খুরশীদ আলম বাবু

আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রাক চল্লিশে বাংলা কবিতার যুগ যখন মূলত দুইটি ধারায় প্রবাহিত। প্রথম ধারাটি হলো: কবিতার শিল্প উৎকর্ষতার নামে ইলোশন, সুপার স্ট্র্যাকচার প্রভৃতি কথার খোলস কবিতা নির্মাণ, যার নেতৃত্বে ছিলেন বুদ্ধদেব বসু ও তার অনুসারী যেমন নরেশ গুহ ও অরুণ কুমার সরকার প্রমুখরা। আর একটি ছিল নজরুল কাব্যের সমাজতান্ত্রিক কবি গোষ্ঠী। লক্ষণীয়, ফররুখ আহমদ এই দুই ধারার মধ্যেই আপন প্রতিভাবলে অবস্থান করেছেন। দুই গোষ্ঠীই তাকে বরণ করে নিতে দ্বিধা করেননি।

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ফররুখ আহমদের উত্থান চল্লিশ দশকের শেষের দিকে হলেও ব্যাপ্তি ও প্রতিভাবান কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে তার অন্তত ১২ বছর লেগে যায়। ফররুখ আহমদ আমেরিকার জাতীয় কবি রবার্ট ফ্রস্টের মতো তড়িঘড়ি করে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের বিরোধী ছিলেন। সেই কারণে আমরা লক্ষ করব যে, প্রথম চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী কাব্য ‘সাত সাগরের মাঝি’ তে কবি জীবনের প্রথম দিককার কবিতাগুলো পর্যন্তও ঠাঁই পেল না। সেইগুলো পেলো তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘হে বন্য স্বপ্নেরা’তে। আবার কোনটির ঠাঁই মেলে ‘কাফেলা’ কাব্যগ্রন্থে। এই কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে বিস্তর আলোচনার দরকার রয়েছে। কিন্তু সেই দরকারি কাজে হাত দেয়ার মতো উচ্ছ্বাসী সমালোচক আমরা পাচ্ছি না, এর অভাব ক্রমশ তীব্রতর হচ্ছে। তাই আমাদের ফররুখ চর্চা বাড়ানো প্রয়োজন। ‘সাত সাগরের মাঝি’কে ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ বললে ভুল বলা হবে না। বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য সফল কাব্যগ্রন্থের সারিতে এর ঠাঁই অনেক দিন আগে সেই পঞ্চাশের দশকেই হয়ে গেছে। তবুও আমাদের সামনে প্রশ্ন আসতে পারেÑ আজকের দিনে ফররুখের কবিতার আলোচনার আবশ্যকতা কী? আধুনিক কবিতায় ফররুখের অবদান কি সুদূর প্রসারী? যারা ফররুখের কবিতার বিরোধী, তাদের অভিযোগের শীর্ষ বিন্দুগুলো এবার ক্রমান্বয়ে স্পর্শ করা যাক। অসংখ্য প্রতিভাবান ব্যক্তি সেই সময় ফররুখকে বুঝতে পারেনি, কিংবা রাজনৈতিক বিশ্বাসে বিজড়িত হয়ে বুঝতে চাননি। আবার এও হতে পারে বুঝেও না বোঝার ভান করেছেন। ফররুখের মতো নতুন ধারা সঞ্চারী কবি নানা কারণে অন্যান্য প্রতিভাবান কবিদের মতো ভুল বোঝাবুঝির শিকার হতে পারেন।

ফররুখের বিষয়ে অভিযোগÑ

ফররুখের কবিতা কোনক্রমেই আধুনিক কবিতা নয়, তার কবিতায় স্বদেশের মানুষ ও দুঃখ-ব্যথার কাহিনী সত্যিকারভাবে প্রস্ফূটিত হয়নি। মোদ্দাকথা মক্কা-মদিনা, ইরাক-ইরান, বাগদাদের মতো অচেনা পটভূমি- অ কবিতায় অতিরিক্ত আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার তার কাব্যমান নষ্ট করেছে।

