অধ্যাপক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন

জুলাই ২০২৪ পৃথিবীর ইতিহাসে দীর্ঘ এক মাস। এমন প্রলম্বিত মাস আর আসবে না আগামী কয়েক শতাব্দীতেও। এমন দীর্ঘ মাস কোন রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনের জন্য নয়। এটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, ভূ-রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণসহ ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংস্কার, পুনঃনির্মাণ, বিনির্মাণ, মানুষে-মানুষে সম্পর্ক উন্নয়ন ও সৌহার্দ্যপূর্ণ করণ এবং জাতির আত্মপরিচয়ের ভিত্তি জানান দেওয়ার লড়াই। যে লড়াইয়ে সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং অকল্পনীয়। এ লড়াই দীর্ঘ রাজনৈতিক সংঘাতের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের নতুন বন্দোবস্ত।

রাজনৈতিক নেতারা ১৭৫৭ সাল, ১৮৬৭ সাল, ১৯১১ সাল, ১৯৪৭ সাল ও ১৯৭১ সালে মানুষের জন্য নতুন মানচিত্র ধ্বংস ও পুনঃনির্মাণ করেছিলেন, কিন্তু জন-আকাক্সক্ষা পুরণ করতে পারেননি। এই ব্যর্থতার প্রধান কিছু কারণ উল্লেখযোগ্য: এক. রাজনীতির সাথে শিল্প-সাহিত্যের ও জন-আকাক্সক্ষার সংযোগ ঘটাতে না পারা। দুই, নিজ দেশীয় জনগণের কৃষ্টি-কালচার-ট্র্যাডিশনকে চিহ্নিত করে তাদের রক্তে প্রবাহিত মননশীল ধারার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে ব্যর্থ হওয়া। তিন, অন্তকলহে বিদেশী শক্তির অনুপ্রবেশ ও ঔপনিবেশিক হেজেমনির প্রভাবে রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণ করে দেশের জনগণকে শোষণের বস্তুতে পরিণত করা। চার, নিজস্ব বয়ান তৈরিতে ব্যর্থ হওয়া।

উল্লেখিত কারণগুলোকে প্রশমিত করার উপায় হলো-প্রাগৈতিহাসিক সময়কাল থেকে প্রবাহমান বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রূপান্তরকে মানুষের হৃদয়ে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্র ও জাতিসত্তার পরিচয় কাঠামো স্থায়ীকরণের চেষ্টা করা। জুলাই বিপ্লব ২০২৪ এর আলোকেই ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়ে সকল পুরানো বন্দোবস্তকে ছুঁড়ে ফেলেছে এবং সংকরায়ণমুক্ত সাংস্কৃতিক রাষ্ট্র নির্মাণের আকাক্সক্ষা তৈরি করে স্বকীয়-সত্তার মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে এক অনন্য রাষ্ট্র কাঠামো তৈরি করা।

জুলাই বিপ্লব ২০২৪ এর আন্দোলনে বুদ্ধিবৃত্তিক যে রূপরেখা দেওয়া হয়েছিল তা পরিপূর্ণভাবে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে ঘটেছে। এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মূল পরিকল্পনাকারী ও জাগরণের কাজটি করেন কবি, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা। কখনো সচেতনভাবে আবার কখনো অবচেতন বা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই জাগরণ তৈরির কাজটি করেছেন। ফলে জুলাই বিপ্লব সাংস্কৃতিক জাগরণের ফসল বলা ভুল নয়।

ইতিহাসের বিচারে জুলাই বিপ্লব জাতীয়তার তর্ক ও জনগোষ্ঠীর বয়ান এক নতুন পটভূমি থেকে তা বিশ্লেষণ করা আবশ্যক। এই আবশ্যক বিষয়টি আলোচনার ক্ষেত্রে তিনটি পর্যায়ে আলোকপাত করা আবশ্যক: এক, ফ্যাসিজমের সময়ে রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণ ও সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চার ধারা এবং প্রতিরোধের উদ্যোগ কেমন ছিল তা পর্যালোচনা করা। দুই, বিপ্লব চলাকালীন সময়ে সাহিত্যক ও সংস্কৃতজনদের মধ্যে দুটি ধারা কীভাবে সংঘাতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একটি পক্ষ গণ-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন করার সহায়তা করেছিল, এবং তাদের নৈতিক ভিত্তি পর্যালোচনা করা। পাশাপাশি তাদের সে কর্মসূচি কীভাবে সাধারণ জনগণকে উদ্ধুদ্ধ করেছিল তার বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যালোচনা করা। তিন, ফ্যাসিজম পরাভূত হলে ‘কেমন বাংলাদেশ চাই’ সমীকরণে সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত রাখার উপায় হিসেবে এবং যেকোনো কাঠামোতে স্বকীয় পরিচয় বিনির্মাণে সাহিত্য-সংস্কৃতির ভূমিকা শীর্ষক করণীয়গুলোর একটি সমীক্ষামূলক রোডম্যাপ গ্রহণ অতীব প্রয়োজন।

