নিরুত্তাপ

তমসুর হোসেন

রাত গভীর হলে ক্লান্ত পাখিরা নীড়ের সুষুপ্তিতে শান্তি খোঁজে

দয়িতের আশায় প্রতি নিশীথে জেগে থাকে প্রতিটি

তৃষিত চোখ।

অজানা কারাগারে নির্বাসিত ঘুম দিঘল

কপাট ভেঙে আসতে পারে না গনগনে চোখের পাতায়।

প্রতিটি রাত বিষধর গোখরো হয়ে

নীলাভ ছোবলে ঝাঁঝরা করে প্রেমিক হৃদয়

হাপরের মতো বিবর্ণ পাঁজরে

বীভৎস মূর্তির মতো ভেসে ওঠে পুরনো সব স্মৃতি

স্বামীহারা যুবতীর অসাঙ্গ বৈধব্যের যন্ত্রণায়

আগুনে প্রান্তরে ছোটে অশান্ত ঘোটকি।

অনেক প্রেমে যাকে বশীভূত করা যায় না

তার নিরুত্তাপ অভিব্যক্তি স্নায়ুবিকারের মতো প্রতিকারহীন

যে হৃদয়ে প্রেমাস্পদের প্রতি আসক্তি জন্ম নেয় না

তাকে ভাগাড়ে ছুঁড়ে ফেলাই যুক্তিযুক্ত।

মৃত্যু

হারুন আল রাশিদ

অসম্ভব সুন্দরের অর্থবহ উদাহরণ

মননের গভীর উচ্চারণ

চুম্বকীয় পবিত্র আকাক্সক্ষা

মানুষের রৌদ্রস্নাত অন্তরের

শাব্দিক যৌক্তিক জিজ্ঞাসা।

সত্যের শুভ পর্দার নিপুণ উন্মোচন

বেঁচে থাকার অগণিত ঢেউয়ের

নিঃশব্দ তরল সরলতা

নির্বাচিত সমগ্র প্রণোদনা

অবিনাশী আত্মার নৈমিত্তিক রজনী নিস্তব্ধতা।

জীবন সমুদ্রের প্রবাহিত ঢেউ

জনতার উৎফুল্ল কাব্যিক আবেদন

স্লোগানের অন্তরালে রুগ্ন ফুসফুসের হাহাকার

কোটি মানুষের স্বপ্ন উচ্ছেদের নারকীয় তাণ্ডব

কষ্টের বিধ্বস্ত ছাইরঙ নগরী।

নিয়মের আড়ালে অনিয়মের তামাটে শহর

বিপরীত বৈরী আবহাওয়া

ধারালো বর্শার নিখুঁত লক্ষ্যবস্তু

নিঃশ্বাসের নীরব পরিসমাপ্তি

পৃথিবীর চরম বাস্তবতা।

বাষ্পের কণা

বিল্লাল মাহমুদ মানিক

আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে খানিক তাপের মাত্রা বাড়িয়ে,

যেন আমাদের বরফের দেহ পুরোটা ফেলেছি হারিয়ে।

এখন কেবল বাষ্পের মতো অনুভবে বেঁচে রয়েছি,

দেখা না দেখার আড়ালে কত যে বিরহ যতনে সয়েছি।

চোখ নেই ফলে দেখি না কিছুই, মুখ নেই তাই বলি না;

বাষ্পের কাছে ওসব তুচ্ছ জেনেও কি পথে চলি না?

কে পাশে থেকেছে, কে পাশে থাকছে, কে পাশে থাকবে? ভাবি না;

তবু বলে মন - প্রয়োজনে তুই কাউকে কখনো পাবি না?

অনেকের মাঝে থেকেও আমরা আসলে একেলা থাকছি,

বাষ্পের কণা হয়েও স্বপ্নে বরফের ছবি আঁকছি।

জন্মেছি একা, মৃত্যুও একা মাঝখানে সামাজিকতা;

দ্বিচারিণী হয়ে ও পাগল মন বলছো এসব কী কথা?