আধুনিক বাংলা কবিতায় ফররুখের কোনো প্রভাব নেই, তার মৃত্যুর পর সেই কালাকাল নষ্ট হয়ে গেছে। তার কোনো উত্তরাধিকারী নেই।

আপাতত, সেই অভিযোগের প্রত্যুত্তর দেয়ার আগে ফররুখের উত্থানের সময়টা পর্যালোচনা করা দরকার। ফররুখের জন্ম ১৯১৮ সালের ১০ জুন। আর ‘সাত সাগরের মাঝি’ প্রকাশকাল ১৯৪৪ সাল। মোটামুটি ২৬ বছরের সামাজিক-অর্থনৈতিক কালাকাল। তার জন্মের কুড়ি বছর আগে বাংলার মুসলমানদের জীবনে নবজাগরণ শুরু হয়েছিল। এই জাগরণ অবশ্যই প্রতিবেশী বৃহত্তম গোষ্ঠী হিন্দু চেতনার সংমিশ্রণে নয়। বাংলা সাহিত্যে মুসলমানি ঢঙ কখনো পরিস্ফূট হয়নি। মনে রাখতে হবে, বাংলার হিন্দুরা কখনোই এদেশকে পরাধীন বলতেন না। হিন্দু সম্প্রদায়ের স্বাদেশিক চেতনা মুসলমানদের তুলনায় কম ছিল। কারণ, বঙ্কিম থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সবাই ইংরেজদের ত্রাণকর্তা বলে মনে করতেন। বঙ্কিম সিপাহী বিদ্রোহকে অরাজকতা বলতেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ইংরেজদের বিরুদ্ধে চরম পন্থার রাজনীতিকে সমর্থন দেননি। আর সেই কারণে মহাত্মা গান্ধীকে তার সমর্থন করতে দ্বিধা ছিল না। আজকে যারা রবীন্দ্রনাথপন্থী বামমনা সাহিত্যিক রাজনীতিকে ধর্মের অনুপ্রবেশ করার ঘোর বিরোধী, সেই রবীন্দ্রনাথ মহাত্মা গান্ধীর জন্মজয়ন্তীতে কী বলেছিলেন সেটাও জানা দরকার। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন :

