কালের এলিজি

মহিবুর রহিম

যন্ত্রের দিগি¦জয়ে ওড়ে ধুলো, সভ্যতা, ইতিহাসের পাতা

মানুষ বিপন্ন হয়ে ভরে ওঠে বাতাসের অণু

স্যাটেলাইট ক্লান্ত হয়, ভারি হয়ে ওঠে ইথার যন্ত্রণা

শোকের দারুণ তাপে মেঘ আরো গূঢ় কালো রূপে

পূঞ্জীভূত হতে থাকে পৃথিবীর মর্মাহত দুই গোলার্ধে

সব বিদ্যার দৌড় শেষ বিধ্বংসী যন্ত্রের ক্ষমতায়!

লোলচর্ম পাণ্ডিত্যের নগ্নদেহে সময়ের থুথু

সব নীতি প্রোপাগাণ্ডা প্রপঞ্চ প্রচার নিয়ামক

এমন কি প্রগতির ইস্পাতও ঢুকে পড়েছে যন্ত্রের পেটে

ধসে পড়ছে সব মনুমেন্ট, আশার প্রতীক

হাজারো ক্ষেপণাস্ত্র তাক করা এখন একটা হৃদয়ের দিকে ॥

হতাশার সূর্য ডুবে যাক

এম সোলায়মান জয়

হতাশার সূর্য ডুবে যাক

প্রত্যয়ের প্রত্যাবর্তন হোক প্রত্যাশার পুনর্বাসনে

আকাক্সক্ষায় আলোকিত হোক আশার আলো

কষ্ট কেটে কিরণের কর্ণপাত হোক কাক্সিক্ষত করিডোরে

পাল্টে যাক পথিকের পথ পাথরে পিচলে পড়ার পালা

দিনের দহনে দাঁড়িয়ে খুলে দিক দক্ষতার দারুণ দ্বার

ধুমকেতু ধরা ধ্বংসস্তুপে উন্মোচিত হোক ধরিত্রীর দর্শনেন্দ্রিয়

যন্ত্রণায় যাপিত জীবনের জাঁতাকল ডুবে যাক জলাশয়ে

হাসির হাতুড়ির হাতে হতাশার হোক হতাশাজনক হার

মনের মাধুরি মিশিয়ে মিলে যাক মায়াবী মায়ার মানুষ

জোছনার সৌরভে গৌরবিত হোক আগামীর আমিদের।

নিরবতার নান্দীপাঠ

আলাউদ্দিন কবির

এই যে আমরা কথা জমা রাখি

কানের কাছে, চোখের কাছে

রাতের কাছে, দিনের কাছে

কথা কি আসলে জমা থাকে সত্যি?

কথাও কি খরচ হয় না, কুপথে খরচ?

কথাও কি বিস্মৃত হয় না কথার গরজ?

কথা জমানোয় কী এমন লাভ?

নিরবতার সুন্দরতা আবিষ্কারের পর

কথার তরে হা-হুতাশ নয় কি বোকামি?

বারুদ জলের গভীরে

জসীম উদ্দীন মুহম্মদ

বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আজ বুলেট হয়ে বিঁধছে ছাদে

ঘরের কোণে ঘুমিয়ে আছে একটি পরিত্যক্ত পিয়ানো

তার সাদা কী-গুলো যেন বিষাদের গান গাইছে

প্রত্যেকটি সুরে ঝরে পড়ছে এক একটি ভাঙা চিঠি।

সারি সারি গাড়িগুলো সব ডুবে গেছে মেঘের সমুদ্রে

তাদের হেডলাইটগুলো এখন জেলিফিশের চোখ

পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টগুলোও

অপেক্ষায় আছে এক মৃত প্রজাপতির পুনরুত্থানের।

ছাতার ভেতরে লুকিয়ে আছে এক প্রাচীন লাইব্রেরি

যেখানে বইগুলো সব লেখা হয়েছে চরম নীরবতায়

ড্রেন বেয়ে নেমে যাচ্ছে শহরের সকল না বলা কথা

তারা গিয়ে মিশে যাচ্ছে এক অন্ধকার সাগরে।

সেখানে সাঁতার কাটছে অগণিত সময়ের কঙ্কাল

আর ঢেউয়ের তালে তালে বাজছে অন্তহীন বিষণ্নতা।

প্রতিটি গাছের পাতায় জমে আছে স্মৃতির শ্যাওলা

তাদের শিকড়গুলো চলে গেছে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে।

বৃষ্টির গন্ধ শুঁকে বুঝতে পারি, এ কেবল জল নয়

এ হল জমে থাকা সহস্র বছরের পুরনো কান্না।

কেন আমার নিজের ছায়াটা হঠাৎ অচেনা হয়ে যায়

বারুদ জলের গভীরে এ যেন অন্য কোনোএক আমি

আষাঢ় থেকে শ্রাবণ আমি কেবল দাঁড়িয়েই থাকি

ইচ্ছেপাখি বর্ষার ফোঁটাকে কীভাবে গ্রহণ করে দেখি!

ঈদের পথে

আয়াজ আহমদ বাঙালি

ঈদের সকালে যখন হাঁটছি নামাযের পথে,

তখন দেখি ভিখারিনির মুখেও চাঁদ ফুটেছে।

সে জানে না কে কোরবানি দেবে, তবু জানে

আজ মানুষ একটু বেশি দয়ালু।

শিশুরা নতুন জুতা পায়ে দৌড়ায়,

আর পুরোনো পায়ে হাঁটে স্বপ্নহারা এক বৃদ্ধ।

ঈদের মাঠে সবার কণ্ঠে একসুরে দোয়া,

যেন পৃথিবীর জঞ্জাল ধুয়ে যায়।

আকাশ নীল, বাতাসে রান্নার ঘ্রাণ,

আর গলির কোণায় জমে থাকা কিছু মৌনতা।

তবু সবার মাঝে আছে এক অভিন্ন ভাষা

ভালো থাকিস, ঈদ মোবারক!

এই দিনে কেউ হাত বাড়ায়, কেউ বুক পেতে দেয়

এই তো ঈদের মূল্যবোধ।

না-পাওয়া মানুষের চোখেও আজ একটু পাওয়ার প্রতীক্ষা।

ঈদ মানে একদিনের মিলন, যেন হাজার বছরের মাফ।

এই পথে হেঁটে গেলে ত্যাগই হয় উৎসবের সবচেয়ে সুন্দর রঙ।