রোদের পান্ডুলিপি

বশির আহমেদ

একটা ধুন্দুল সকাল, প্রস্তুত হয় কমলা রোদের পান্ডুলিপি।

অলস আঙ্গিনায় শোনা যায় খাঁজকাটা মোরগের ডাক,

হুবহু লাউ ফুলের মতো কুচিলা ফুল,

ঝোপের আড়ালে কেটে যায় জীবন।

মানুষ মূলত গৃহমুখী,

দিনশেষে গৃহে ফিরে,

সুখ-দুঃখ বিষণ্নতা যত কিছু প্রবাহমান সবই তো গৃহবাসী!

সব রঙ ডেকে চায় কালো রঙে,

জীবনের যত রঙ কবরের কাছে ফিকে।

হে যুবক

সোহেল আব্দুল্লাহ

হে যুবক

যৌবনের চরম উদ্দিপনায় তুমি আজ উদ্দিপিত,

পর্বত চূড়ায় আরোহিত এক অদম্য পথিক।

লক্ষ্য তোমারÑ

আকাশের নক্ষত্রপুঞ্জ ছুয়ে দেখবার!

একটু সময় হবে

ফিরে তাকাবার,

এ মাটির ধুলোয় ধূসরিত পৃথিবী আমার,

যেখানে তোমার বাস ছিল একদিন,

এর কাদাজল মেখে লুটোপুটি খেয়ে

চলে যেত তোমার সারাটা দিন।

মনে পড়ে এই তো সেদিন

তোমার ওই সারল্যে মাখা মধুর হাসিটি দিয়ে

বলেছিলে, মা দুধ দে,

তুমি আজ অনেক বড়,

এখন তোমায় পায় কে বল আর,

এই নোংরা কর্দমাক্ত ধুলো মাটি মাঝে

তোমার মনটি নেই, খোঁজে অচিন দুয়ার।

শোন একদিন, আমিও ছিলামÑ

দূর আকাশের পানে টে চলা এক দুরন্ত পথিক।

কারো কথা শুনার, ভাবার, দেখার,

সময় হতো না আমার।

আজ আমি ক্লান্ত শ্রান্ত, অচল শক্তিহীন পড়ে আছি,

পাহাড়ের এই পাদদেশে।

তোমার কি হবে না সময়, শুধু একবার,

পাহাড়ের চুড়া থেকে নেমে

আমার এ হাতটি ধরে

ক্ষণিকের তরে,

পাশে দাঁড়াবার।

অভিমানের সুতো

লুৎফুর রহমান চৌধুরী

অভিমানের সুতো ধরে যখন এগিয়ে যাই

তখন বাধা হয়ে সামনে দাঁড়ায় প্রতিশ্রুতি!