‘আজিকার প্রধান সমস্যা হইল এই যে, জাতীয় ঐক্যের আবহাওয়া সৃষ্টি হইলেও এক হইতে পারি নাই; সঙ্কীর্ণ প্রাদেশিক এবং সাম্প্রদায়িকতা জাতীয় সংহতি মূলে কুঠারাঘাত করিতেছে। গান্ধীজির রাজনীতির মূল লক্ষ্য হইল ঐক্য স্থাপনা। সেই ঐক্য শুধু রাজনৈতিক ঐক্য সাধনের অসৎ স্বরূপ নয়, উহা দুর্বার নৈতিক শক্তিও বটে। তিনি (গান্ধী) সর্বপ্রথম রাজনীতিতে ধর্মের অঙ্গীভূত করিয়াছেন।’ দেশ, তৃতীয় বর্ষ, ৪৬-৪৭ সংখ্যা ৩-১০ অক্টোবর ১৯৩৬) তাহলে রবীন্দ্রনাথের কথায় পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে মহাত্মা গান্ধীর রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশকে তিনি সমর্থন করছেন। যে মুসলমান সম্প্রদায় শিক্ষা-দীক্ষায় সর্বক্ষেত্রে অনগ্রসর, শতাব্দীর অন্যতম নন্দিত পুরুষ কবি কাজী নজরুল ইসলামের উত্থানের সাথে সাথে যেন বাঙ্গালি মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র উত্তাল হয়ে উঠল। চারিদিকে পত্র-পত্রিকার প্রকাশ, রাজনীতির ক্ষেত্রে মুসলমান রাজনীতিবিদরা সমান অধিকার দাবি করে বসলেন, আর তখনই শুরু হলো সঙ্ঘাত। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ মুসলিম সম্প্রদায়কে বুঝিয়ে দিলো সংগ্রাম ছাড়া মুসলমানদের সামনে কোনো পথ নেই। সচেতন ফররুখ নিশ্চয়ই এসব লক্ষ করেছিলেন। তবে একথা ঠিক যে, ফররুখ তার কবি জীবনের প্রাথমিক পর্ব থেকেই ইসলামী চেতনার মধ্যে বসবাস করেননি, কিছুটা হলেও তার মধ্যে নিখিল নাস্তিকতার ভাবও ছিল, কারণ এই পর্বে ফররুখ আহমদ ছিলেন বিপজ্জনক বামপন্থার অনুসারী ও মানবেন্দ্রনাথ রায়ের র‌্যাডিক্যালপন্থী। আর স্বভাবতই ছিলেন নির্যাতিতের পক্ষে। এই পক্ষপাতিত্ব তিনি আমৃত্যু তার চেতনায় ধারণ করেছিলেন। বামপন্থী বা ইসলামপন্থী বলে কোনো কথা নেই। ফররুখ পরবর্তীতে পথ খুঁজে পেলেন ইসলামী ঐতিহ্যে। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রাক চল্লিশে বাংলা কবিতার যুগ যখন মূলত দুইটি ধারায় প্রবাহিত। প্রথম ধারাটি হলো: কবিতার শিল্প উৎকর্ষতার নামে ইলোশন, সুপার স্ট্র্যাকচার প্রভৃতি কথার খোলস কবিতা নির্মাণ, যার নেতৃত্বে ছিলেন বুদ্ধদেব বসু ও তার অনুসারী যেমন নরেশ গুহ ও অরুণ কুমার সরকার প্রমুখরা। আর একটি ছিল নজরুল কাব্যের সমাজতান্ত্রিক কবি গোষ্ঠী। লক্ষণীয়, ফররুখ আহমদ এই দুই ধারার মধ্যেই আপন প্রতিভাবলে অবস্থান করেছেন। দুই গোষ্ঠীই তাকে বরণ করে নিতে দ্বিধা করেননি।

ফররুখের কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল ব্যক্তিবাদী বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদনায় ‘কবিতা’ পত্রিকার পাশাপাশি সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো অমর প্রতিভা তার ‘লাশ’ কবিতাকে ঠাঁই দিলেন বিখ্যাত ‘আকাল’ সঙ্কলনে। ফররুখকে যে কোনো নামের কবি বলে আখ্যায়িত করুক না কেন ‘লাশের কবি’ নামেই তিনি অনেকদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এদিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে এই দুই কবি হলেন দুর্ভিক্ষের মানবতাহীন বিরূপ পরিবেশের শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার। আর বিস্ময়ের বিষয় হলো এই যে, ফররুখের শেষ কবিতাও হলো ১৯৭৪, পরিবেশও দুর্ভিক্ষকেন্দ্রিক। তাই আমি বলছিলাম যে, ফররুখকে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হলে তার কাল্যকাল আমাদের জানতে হবে, কারণ ফররুখ ছিলেন তার কালের অশান্তময় পরিবেশের একজন প্রতিবাদী কবি। তা সত্ত্বেও ফররুখের এককেন্দ্রিকভাবে বিচার করা ভুল হবে। ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাবে, তার কাব্যে রয়েছে অজস্র বৈচিত্র্যময়তা; পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যা ছায়াছন্ন সময়ের বহিঃপ্রকাশ। এই কারণে ফররুখকে আরো বেশি গবেষণা ও চর্চার প্রয়োজন। এবার আসা যাক ফররুখের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর সম্বন্ধে। দেখা যাক অভিযোগের কতখানি সত্যতা রয়েছে।

