তৌহিদুর রহমান

আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় একটা সংঘাত সব সময় বিরাজিত আছে। ছিল, থাকবে। সে সংঘাতটা আসলে কি? সেটা মূলত সাংস্কৃতিক সংঘাত। এই সংঘাত থেকে কেন আমরা বেরিয়ে আসতে পারছি না? এই ‘না’ এর শেকড় অনেক গভীরে। চাইলেই সহজে এটা উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়। এই সাংস্কৃতিক সংঘাতের গভীরে রয়েছে প্রত্যেকের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক চেতনার আকর। আর সাংস্কৃতিক চেতনার মূলে আছে সাংস্কৃতিক আদর্শ। এই সাংস্কৃতিক আদর্শই সংঘাতকে কখনো থামতে দেয় না। সাংস্কৃতিক আদর্শ সংঘাতকে সব সময় জিইয়ে রাখে। আর আদর্শিক এই সংঘাত সচল থাকে মূলত ইসলামের সাথে অপরাপর সংস্কৃতির। আবার ইসলামী সংস্কৃতির সাথে অন্য সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব বেশ পুরনো। মুসিলমরা এই দ্বন্দ্বকে সংঘাতে পরিণত করতে না চাইলেও অন্য সংস্কৃতির লোকেরা মুসলিমদেরকে প্ররোচিত করে। এই উপমহাদেশে মুসলিমরা সব সময় তার নিজের সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছে। কিন্তু তা কখনো স্তিমিত হচ্ছে না। এর মূল কারণ কি? আমাদের যে সাংস্কৃতিক স্বন্দ্ব রয়েছে তার মধ্যে বড় আকারে পলিটিক্স প্রবেশ করেছে। এই পলিটিক্স মানে ঠিক রাজনীতি নয়। এই পলিটিক্স মানে ট্রিক্স খাটানো, ধোঁকাবাজি করা । আরো বাড়িয়ে বলতে গেলে বলতে হয়- প্রতারণা করা, চিটারি করা। আমাদের দেশে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, যে যত বড় প্রতারক সে তত বড় পলিটিশিয়ান। ভিলেজ পলিটিক্স বলে না, তার মতো। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ সরাসরি ইসলামের বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়ায় না। তবে তারা সব সময় ইসলামকে প্রতিপক্ষ হিসাবে সমাজের সাধারণ মানুষের কাছে একটা বয়ান দাঁড় করায়। এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আমাদের দেশের সুশীল সমাজ খ্যাত তথাকথিত বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা। মাহবুবুল হক এই বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন। ২৪-এর বিপ্লব ঘটেছে মূলত ইসলামের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদ ও তার দোসরদের অবস্থানের কারণে।

‘২৪-এর বিপ্লবের পর’-এটি মাহবুবুল হকের আলোকে তিমিরে সিরিজের ২ নং বই। বইটি প্রকাশ করেছে বাংলা সাহিত্য পরিষদ। বইটির প্রচ্ছদ বানিয়েছেন তাসনিম রহমান। মূল্য ৪০০ টাকা। অকুণ্ঠ নিবেদন হিসেবে বইটিতে তাদের স্মৃতি ধরে রাখা হয়েছে যারা বিভিন্ন সময় দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য কাজ করেছেন। পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তা এখানে সরাসরি তুলে ধরা হলো : “২৪-এর বিপ্লবে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমরণ সংগ্রামসহ শাহাদত বরণ করে একাত্তরে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের নামজারি করেছেন যারা, তাদের পবিত্রতম স্মৃতির উদ্দেশে।”

মাহবুবুল হক একজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক। কথার বাঁক ফেরাতে তিনি অপরিসীম দক্ষ। বরাবরই তিনি জীবনকে অতি ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে বেঁধে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ‘এক টুকরো মেঘ’, ‘এক রতি জোসনা’, ‘এক ঝলক রোদ’, ‘এক পশলা বৃষ্টি’সহ তার লেখা বইগুলোর নাম থেকেই এর প্রমাণ মেলে।

তিনি সংগঠক হিসেবে বেশ সুপরিচিত। সমাজসেবা তার নেশা ও পেশা। শুরু থেকে আজ অবধি তিনি মানুষের কষ্টের রাজ্যে বিচরণকে জীবনের ব্রত হিসেবে ধারণ করে চলেছেন। মানবিক স্তম্ভ রক্ষণাবেক্ষণ তার অন্যতম প্রচেষ্টা। স্রষ্টার করুণা তার একমাত্র কাম্য।

জীবনটা সুন্দর। তাই সুন্দর জীবনকে তিনি ছোট্ট ছোট্ট বাক্য দিয়ে বাক বদলের আলোয় শৈল্পিক সলতে দিয়ে উজ্জ্বল করে তুলেছেন। তার অসাধারণ কীর্তি হচ্ছে, বিশ পর্বে রচিত ‘নবী সিরিজ’, পাঁচ পর্বে রচিত ‘গল্প শোন সিরিজ’। এগুলো শ্রেষ্ঠ মানুষের জীবনের গল্প। সেখানে আছে, ‘আবু বকরের গল্প শোন’, ‘ওমর ফারুকের গল্প শোন’ ইত্যাদি। মাহবুবুল হকের বইয়ের সাথে আমাদের অনেক দিনের পরিচয়। বইয়ের মাঝে জীবনের উজ্জ্বলতা বর্ণনা করার ক্ষেত্রে অসাধারণ দক্ষ তিনি। তার বই থেকে জীবনের শব্দ খুঁজে পাওয়া যায়।

