, কখনো বা

কষ্টে শ্রাবণের মতো আমি কাঁদি। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে

তাজিং ডনের মতো থাকি আমি অবিচল- যেন জন্ম বোবা;

হঠাৎ দুঠোঁটে ফোটে খই, একতারা বেজে ওঠে বাউল এ হাতে।

কোথাও আমার যাওয়ার নেই। আমি এইখানে পড়ে আছি

বঙ্গ-উপসাগরের পাড়ে, সভ্যতার প্রায় সমান বয়সী,

প্রথম মানুষ এ দ্বীপের; নুহের নগর থেকে আমি আসিয়াছি।

সকালের সূর্য আমার কুশল পুছে, জানায় শুভেচ্ছা আমাকে রাতের শশী।

ইদানিং তিমির

এ কে আজাদ

ইদানিং সভ্যতার শরীরে বড় অসহনীয়

পশুদের বেপরোয়া উৎপাত,

হিংস্র নখর খুবলে খায় মানুষের সম্ভ্রম,

এখানে নেই কোন মানুষের বিবেকের ওম,

কেবলি ওত পেতে থাকা শিয়ালের উল্লাস।

অনুর্বর শুষ্ক অণূঢ়া ভূমির বুকে দস্যু হালুয়া

চালায় উৎপীড়কের লাঙ্গল,

ক্ষত বিক্ষত হয় পবিত্র মাটির শরীর,

এর চেয়ে বড় অমানবিক নিষ্ঠুরতার

নিকৃষ্টতম উপমান কী হতে পারে আর!

তবুও কারও হয় না বিবেকের দংশন!

স্বার্থের লোলুপ জিহ্বা চেয়ে থাকে উন্মুখ,

লোভের ইঁদুর সারাক্ষণ কাটে বাংলার মুখ,

স্বাধিকার বিকিয়ে মসনদ কিনতে মরিয়া

মীর জাফরের নগ্ন নাতি নাতনীরা,

আর পেছনে ভয়ংকর দাঁত খিঁচিয়ে

মানুষের রক্ত খেতে চায় অগ্নিমুখো পেতœীরা।

মাথার ওপরে চেয়ে দেখি- শকুনেরা করে উৎসব,

দিবস-রজনী ঘিরে হেসে ওঠে ভয়ংকর ভূত সব,

চারপাশে নাগিনীরা ফণা তুলে করে হিস হিস,

মানুষের লোকালয়ে ধেয়ে আসে গোখরার বিষ,

কেবলি গোরখোদকেরা অনবরত খুঁড়ে চলে

আমাদের সুখের বদ্বীপ,

এখানে তিমির নেমে আসে দশদিক হতে,

খুঁজে পাই না কোন আশার প্রদীপ।

স্বাধীনতা সুন্দরের তপস্যা

মোহাম্মদ ইসমাইল

স্বাধীনতা সে-তো মূলত এ-ই পথে থাকে

যে- পথে কিনা আমার সাদাসিধে একটা সরল জীবন

আর একটা পরাবাস্তববাদী সুন্দর কল্পনাপ্রবণ মন

সবসময় মানুষের সাথে নিজের কথা বলার অধিকার রাখে!

স্বাধীনতা আমার কাছে তা-ই

স্বাধীন ভাবে চলতে থাকা একটা নদীর রূপকথা

যে রূপকথা মানে না কারোর কোন কোনো পরাধীনতা

স্বাধীনতা বস্তুত সব সুন্দরের তপস্যা,

যে-সুন্দরে আদতে কোনো মলিনতা নাই!

হরিণাক্ষী

শফিকুল মুহাম্মদ ইসলাম

ওই মায়াবী চোখ দুটি তার নিখুঁত সরলরেখা;

হারিয়ে যায় দিশা আমার আজও হলে দেখা!

মুখ যেন তার চন্দ্রাবতী উসখুসালো চুল গো;

তার হাসিতে ঝরে পড়ে ফুল বাগানের ফুল গো!

আলতা রাঙা দুটি পায়ে নূপুর পরে চলতো;

কলসী কাঁখে নদীর ঘাটে কত কথা বলতো!

চিরকুটে লিখতো যখন থাকতো আশায় মনটা;

স্কুলে গেলে বাজবে কখন দ্রুত ছুটির ঘণ্টা!

অপেক্ষাতে গুনতো প্রহর বটতলারই ছায়ে,

বন বাদাড়ে ঘুরতাম দু’জন শাপলা বিলেও নায়ে।

চাদনী পসর রাতে যখন শুনতে প্রেমের বাঁশি;

কে গো বাজায় ব্যাকুল সুরে দেখতে তুমি আসি!

কথা ছিলো তারে নিয়ে থাকবো জীবন মরণ;

সেসব কথা হঠাৎ করেই আবার হলো স্মরণ!

সেই যে আমার সুখের পরশ মন-মাজারে থাকে;

অষ্টপ্রহর যার চেতনায় ব্যাকুল করে রাখে।

আশা কেবল গুড়েবালি কই বাসনার রাণী;

পারবে কি কেউ দিতে তারে আমার কাছে আনি!

তার মতো আর হয় না কেহ দরদভরা মেয়ে;

সবকিছু আজ ভুলে গেলেও দেখি তারে চেয়ে।

মেটে না তৃষ্ণা

গাজী গিয়াস উদ্দিন

চোখ বুঁজলে আনন্দ ঢেউ খেলে

কোলাহলে জাগ্রত তরঙ্গ - ভেবো না বিষাদ

চৈতন্যে মিহি কন্ঠে অচিন পাখি

তুমি সুর তোলো- ঝড় তোলো

কোন্ অদৃশ্য বীণা বাজে তন্ত্রীতে!

পরাধীন মানুষ স্বভাবে ভাষাদাস

রচিত ভাবউর্মিতে হারানো মানিক

ঢোঁঢে এ মুসাফির.......

বর্ষার খালবিল বাদলধারা

বর্জ্য ছেড়ে পাখি ওড়ে

কোন্ সুদূরে

বাতাস মাটিতে বয় না কেন- জানি না

কেন আসমানের মেঘমালা ছাড়া

মহাসমুদ্রের মেটে না তৃষ্ণা......

সূর্যাস্ত; নূপুরের ঘ্রাণ

মুহাম্মদ রফিক ইসলাম

বিকেলের মায়া গোপন থাকে

ইচ্ছে ভাসে জলের ভেতর

সূর্য ডোবে

স্নান শেষে উঠে আসে গোধূলি

আদর জড়ানো সন্ধ্যার পিদিমে

শ্যামবর্ণ ছায়া নিয়ে হেঁটে যায় রাত

পাহাড়ি ঢালে লুকায় নক্ষত্রের ছায়া

ছোপ ছোপ স্মৃতির ভাঁজে নৈঃশব্দ্যের শব্দ শুনি

সূর্য যেদিকে ডোবে সেদিকে নূপুরের ঘ্রাণ..