জোবায়ের রাজু
আজ শুক্রবার একটি ভালো দিন হলেও মন ভালো নেই জাহেদা বেগমের। এর বিশেষ কারণ হচ্ছে গতরাতে তিনি আড়াল থেকে কান পেতে শুনেছেন আসিফ আজ ফারহানাকে নিয়ে মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন সফর শেষ করে তারপর চিড়িয়াখানায় ঘুরতে যাবে।
এই কাহিনী শোনার পর থেকে জাহেদা বেগমের চোখের নিদ চলে গেল। একজন স্বামী তার বউকে নিয়ে ঘুরতেই পারে, এটি খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু স্বাভাবিক ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগছে জাহেদা বেগমের। বিয়ের পর থেকেই তিনি ফারহানার পেছনে লেগে আছেন। অথচ পুত্রবধূ হিসেবে ফারহানাকে ১০০তে ২০০ নাম্বার দেওয়াটা বিরল কিছু নয়। মার্জিত চরিত্রের ফারহানাকে শ্বশুরবাড়ির সবাই কদর করলেও জাহেদা বেগম সহ্য করেন না পুত্রবধূকে। বিয়ের কয়েক দিন পরে তার মনে হতে শুরু করল আসিফ ফারহানাকে যেন একটু বেশিই গুরুত্ব দিচ্ছে। আসিফ মায়ের এসব ছলচাতুরী বুঝতে না পারলেও ফারহানা ঠিকই টের পেয়েছে। এ নিয়ে তার অনুশোচনা নেই আসলে আক্ষরিক অর্থে। কারণ সে একবার কোথাও যেন পড়েছে বাংলাদেশের সব শাশুড়িরা নিজেদেরকে ফেরেশতা মনে করে। আর বউয়েরা শাশুড়ির মতো ফেরেশতা হতে না পেরে মানুষ রূপে দুনিয়াতে এসেছে কেবল আফসোস করতে। কথাটাতে দারুণ যুক্তি এবং বাস্তবতার সংমিশ্রণ আছে বলে ফারহানার আফসোস নেই। বয়সের তুলনায় সে যথেষ্ট চৌকস।
ফারহানা আসিফের সঙ্গে বের হতে প্রস্তুতি নিচ্ছে দেখে গা জ্বলতে থাকে জাহেদা বেগমের। আসিফ এবং ফারহানার এই ভ্রমণ ঠেকাতে তিনি ফন্দি খুঁজতে লাগলেন। অনেক ভেবেচিন্তে তার মাথায় এক কু-বুদ্ধি এল। একগাদা কাপড়চোপড় বের করে এনে ফারহানাকে দিয়ে বললেন, ‘এগুলো ধুয়ে দাও বৌমা।’
ফারহানা দেখল কাপড়গুলোকে ওই অর্থে ময়লাচ্ছন্ন বলা যায় না। তবু শাশুড়ির এমন অহেতুক আবদার তাকে বিচলিত করল বটে, তবে সংসারের টু শব্দ যেন না হয়, তাই সে যখন চুপচাপ কাপড়গুলো নিয়ে বাথরুমে ঢুকবে, তখন আসিফ এসে বলল, ‘এগুলো কাল ধুয়ে দিও। তোমাকে না বললাম আজ আমরা সারা শহর ঘুরে বেড়াব! রেখে দাও এগুলো।’ ফারহানা আসিফের কথাকে পরোয়া না করে বলল, ‘বেশিক্ষণ লাগবে না। একটু অপেক্ষা করো।’
পাশের ঘর থেকে এসব বাক্যালাপ শুনে অসহ্য লাগল জাহেদা বেগমের। অথচ এসব অসহ্য লাগার কথা না। নিজের মেয়ে সামিয়া যখন তার হাজব্যান্ডকে নিয়ে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ায়, তখন সেসব ঘটনা ভালো লাগে জাহেদা বেগমের। অথচ পুত্র যখন তার স্ত্রীকে নিয়ে একটু আনন্দবিলাসে কোথাও বের হবার পরিকল্পনা করে, তখন আর সেসব হজম করা কঠিন তার জন্য।
২.