জুলাইয়ের সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক আলোচনায় তরুণদের অবদান সবচেয়ে বেশি। প্রবীণদের বড় একটা অংশ মোসাহেবীতে ব্যস্ত ছিল ফ্যাসিজমের, একটা অংশ সময় বুঝে গর্তে লুকিয়ে ছিল এবং বর্তমানে নানাভাবে সুযোগ গ্রহণের চেষ্টায় লিপ্ত। এ অংশটি আবার তরুণদের যোগ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করে তাদের মেধাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে। কিছু প্রবীণ যারা বরাবরই বাংলাদেশের দীর্ঘ ইতিহাসের পটভূমি সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন তারা তরুণদের নিয়ে জন-জাগরণের দায়িত্ব পালন করেছেন।

যেকোনো বিচারে এই আন্দোলনের মূল বাতিঘর ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। প্রতিটি মুহূর্তে তার কবিতা, গান ও নানা কর্মকাণ্ডের উপস্থাপনার মাধ্যমে নিজেদের মনোবল বৃদ্ধি রাখা হতো। এরপরই আল মাহমুদ ও ফররুখ আহমদ অনিবার্য ছিলেন। অনেক নবীন-প্রবীন ও প্রতিষ্ঠিত কবিদের কবিতার চরণ ব্যাপকভাবে ভূমিকা রেখেছিল। কবি আবদুল হাই শিকদারের কবিতা ফ্যাসিজমের ক্ষমতাকালীন সময়ে যেমন কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল, তেমনি আন্দোলন চলাকালীন সময়ে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। বিশেষ করে তার মামলা বিষয়ক দীর্ঘ কবিতা মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করেছে এই আন্দোলনে আঘাত প্রাপ্ত হবেনই। মামলার শিকার হবেনই। কিন্তু দমিয়ে গেলে চলবে না। উল্লেখিত কবিরা কেবল কবিতা লিখার মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, তারা মাঠে নেমেও লড়াই করেছেন।

ফরহাদ মজহার, সলিমুল্লাহ খান ও মোহাম্মদ আজমের মতো কবি, গবেষকরাও নানাভাবে লেখনির মাধ্যমে এবং বক্তৃতার মাধ্যমে জনসম্পৃক্ত হয়ে লড়াইকে তীব্রতর করেছেন। তাদের আলোচনা ও লেখনিগুলো নতুন প্যারাডাইম তৈরি করেছে এবং পুরানো বয়ানকে প্রত্যাখ্যান করার মতো সাহস জুগিয়েছিল।

গুম, খুন, ক্রসফায়ার, নিবর্তনমূলক আইন, লুটপাট, দুর্নীতি ও হামলা-মামলার মাধ্যমে দীর্ঘদিন ফ্যাসিজমকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো না, যদি কিছু ধান্দাবাজ কবি সাহিত্যিকরা এবং কণ্ঠশিল্পী, অভিনয়শিল্পীরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বাহিরে থাকা সাধারণ মানুষকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে ভিন্নখাতে মাতিয়ে না রাখতো। এমনকি আন্দোলনের সময়ও তারা ছিলেন সোচ্চার। অর্থাৎ বিপ্লব পূর্ব এবং বিপ্লব চলাকালীন সময়ে ক্রিয়াশীল ছিল সাংস্কৃতিক রাজনীতি।

এক সময় বিশেষ ব্যক্তির বা দলের শাসনকে বিকল্পহীন ভাবা হতো। এই ভাবনা সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক রাজনীতির মাধ্যমেই তৈরি করা হয়েছে। এই বয়ানের মাধ্যমে ফ্যাসিজম কায়েম হয়। অর্থাৎ ফ্যাসিম কায়েম করার অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতির আগ্রাসন। আবার জুলাইয়ে সেই ট্যাবু ভেঙে নতুন বন্দোবস্ত তৈরির মুখ্য ভুমিকা পালন করেছে সাহিত্য ও সংস্কৃতজনরা।

উল্লেখ্য উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশক ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে যে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে তাকে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। কিন্তু সাতচল্লিশে দেশভাগের মাধ্যমে তা নতুন ধারণা লাভ করে এবং ধীরে ধীরে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের পূর্ণ বিকাশ লাভের মাধ্যম স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হয় ১৯৭১ সালে। এই সব ক্ষেত্রে জন-হৃদয়ে জাগরণের প্রধান দায়িত্ব পালন করে সাহিত্য-সংস্কৃতি।