প্রথমত : আমাদের মনে রাখতে হবে ফররুখ আহমদ প্রতিবাদী ধারার কবি হলেও আদতে তিনি ছিলেন রোমান্টিক কবি, আর রোমান্টিক কবিরা একটু আধটু অতীতের জন্যও হাহাকার করে থাকেন। অতীতই শুধু নয়, বর্তমানকে মিলানোর দায়িত্বও থাকে তাদের। প্রতীক-উপমার আড়ালে-আবড়ালে নিজের চিন্তাধারাও আবেগকে কবিতার জারক রসে সিক্ত করতে চান। এই কারণে আমরা দেখি জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় হাঁস-দূরদ্বীপ, ঘোড়া, নদী-সাগর, হরিণ-পাখি, বিষ্ণুদে’র কবিতায় ঘোড় সওয়ার, ক্রোসিডা ও ওফেলিয়া, প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতায় যেমন দূরবর্তী মরুভূমি, বেনামী বন্দর এমনকি সীমাহীন আকাশকে ব্যবহার করেছেন। সেই রকম ফররুখ আহমদ তার কবিতায় অজস্র প্রতীক উপমার মাধ্যমে কবিতা লিখে বাংলা কবিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।

এই প্রতীকগুলো হলোÑ পাঞ্জেরী, সাইমুম, হেরার রাজতোরণ ও নারঙ্গীবন ইত্যাদি। বাস্তববাদীদের সংজ্ঞায় অবশ্যই স্বীকার্য যে, ফররুখের কবিতায় সাম্প্রতিক জীবন কিছুটা হলেও ফিকে; এতে অবশ্য লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। কারণ, এই অভিযোগ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো কবি সম্রাটের কবিতার বিরুদ্ধেও সব সময়ই ছিল; এখনো থাকা স্বাভাবিক। নীতিবাগীশ বুদ্ধদেব বসুও মনে হয় এই সমস্ত তথাকথিত বাস্তববাদীদের উৎপীড়নে (বামপন্থীদের দ্বারা সুকান্তকে রবীন্দ্রনাথের পর শ্রেষ্ঠ কবির মতো অর্বাচীন ঘোষণাও তিনি দেখেছিলেন) বিরুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন, কেউ বুক চাপড়ে কাঁদে আবার কেউ বালিশে মুখ চেপে কাঁদে। আসলে তারা (সমাজবাদী সমালোচক) বাস্তবতাকে নিজের মতো করে কবির চেতনায় চাপিয়ে দিতে চান। মূলত, তারাই ফররুখকে বাস্তবতাহীন কবি বলার পাগলামোয় দুঃসাহসী নিশ্চয়ই হতে পারেন।

এদের বিবেচনায় কবিতার শ্রেণী সংগ্রাম, ধনীর ধনসম্পদ কেড়ে নেয়ার কথা থাকলেই বাস্তবাদী হবে, না থাকলে হবে না, এমন অসাহিত্যিক আলোচনার মতো লোকনিন্দার পরিবেশ হালকা হওয়ার নিশ্চয়ই মিলিয়ে গেলেও, এখনো সেই অসাহিত্যিক সমালোচনার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। যে আল মাহমুদ ‘কালের কলস’-এ ফররুখের উদ্দেশ্যে লিখতে পারেন :

“অস্থির পানির আভা স্পর্শ করে দূরে বাতাসের

অসীম সাহস, আর ছুঁয়ে যায় পৃথিবীর ঘুম

অলক্ষ্য তড়িতে কাঁপে যে কঙ্কাল কালপুরুষের

তারি মন্ত্রে মনে, মুগ্ধ হয়ে তো যাবে আকাশ কুসুম।

(অসীম সাহস : কালের কলস)

