জ্যামিতি-কাব্য : এক

এক ত্রিভুজের তিন বিন্দু, তিনটি কোণ এবং-

একটি ত্রিভুজ, তার তিন বিন্দু, তিনটি কোণ-ক, খ, গ অথবা

এ.বি.সি অথবা আলিফ, বা, তা-

কমপাসের কাঁটা ঘুরছে কোণ থেকে কোণে-

আলিফ থেকে বা, বা থেকে তা, আবারও

তা থেকে আলিফ, আলিফ থেকে বা...

ঘুরছে নিরন্তর ত্র্যস্র

যেন বিহঙ্গ উড়ছে, মহানন্দে এডাল থেকে ওডালে

ছড়িয়ে চন্দ্রকান্তি-সোনালি ডানার আভা।

ত্রিভুজ ঘুরছে কোণ থেকে কোণে, তিন বিন্দুতে-

অখণ্ড নীরবতায়, নির্বাক স্তব্ধতায়, নিখুঁত পরিমাপে-

যেন মওলানা রুমির ঘূর্ণায়মান সামার মজলিশ;

আত্মার লাবণ্যে গুলজার হয়ে ইশ্ক্রে ফোঁটা ফোঁটা কুজ্ঝটিকা

দাগহীন-বাকহীন-শব্দহীন পাপড়ি হয়ে ঝরে পড়ছে

তিন বিন্দুতে, তিন কোণে, তিন সিদ্ধ-সাধকের সফেদ উষ্ণীষে।

প্রথম কোণ-‘আলিফ’, যেন এক প্রবীণ, অগ্নিবর্ণের শুভ্রশ্মশ্রুর শাস্ত্রদর্শী-

হাত ধরে দ্বিতীয় কোণ-‘বা’র কুশল বিনিময়ের সৌজন্যে ব্যতিব্যস্ত;

যিনি একটু পর তৃতীয় বিন্দু-‘তা’র সাথে ত্রৈলোক্য সৃষ্টির

দৃশ্যকাব্য রচনা করবেন।

এই ত্রিভুজের আমি কোন্ কোণে?-না ভিতরে, না বাইরে, না অভিকেন্দ্রে

না এক, না দুই, না তিন-প্রশ্নে বিক্ষত,

কখনও কি ত্রিভুজটি চতুর্ভুজ হবে না?

হবে, আলিফের কণ্ঠ গমগম; বা’রও বিশুদ্ধ স্বর-

একটিই-তো রেখা-

তূরীয়ানন্দে সম্বুদ্ধ হও, দেখবে ত্রিভুজ অচিরেই চতুর্ভুজে সমাবৃত হয়েছে।

সবুজ গম্বুজের আলো-ছায়া : এক

বসে আছি মাছ হয়ে আলোর উৎসবে-

সবুজ গম্বুজের আলো-ছায়া, বসে আছি মাছ হয়ে আলোর উৎসবে।

বিজন-নির্জনে যেন অদৃশ্যে বসে এক মাছের শিকারি

বড়শি ফেলেছে, টোপ তার ইশ্কের অপরূপ দানা

চার সে তো আরও সুস্বাদু; আমি মাছ খাদ্যলোভী

অবিশ্রাম ঘুরছি এই পুষ্পময় অতল-অথইয়ে।

সবুজ গম্বুজের আলো-ছায়া, জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে রহস্যের অনন্ত ফোয়ারা।

আলো তার আলোর মোহনা, বিচ্ছুরিত অচিন্ত্য আলোক।

রং তার বহুবর্ণ, তবু রংধনু নয় সে-তো

আলো তার দিগন্ত-উৎসারী, তবু চন্দ্রালোক নয় সে মতো

সুবাস অমৃতসম, তবু বসুধা শিহরনে আমূল উন্মাদ

দৃষ্টি তার অভয়ের, তবু কেন ভয়শূন্য নয় কোলাহল।

আলো তার তবে কী হে অভিন্ন মোহনা, বিস্ফারিত অমর্ত্য গোলক।

আলো যেন আলো নেই, হয়ে গেল প্রসন্ন মাছের ছায়া আশ্চর্য উচ্ছ্বাসে।

যতবার ডুবে যাই ততবার দেখি সেই ছায়া

যতবার ভেসে উঠি ততবার সবুজ গম্বুজ

হাতছানি দিয়ে ডাকে, যেন এক প্রোজ্জ্বল পাহারা

হৃদয় অবধি বেঁধে নিতে চায় তার লাল-নীল রঙিন রশ্মিতে।

মাছ শেষে নির্ভয়ে মিশে গেল রশ্মিজ্জ্বোল বহুবর্ণ সৌন্দর্য প্লাবনে।

জ্যামিতি-কাব্য : দুই

ত্রিভুজটি চতুর্ভুজ হয়েছে, হয়েছি চতুর্ভুজের এক রেখা-

ত্রিভুজটি চতুর্ভুজ হয়েছে, হয়েছি চতুর্ভুজের এক রেখা, ঘুরছি অনন্তকাল-

বামে রেখে চার সরলরেখা, চার বিন্দু, চতুষ্ক চার বাহু, যেন-

ঘড়ির বিপরীতে চলছি। ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ডের বহুদূরে