বড় সাইজের এক বালতি কাপড় ধুয়ে ফারহানা সেসব রোদে শুকাতে দিতে ছাদে চলে গেল। সত্যি সত্যি তার বেশি সময় লাগেনি। কাজের প্রতি ফারহানা যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় যে দেয়, আজকাল সেসব আসিফের চোখে পড়ে।
বাইরে বের হবার জন্য পোশাক নির্বাচন করছে আসিফ। হঠাৎ মনে হল আলমারিটা দুলছে। শুধু কেবল তা নয়, চার দেয়ালও যেন নড়ছে। তার মানে কি! ভূমিকম্প হচ্ছে! জাহেদা বেগমের চেঁচামেচি, ‘ভূমিকম্প হচ্ছেরে। নিচে নেমে আয় সবাই।’
এবার পুরো পাঁচতলা ভবন দুলে উঠল। ভয়ে আর আতঙ্কে সবাই ব্যাকুল চিত্তে দিশেহারার মতো সিঁড়ি ডিঙিয়ে নামছে। ভীত আসিফ মাকে নিয়ে নিচে নেমে আসার পর হঠাৎ মনে হল ফারহানা তো ছাদে। কি হবে এখন! প্রবল ভূমিকম্পে যদি ভবন ধসে পড়ে!
ভবনের সবাই নিচে চলে এসেছে। মাকে নিচে নিরাপদে রেখে আসিফ প্রাণের মায়া ত্যাগ করে আবার উপরের দিকে যেতে পা বাড়াতেই জাহেদা বেগম বললেন, ‘কোথায় যাস তুই?’ আকুল গলায় আসিফ বলল, ‘ফারহানা তো ছাদে ভেজা কাপড় নিয়ে গেছে। ওকে নিয়ে আসছি।’
তারপর আসিফ দৌড়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে। ততক্ষণে অবশ্য ভূমিকম্পের আশঙ্কা মুক্ত। ছেলের এমন পাগলামো দেখে এই দুর্যোগ সময়েও জাহেদা বেগমের গা জ্বলে উঠল। আসিফ কেন ফারহানাকে আনতে গেল, এই ঘটনা সহজে নিচ্ছেন না তিনি।
অবাক হলেও সত্য যে ফারহানা ভূমিকম্পের এত আলামত টের পায়নি। ভেজা কাপড় তারে ঝুলিয়ে দিতে সে ব্যস্ত। আসিফের এমন অগত্যা আগমন আর ভূমিকম্পের অজানা গল্প শুনে ফারহানা ভয়ে হকচকিয়ে উঠল। কয়েক বছর আগে ফারহানার বড় ভাই স্বপন জাপানের ভূমিকম্পে মারা গেছে। সেই স্মৃতি মনে হতেই ভয় পেয়ে সে আসিফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আসিফ তাকে নিয়ে জলদি নেমে আসে নিচে।
নিজের চিত্র দেখে অবাক ফারহানা। আশপাশের সব ভবনের সবাই প্রাণের ভয়ে নিচে নেমে এসেছে। অথচ এত কিছু সে টের পায়নি এতক্ষণ।
জাহেদা বেগম দেখলেন অর্ধ ভেজা কাপড় পরা ফারহানাকে আসিফ হাত ধরে নিচে নামিয়ে নিয়ে এসেছে। সে দৃশ্য দেখে তীব্র এক অপ্রকাশ্য অভিযোগে শরীর জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হল তার। অথচ এই অভিযোগ ভিত্তিহীন এমন দুঃসময়ে। এই অভিযোগ অনুভব করা মানেই হিংসাত্মক মনের বহিঃপ্রকাশ।
বড় ভাই স্বপনের কথা ভেবে ফারহানা ভয় পেয়ে আসিফের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। পাশ থেকে সে দৃশ্য দেখে জাহেদা বেগমের শরীরে যেন নরকের আগুন জ্বলছে। কিন্তু সে আগুন তিনি প্রকাশ করে কাউকে দেখাতেও পারছেন না। যেন জমে থাকা অভিযোগের আবরণে ডাকা এক নিচু মানসিকতার নীরব দ্বন্দ্ব, যে দ্বন্দ্বের আসলে বাস্তবিক কোনো ব্যাখ্যা নেই। রহস্যে ভরা এত বড় এই পৃথিবীতে অনেক কিছুর ব্যাখ্যা হয় না।