তিনিই পরবর্তীকালে ফররুখকে নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন ‘সত্য ন্যায়ের পথিক’ নামে, সৃজন করেন ‘ফররুখের কবরে কালো শেয়াল’ নামে অবিস্মরণীয় কবিতা। আর এই এখানেই ফররুখের উপার্জন করে নেন বিরুদ্ধবাদীদের পাহাড়ে পা তুলে সৃজিত কবিতার বিজয়। এবার ফররুখের কবিতার পরিবেশ সম্বন্ধে আসা যাক। আমরা ভুলে যাই কবি কী নিয়ে কবিতা লিখবেন। এই রকম কোনো বাধ্যবাধকতা কোনো কালেই ছিল না, এটা কবির চেতনার স্পর্শময় বিষয়; বিষ্ণু দে শুধু উর্বসীকে নিয়ে কবিতা লেখেননি, কবিতার পটভূমির প্রয়োজনে গ্রিক দেবী আর্টেমিস ও ক্রেসিডাকে নিয়েও কবিতা সৃজন করেছেন। পাঠক ও সমালোচকদের লক্ষ করার বিষয় শুধু কবির পরিবেশ ও পটভূমি কতখানি কবির হৃদয়ে গাঢ়ত্বের সঞ্চার করেছে। আমি অবশ্য এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাবো না। কারণ, এই অভিযোগ সম্বন্ধে স্বয়ং ফররুখও ওয়াকিবহাল ছিলেন, অনেকটা তার প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কবির কৈফিয়ত’-এর মতো একটি কবিতায় তার জবাব দিয়েছেন। ফররুখ আহমদ এই কবিতার নাম দিয়েছেন ‘সাহিত্যের ঐতিহ্য : এক’। পাঠক মিলিয়ে নিন এই কবিতার বিষয়বস্তুকে :

ঐতিহ্যটা চাও যদি আঞ্চলিক ভিত্তিতে কেবল

তাহলে গুরুর সঙ্গে কেন তুমি করো না কোন্দল।

‘বাংলার কবি’ কেন মহারাষ্ট্র, রাজপুতনার

কাল্পনিক গাঁথা গানে করে দেন উজাড়?

মক্কা-মদিনার পথে কেন তবে সতর্ক পাহারা?

কী সূত্রে বাঙালি হয় ভিন্নভাষী অবাঙালি ধারা

(হালকা লেখা, ফররুখ আহমদ রচনাবলী দ্বিতীয় খণ্ড, বাংলা একাডেমি পৃ.২৮৪ )

আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস বাংলার কবি বলতে ফররুখ কোনো কবিকে ইঙ্গিত করেছেন তা পাঠকদের বুঝতে অসুবিধা হবে না। আসলে ফররুখ এই অভিযোগের উত্তর গদ্যে না দিয়ে কবিতায় দিয়ে এলিয়টের কবিতার মতো ঐতিহ্য কাকে বলে বুঝিয়ে দিয়েছেন। আশা করি, অদূর ভবিষ্যতে ফররুখের বিরুদ্ধে এই অভিযোগের তীব্রতা ক্রমশ কমে আসবে।

এবার আসা যাক ফররুখের কবিতায় আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ব সাহিত্যের এটি চিরায়ত রীতি যে, ভাষার তেজস্বতা বাড়াতে সঙ্গীতময় ভাষার দিকে অগ্রসর হওয়াটা মহৎ কবিদের প্রিয় অভ্যাস; জীবনানন্দ দাশের প্রথমদিকের কবিতায় এবং ‘ঝরা পালক’ কাব্যগ্রন্থে গ্রন্থিত কবিতাবলি তার প্রমাণ বহন করছে। কবিতার কাব্যভাষা নির্মাণের জন্য আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করতেই পারেন। ‘সাত সাগরের মাঝি’তে যে সমস্ত আরবি-ফারসি শব্দাবলী এসেছে তা আমাদের দেশের গ্রাম-গঞ্জে দীর্ঘ পনের শ’ বছর ধরে চলে আসছে। পুঁথি সাহিত্যের একান্ত অনুরাগী পাঠক তার প্রিয় ক্লাাসিক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তর মতো অত্যন্ত দক্ষ হাতেই সেই শব্দাবলীকে ফররুখ কাজে লাগিয়েছেন।