সময়ের অতল গহিনে। যেখানে সাহচর্যই আনন্দ, পথ চলাতেই প্রাচুর্য।

অথচ চন্দ্রকর নেই, চন্দ্রকলাও নেই। আছে, জ্যোতিতে উদ্ভাসিত মুখরিত পথ।

সামনে-পেছনে তীর্থযাত্রীর সারি। গুনেও দেখেছি-

সৃষ্টির শুরু থেকে প্রতিদিন এই পথে হাঁটেন সত্তর হাজার পথচারী।

তারপর হারিয়ে যান অসীমের চিরায়ু বাতাসে।

আমিও ঘুরেছি চতুর্ভুজ, প্রথম বাহুতে বামে রেখে কৃষ্ণ-কাজল শিলা;

ছুঁয়ে-চুমু দিয়ে জীবনের বিস্ময়।

আমিও ঘুরেছি চতুর্ভুজ, দ্বিতীয় বাহুর শিরিন সৌরভ মাড়িয়ে

তৃতীয় বাহু। প্রদীপ জ্বলছে ওই অজস্র-আলোকে।

মিছিলের সকল তৃষিত প্রাণ ভাসমান মৎস্য হয়ে ঘুরে,

খাবি খায়, ডুব দেয়, ভেসে ওঠে আলোর প্রপাতে।

আলো তো আলোর উপমা, উচ্ছ্বাসে জ্বলে-নিভে

সন্তর্পণে দেখি তার সীমাহীন উজ্জ্বল শ্যামলিমা।

মিশে যাবো, মিশে যাই, মিশে থাকি আলোর চতুর্ভুজে

লঘুপদে পথ চলি, মৃদুস্বরে কথা হয়, সবিস্ময়ে দেখা হয়-

আলোর আঙিনা জুড়ে

মনসুর হাল্লাজের মতো শ্বেতশুভ্র লাখো মানুষের অবনত ঐশী উন্মাদনা।

সবুজ গম্বুজের আলো-ছায়া : দুই

মাছ ঘুরে ভর দিয়ে অলখ ডানায়-

মাছ ঘুরে পানির অতলে, আকাশের মতন অলোকসুন্দর!

আশেপাশে অপূর্ব সংবাদ-ওই দেখো, চন্দ্রকে ঘিরে সমুজ্জ্বল তারকারা;

ওই দেখো-বেহুঁশ মাছেরা। আরও শোনো-বিনয় মিশ্রিত সুর,

যেন ‘বানাত সুয়াদ’-পড়ছেন সবিনয়ে দণ্ডিত ’কাব। ওই শোনো-

বুরদার নজরানা; বু’সিরীর গিরিশিখর উজল করা অজর অশ্রুধারা।

সাদিও গাইছেন তাঁর অমর পঙ্ক্তিমালা, ‘সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি...’

মাছ ঘুরে; ভারতের তোতাপাখি আমীর খসরুর সাথে দেখা। গাইছেন,

‘রাত্রে যেখানে ছিলাম আমি, বলতে পারবো না কেমন জায়গা ছিল...।’

শামস্-ই-তাবরিজের হাত ধরে রুমিও তৎপর। ওই তো ইকবাল,

বাংলার এক কবির কব্জি ধরে তরবারির মতো চমকাচ্ছেন।

মাছ ঘুরে অবিভক্ত অমরতায়, ভর দিয়ে বরাভয়ে

আবেগের অলখ ডানায়। দেখা হয় বহুবর্ণ মাছের মিছিল।

দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যায়, দেখে-ওয়ায়েস করনির যুগান্তরের দান।

দেখে শাহজালাল; জালালউদ্দিন তাবরিজী জায়নামাজেই দাঁড়িয়ে আছেন।

মাছ ঘুরে এক কলরবে স্পন্দিত প্রেমের উদ্যানে।

মাছ ঘুরে আলোর স্রোতনাদে তৃপ্ত এক অনন্য আকাশে।

রাত্রিশেষ, সহসাই সন্তর্পণে ফিরে এসে দেখে-

মাছ নয়,

মানুষের শ্বাস ধরে সবুজ গম্বুজের আলো-ছায়ায়

বসে আছে পিপাসা-নির্বাণ এক প্রশান্ত হৃদয়।