বহু বছর ধরে মাহবুবুল হক তার দৈনন্দিন চিন্তাভাবনা এবং পর্যবেক্ষণের অনেক চিত্র অন্তরে ধারণ করে রেখেছেন এবং কখনো কখনো ছোট ছোট নোট আকারে সেগুলো লিখেছেন। মূলত হৃদয়ে আঁকা সেই ছবিগুলো দিয়েই তিনি তার ‘আলোকে তিমিরে-২, ২৪-এর বিপ্লবের পর’ বইটি চিত্রিত করেছেন। তিনি তার ভ্রমণ, তার পরিবেশ, তার বন্ধু-বান্ধব, তার লেখার প্রক্রিয়া এবং দেশের সাথে তার জটিল সম্পর্ক সম্পর্কে লিখেছেন। তিনি তার লেখায় ২৪-এর গণবিপ্লব এবং পূর্বাপর ঘটনাগুলো তালিকাভুক্ত করেছেন। তার লেখায় জড়িয়ে আছে তাকে ঘিরে থাকা নানান বিষয় এবং যা পরবর্তী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে এমন অনেক দৃশ্যের প্রাণবন্ত চিত্রকল্প।

বইটিতে যেসব কনটেন্ট লেখক হাজির করেছেন তা সত্যিই অসাধারণ এবং পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের উপযোগী। পাঠকের জ্ঞাতার্থে তা এখানে দেয়া হলো : “গণবিপ্লব ২০২৪, গণবিপ্লব থেকে গণঅভ্যুত্থান, সব নয়, মূল স্তম্ভগুলোর সংস্কার জরুরি, শুভ পরিবর্তন বনাম অশুভ পরিবর্তন, ইন্ডিয়া বাংলাদেশের সনাতনীদের বাংলাদেশী হতে দেয়নি, মহীউদ্দীন আহমদের ‘দৈনিক জেহাদ’, মহীউদ্দীন আহমদের ‘সোনার বাংলা’, অন্তর্র্বর্তী সরকার হয়ে উঠুক ‘সংস্কারক সরকার’, প্রকাশ্যে গোপনে অনেক কিছু চলছে, স্বাস্থ্য আর চিকিৎসা এক কথা নয় এবং..., ঐক্যÑঅনৈক্য-ঐক্য..., ডক্টর ইউনূসের আশাবাদ : আমাদের ভবিষ্যৎ, স্বৈরাচারের মাথা পালালেও..., ঐক্য উপলব্ধি এবং কুরবানি, বিচারের আগে নির্বাচন নয়, আমলাদের জন্য কাউন্সিলিং দরকার, সরকার এখন সচল, সজীব ও সতর্ক অবস্থানে, শিক্ষাঙ্গন থেকে সরাসরি রাজনীতির ময়দানে যারা এলেন, ‘তবুও আশায় বাঁধিনু ঘর’, নানা ধারার মধ্যে ঐক্যের সমন্বয় ঘটাতে হবে, তারপরও কি সেকুলারিজম বজায় থাকবে?, আসুন সত্য ও বাস্তবের মুখোমুখি হই, সকল মতবাদ ও দর্শন নিয়ে জাতি হোঁচট খাচ্ছে এবং হে আল্লাহ! আমরা এখন কোথায় আছি?”

ফ্যাসিবাদী সরকার সব সময় দেশের মুসলমানদের জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে চরম নির্যাতন করেছে। হাজার হাজার মানুষকে জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে খুন করেছে, গুম করেছে। জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে মানুষ খুনকে জায়েজ করেছে। এমনকি আমাদের স্বাধীকার আন্দোলনের বীর সেনানী তিতুমীরকে পর্যন্ত জঙ্গি ট্যাগ দিয়েছে।

“তিতুমীরের বাঁশের লাঠিতে সব তৈরি হয়ে আছে। তিতুমীর একবার হেরে গেছেন বলে বার বার হেরে যাবেন- এমন কথা কেউ ভাবছে না।

গত স্বৈরাচারী সরকারের আমলে তিতুমীরকে বলা হয়েছিল, তিনি ছিলেন জঙ্গি। তিনি দেশে অশান্তি সৃষ্টি করেছিলেন। শুধু তিনি নন, ফকির মজনুসহ তাদের বংশধর সবাই তো ফরায়েজী আন্দোলন করেছিলেন। সেই আন্দোলনগুলো স্থানীয়ভাবে স্বাধীনতার পক্ষে কামিয়াবও হয়েছিল।” (পৃষ্ঠা ৯৬)

বইটি পড়ে পাঠক একটি সুন্দর অভিব্যক্তি, গবসড়ৎরবং Memories of Distant এবং লেখকের আভ্যন্তরীণ জগৎ অন্বেষণ করতে পারবেন বলে আমরা মনে করি। তাছাড়া শিল্প, সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্রোতের ধারাবহিকতার সাথে একটি আকর্ষণীয়, ঘনিষ্ঠ সাক্ষাতও পাবেন, যা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমরা বইটির ব্যাপকভাবে প্রচার কামনা করছি।