পাথর পারানো কুঅত তোমারে দিয়াছে আল্লাহপাক: এখানে কুঅত মানে শক্তি। মাত্রাবৃত্তে তিন মাত্রায় শক্তি রাখলে কবিতার এমন কোনো ক্ষতি হতো না।

হাজার জীবন যদি হয় পয়মাল : এখানে পয়মাল মানে ধ্বংস।

শুধু দুঘড়ির বিশ্রাম নেব পাতার খিমা মোর : এখানে খিমা শব্দের অর্থ তাবু।

মনে পড়ে সেই নওল ঊষার হাসিন পিয়ালা দিল : এখানে নওল শব্দের অর্থ নতুন পাশাপাশি হাসিন শব্দের অর্থ রূপবান।

এই রকম আরো শব্দ পাওয়া যাবে ‘সাত সাগরের মাঝি’ কাব্যগ্রন্থে। সুতরাং আরবি-ফারসি অতিরিক্ত ব্যবহার সম্বন্ধে অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। দক্ষ হাতে এই শব্দের নতুন ব্যবহার এর আগে ফররুখের মতো অন্য কেউ করতে পারেনি। ফররুখের সমালোচকরাও এই কারণে প্রশংসিত হয়েছে। আর এখানেই নজরুলোত্তর তিনি একজন সেরা কবি। তবে বিস্ময়ের বিষয় এই যে, ফররুখের মৃত্যুর পর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘হে বন্য স্বপ্নেরা’ ফররুখের আপাতঃ আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার নেই।

খুব একটা নেই ‘মুহূর্তের কবিতা’র কবিতাবলীতে। সেখানেও ফররুখ দেখিয়েছেন অসামান্য কাসিক সংযম। তবে এটা ঠিক যে, ফররুখের কবিতার প্রভাব বাংলা কবিতায় খুব একটা নেই। এতে আমাদের দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। কারণ, ফররুখের মতো প্রতিভাবান কবির অনুকার থাকতে পারে, কিন্তু তাকে অনুসরণ করাটা সত্যিকারভাবে কঠিন। যদিও পঞ্চাশ দশকে দেখা যায় জীবনানন্দ দাশের পাশাপাশি এক বিশাল তরুণ কবি সম্প্রদায়কে তিনি প্রভাবিত করে চলেছেন। এমনকি কবি শামসুর রাহমানের প্রথম পর্বের কবিতায় (প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’র কবিতাবলী) ফররুখ আহমদের প্রভাব ছিল বলে হুমায়ূন আজাদের মতো ফররুখ বিরোধী সমালোচকও স্বীকার করেছেন। মনে রাখতে হবে ফররুখ তার জীবদ্দশায় ছিলেন দেশের অন্যতম সৃজনশীল ও বিচিত্রমনা প্রধান পরীক্ষাপ্রবণ কবি। যিনি কাব্যনাট্যসহ হাতেম তায়ের মতো মহাকাব্য লেখার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। আজকে বাংলা কবিতায় আল মাহমুদ ও শামসুর রাহমান যে ভূমিকা পালন করেছেন ফররুখ সেই ভূমিকা পালন করেছিলেন। আমৃত্যু সেই আসনটা কেউ টলাতে পারেনি। তবে আগের তুলনায় ফররুখ চর্চার প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে বলে আমাদের ধারণা। আজকের যে কোনো তরুণ কবি যদি ঐতিহ্যবাদী পথের অনুসারী হতে চান তাকে অবশ্যই ফররুখের প্রদর্শিত পথে আসতে হবে। অন্য সব ঐতিহ্যবাদী কবির মতো ফররুখের কবিতার গঠনকাঠামো এখনো রীতিমত বিস্ময়ের সঞ্চার করে থাকে। সাম্প্রতিকালের অধিকাংশ তরুণদের কাব্য চর্চাকে সৌখিন বিদ্রোহ আখ্যায়িত করাই উত্তম হবে। কারণ, তাদের কবিতা পাঠে বোঝা দুষ্কর; কবি আসলে কী বলতে চাচ্ছেন। বলাবাহুল্য, এক ধরনের তরলিত আবেগ কাব্য চর্চার পরিবেশকে হাস্যকর করে তুলেছে। আর এর পেছনে কাজ করেছে ছন্দের পরিবর্তে গদ্যছন্দে কবিতার অপব্যবহার লেখার প্রবণতা।