তরুণ প্রজন্ম পুরোনো সাংস্কৃতিক যুদ্ধের ঘানি টানতে সম্মত নয়। তবু তরুণদের বিভাজিত করার চেষ্টা চলমান। এই বিভাজনের প্রক্রিয়ায় সাহিত্য-সংস্কৃতি ও নতুন বয়ান সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে চতুরতার মাধ্যমে। আবার একে মোকাবেলার জন্য সাহিত্য-সংস্কৃতির বাঁকবদলের আওয়াজ তোলা প্রয়োজন। ঠিক এ কারণেই অভ্যুত্থান পরবর্তী বিভিন্ন বুদ্ধিভিত্তিক উদ্যোগের গুরুত্ব অপরিসীম।

সাহিত্য-সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের মূল বিষয় ছিল জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদের বিষয়কে কেন্দ্র করেই মূলত ফ্যাসিজম গড়ে উঠেছিল। কিন্তু চব্বিশ সে বয়ানকে ভেঙে দিয়ে ভারতীয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ইসলামি জাতীয়তাবাদ, বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমা জাতীয়তাবদকে প্রত্যাখ্যান করে মাটির সংস্পর্শে থাকা এক স্বকীয় জাতীয়তাবাদ নির্মাণের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। আর এই স্বকীয় জাতীয়তাবাদ নির্মাণ ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিজনদের বিভাজনমূলক ভাষা ও চিহ্নব্যবস্থার বিরুদ্ধে মোকাবেলা যেভাবে চব্বিশে করেছেন, তেমনি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূমিকা পালন করতে হবে। তৈরি করতে হবে নতুন ভাষিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎ এবং সেই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।

জুলাই চব্বিশ কাব্যভাষা নির্মাণ ছিল অণিবার্য, যা জাগরণের প্রধান অস্ত্র। সেই অস্ত্রে মাহবুব হাসান, আবদুল হাই শিকদার, তমিজ উদ্দীন লোদী, সায়ীদ আবুবকর, নয়ন আহমেদ, সাজ্জাদ বিপ্লব, জাকির আবু জাফর, ফজলুল হক তুহিন, আফসার নিজাম, রেদওয়ানুল হক, তাজ ইসলাম, হাসনাইন ইকবাল, তাসনীম মাহমুদ, রফিক লিটন প্রমুখ কবিরা তাদের কবিতায় শহীদের স্বপ্নের প্রতিফলন ঘটিয়ে আন্দোলনের চেতনায় এগিয়ে নিয়ে যেতে ভূমিকা পালন করেন।

সাজজাদ হোসাইন খান, শহীদুল্লাহ ফরায়জী, আসাদ বিন হাফিজ, মোশাররফ হোসেন খান, হাসান আলীম, সোলায়মান আহসান, নাজিব ওয়াদুদ, মাহফুজুর রহমান আখন্দ প্রমুখ সাহিত্যিকরাও ভূমিকা রাখেন ব্যাপকভাবে। তরুণ কবি ইমরান মাহফুজ, আবিদ আজম, ফরিদ সাঈদ, মোহাম্মদ ইসমাইল, সীমান্ত আকরাম প্রমুখ সংস্কৃতিজনরা বিভিন্ন অনুষ্ঠান যেমন নাট্য, পথনাট্য, ভিডিও, আলোচনা সভার আয়োজনের মাধ্যমে ভূমিকা পালন করে।

শিল্পী সায়ান, আসিফ আকবর, হায়দার হোসেন, পার্থ বড়ুয়া, হাসানসহ অনেকেই রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে জাগরণ তৈরি করেছেন। হোসনে মোবারকরা শর্ট ফ্লিম তৈরি করে ফ্যাসিজমের চরিত্র যেমন তুলে ধরেছেন তেমনি কর্তব্যও ঠিক করে দিয়েছেন।

এই আন্দোলনে স্লোগান তৈরি করে এবং নিত্য নতুন শব্দগুচ্ছ দিয়ে তরুণ প্রজন্ম চমকের পর চমক সৃষ্টি করেছেন। যার ফলে ফ্যাসিস্টরা তাদের ভাষা বুঝতে পারেননি। প্রতিদিনের ঘটনাপ্রবাহকে নিয়ে শিক্ষার্থী ও চিত্রশিল্পীদের গ্রাফিতি ছিল অনন্য অনুষঙ্গ, যা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। প্রতিটি গ্রাফিতি একেকটি ঘটনার সাক্ষীকে ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করে রেখেছে।

পরিশেষে লেখাটির ইতি এভাবে টানা যায়, চব্বিশের জুলাই বিপ্লব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে হলেও এর প্রধান চালিকা শক্তি ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি। এর মাঝে গণ-আকাক্সক্ষা ফুটে উঠেছে। এই আকাক্সক্ষাই ঠিক করবে আগামীর বাংলাদেশের যাত্রাপথ।