অনুভুতির করিডোর শীতল হয়ে পড়ে,

তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ধসে পড়ে ভাবনা

ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয় হৃদয়ের গিটারের সব তার

তখন মস্তিষ্কে প্রচণ্ড ভাবে আঘাত লাগে

কোথায় যেন ভুলের মাশুল -----

পিছন থেকে লাগাম ধরে টানছে।

শেষ বিকেলটা বিষণ্নতার ঢাকা পড়ে আছে

শূন্য কলসী নিশ্চুপ পড়ে ছিল অনেকক্ষণ

পানির মিষ্টি কলকল শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে

সকল চিন্তা শক্তির বুক ছিঁড়ে,

শিকল পযা পায়ে ঘুঙুর সেটা খেয়াল করিনি

ধ্সে পড়া দেয়ালে ঝুলন্ত অবস্থায় আছে

অদ্ভুত এক কাহিনীর গল্পকথা,

অভিসারে অভিমানের প্রকৃত রূপ ---

শেষ বেলায় এসেও আর দেখা হলো না।

স্মৃতির নৌকায়

ফারজানা ইয়াসমিন

স্মৃতির নৌকায় পাল তুলে ভেসে বেড়ায় বিষণ্ন দুপুর,

স্রোতের ধ্বনি যেন আলতা পায়ে বাজে নূপুর।

মনের নদীতে ডুবসাঁতার কাটে পানকৌড়ি মন,

তোলপাড় করে ঝড়ো হাওয়া কাঁদে হিজল বন।

দীর্ঘশ্বাসের গভীরে বাজে হৃদয় ভাঙার বীণা,

পড়ন্ত বিকেলের নরম রোদে মেঘের আনাগোনা।

শৈশবের সেই জলধারা শুকিয়ে বালুচর শরৎ-বেলায়,

সবুজ গালিচায় রোদের ছায়া হাঁটছে ধূসর পাতায়।

নিঝুম দুপুরে মনের কোণে আনমনে কুহুক ডাকে,

একলা প্রহর নিঃসঙ্গতায় গ্রহণ লাগায় চাঁদের বুকে।

স্বপ্নের বুনন

আর. কে. শাব্বীর আহমদ

আমি প্রতিদিন শ্রাবণের স্বচ্ছ নীল

আকাশে উড়ে বেড়াই

সখ্য গড়ি আকাশের উদারতায়

খুঁজি আমার প্রিয়তম সত্ত্বাকে।

আমার হারিয়ে যাওয়া প্রিয়তম মানুষগুলো

আবার জেগে উঠুক

সুখের নদী বহমান হোক আমাদের

হৃদয় মরু-প্রান্তরে।

আকাশের সুখতারাগুলো জ্বলজ্বলে হোক

সূর্যালোকে নির্বাপিত হোক যুগের জুলমাত

দুধের জোছনা নহরে অবগাহন করুক

ক্ষত হৃদয়ের মানুষেরা ।

শ্রাবণ আকাশের শুভ্র মেঘকনেরা

স্বস্তির বৃষ্টি ঝরাক

পৃথিবী সুশোভিত হোক অশ্রুসজল

শ্যামল সবুজ কাননে

ফসলের শিল্পীরা অমৃতের বীজ বুনুক

নিরন্নের দগ্ধ জর্জর জমিনে।

মেঘযাত্রী

চন্দনা চক্রবর্তী

আমি সেই মেঘবালকের কথা ভাবছি,

যাকে ঘূর্ণি-বাতাসে স্বপ্ন রেখে আঁকছি।

তার চোখে ঝরে নীলিমার ধারা,

বুক ভরা বিদ্যুতে হাসি তার সারা।

সে বাজায় গর্জনে অগ্নি-বীণার গান,

তার ডানায় জাগে রঙিন দুর্ভেদ্য প্রাণ।

কখনো রোদ্দুরে বুনে দেয় ছায়া,

কখনো অশ্রুতে ভিজিয়ে যায় মায়া।

আকাশের আঁচলে সে দিগন্ত ছুঁয়ে,

ধূসর ক্যানভাসে রঙের ছোপ বুয়ে।

আমি তার পদচিহ্ন খুঁজে ফিরি আজ,

ঝড়েরই অক্ষরে লিখি স্বপ্ন-সাজ।

আমি সেই মেঘবালকের কথা ভাবছি,

নীল আকাশপানে গান হয়ে ডাকছি।

মতবিরোধ

হাফিজুর রহমান

আলোচিত হতে ‘আলোচনার’ আগ্রহ ভীষণ!

তোয়াক্কা না-করায় সমালোচনার,

সংকীর্ণ হচ্ছে ক্রমশ: সমঝোতার পরিধি।

প্রতিনিয়ত সংঘাত-সংঘর্ষের দৌরাত্ম্যে

নাস্তানাবুদ অবস্থা বিশ্বাসের;

নিলামে উঠছে - মর্যাদার মানদণ্ড,

নিয়ন্ত্রণহীন বেপরোয়া জীবন-যাপনে

স্নেহ-মমতার মানুষ, হচ্ছে উগ্র মানসিকতার।

বদলাতে হবে অগ্রগতির এ অবনতির পথ

ফিরতে হবে খুব সহজে সমঝোতায়,

বিলুপ্ত হতে না দিতে মানুষের- মনুষ্যত্বের।