ফররুখের কাব্যজীবনের ক্রমবিকাশ পর্যালোচনা করলে যেকোনো তরুণ কবি দেখতে পারেন ফররুখ যে সময় কবিতা লেখা শুরু করেছেন, সেই সময় চলছে গদ্য কবিতার যুগ। যদিও রবীন্দ্রনাথ গদ্য কবিতাকে সমর্থন করে কবিতা লিখেছেন, প্রকাশ করেছেন ‘পুনশ্চ’র মতো গদ্য কবিতার বই। সেখানেই তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে ছিলেন এই বলেÑ ‘যারা দৈব দুর্যোগে মনে করবেন গদ্যকাব্য রচনা করা সহজ, তারা এই খোলা দরজাটার কাছে এসে ভিড় করবেন সন্দেহ নেই। তাই নিয়ে ফৌজদারি বাধলে আমাকে সাক্ষী মেনে বসবে। সেই দুর্দিনের পূর্বে নিরুদ্দেশ হওয়া ভালো।’ (‘পুনশ্চ’ গ্রন্থ পরিচয় পৃষ্ঠা-১৯৭) আর এটা সবাই জানেন, গদ্য কবিতা সংক্রান্ত রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্যটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৩৯ (দেওয়ালী)।

সর্বশেষ কথা হলোÑ কবিকে অবশ্যই প্রত্যয়বাদী ধ্যান-ধারণার অধিকারী হতে হবে। অবশ্য প্রত্যয়বাদী ফররুখ আহমদ সব সময় এই নীতি মেনে চলেছেন তাও বলা যায় না, মাঝে মাঝে হতাশ হয়েছেন। তবুও বলা যায়, মোটের ওপরে তিনি প্রত্যয়বাদী কবি শুধু নন জীবনবাদী কবিও বটে।

আখরোট বনে, / বাদাম, খুবানি মনে / কেটেছে তোমার দিন। / হে পাখী শুভ্রতনু, / সফেদ পলকে চমকে বিজুরী, চমকে বর্ণধনু, / সোনালি, রূপালি, রক্তিম রংগিন। /হালকা রেখায় আকাশ ফেলেছো চিরে, / পার হয়ে গেছ কত আলোকের স্তর, / রৌদ্রে, শিশিরে নোনা দরিয়ার নীরে, / ফিরেছো কখনো আকাশের তীরে তীরে; / হে বিহঙ্গ! জানতে না ভয়, কখনো পাওনি ডর। (আকাশ নাবিক : সাত সাগরের মাঝি)

পুরো কবিতাটি তুলে দিতে পারলে আমার ভালো লাগতো। কিন্তু এখানে সেই অবকাশ নেই। কারণ এই দীর্ঘ আলোচনার আলোকে স্তরের পর স্তর পেরিয়ে আমাদের বুঝতে বাকি নেই যে, ফররুখ বাংলা কবিতায় একমাত্র সিন্দাবাদ। যার সমকক্ষ কেউ নেই, অদূর ভবিষ্যতেও পাওয়া যাবে না তা বলা বাহুল্য। তার অমরতা নিশ্চিত হয়ে গেছে অনেক আগেই।