মুহিব্বুল্লাহ ফুয়াদ
জুনায়েদ! এই! এ ই ই-ই! চুপ করো! চুপ। উস্তাদজী আসছে। ফিসফিস করে কাউছার বলছিলো। জুনায়েদ তখন ফাইয়াজের সাথে গল্পে বুঁদ হয়ে আছে। খেয়ালই ছিলো না যে সে ক্লাসে আছে। জুনায়েদ দাঁত বের করে এমনভাবে হাসছিলো যেন,অন্ধকারে চাঁদের আলো ফুটে উঠছিলো। উস্তাদজী ক্লাসে আসায় ক্লাস একদম নিরব হয়ে গেছে। যেন এখানে কেউ নেই। অনেক দিনের পুরোনো পরে থাকা ঘরের মতন। ফাইয়াজ, জুনায়েদ ও কাউছার এবছর প্রথম শ্রেণীতে পড়ছে। তারা খুব ভালো বন্ধু। একটু ফাঁক পেলেই গল্পে মেতে ওঠে তারা।
উস্তাদজী ক্লাসে এসে আরবী কায়দা পড়িয়ে নির্বিঘ্নে চলে গেলেন। যদিও ক্লাসে এলে অন্যান্য দিন গল্প করেন। আজ করেন নি। কারণ উস্তাদজীর গল্প করার সময় নেই। তারাবি পড়াতে হয় প্রতি রাতে। তাই গল্প না করে কোরআন তিলাওয়াত করবেন এখন।
ফাইয়াজ! কী যেন বলছিলে? ওহ-হো মনে পড়েছে। তুমি দিনে তিনটা রোজা রাখো,তাই না? হুম। ফাইয়াজ বললো। একদিনে তিনটা রোজা রাখো? কাউছার জিজ্ঞেস করলো। হুম। তো কীভাবে তিনটা রোজা রাখো? জুনায়েদ জিজ্ঞেস করলো। এই তো সেহরির সময় খাই। মাদরাসায় আসার সময় আরেকবার খাই। এই হলো একটা রোজা। আরেকবার দুপুরে খাই। এই দুইটা। আরেকবার সন্ধ্যাবেলা আব্বু আম্মুর সাথে খাই। এভাবেই সব মিলিয়ে তিনটা রোজা রাখি। এহ! এভাবে রোজা হয়? কাউছার বলে। জুনায়েদ খিলখিল করে হেসে ওঠে। জুনায়েদ, ফাইয়াজ ও কাউছারের চেয়ে বড় হওয়ায় একটু চালাক-চতুর। রোজা সম্পর্কে মোটামুটি তার ধারণা হয়েছে। এই জন্যই সে হেসে ওঠে। ফাইয়াজ বলে এতে হাসার কী আছে? আমার আম্মু তো তাই-ই বলেছেন। আরে বোকা, রোজা সারাদিনে একটাই হয়। তিনটা হয় না। আরে না। আম্মু বলেছেন,ছোটদের দিনে তিনটা রোজা রাখতে হয়। আর বড়দের একটা রাখতে হয়। আমার আম্মু’ও তো তাই বলেছেন। বললো কাউছার। তাই আমিও দিনে দুইটা রোজা রাখি। মাঝেমধ্যে তিনটা। তোমাদেরকে বোকা বানিয়েছে। তোমরা ছোট হওয়ায় রোজা রাখার জন্য জেদ ধরে বসো। সারাদিন কিছু খাও না, তাই এমনটা বলেছেন। আমি তো ঠিকঠাক খাই, তাই আমাকে আম্মু বলেছেন রোজা একটাই। তবে ছোটদের রোজা না রাখাই ভালো। এতে শরীর ভালো থাকে। আমাদের যখন বয়স হবে তখন আমরা রোজা রাখবো। ও তাই? ফাইয়াজ ও কাউছার এক সাথে বললো। হুম।
ফাইয়াজ বাসায় যেয়ে আম্মুর সাথে কোনো কথা বলে না। মুখ গোমড়া করে বসে আছে। ফাতেমা বেগম অর্থাৎ ফাইয়াজের আম্মু জিজ্ঞেস করলে কিছুই জবাব দেয় না। আদর করে ফাতেমা বলেন, আমার সোনাপাখির কী হয়েছে? কথা বলছে না যে! কেউ মেরেছে? না কেউ কটুকথা বলেছে? ফাইয়াজ চুপ হয়ে বসে আছে। কিচ্ছু বলে নি। ফাতেমা তাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু এঁকে বলেন, কি হয়েছে বাবু আমার? আমাকে বলো! কিচ্ছু হয় নি। তুমি আমাকে মিথ্যে বলেছো। তাই তোমার সাথে আড়ি! ওরে বাবা! আমি আবার কী মিথ্যে কথা বললাম? তুমি বলেছো, ছোটদের দিনে তিনটা রোজা রাখতে হয়। অথচ, জুনায়েদ বলেছে, রোজা একটাই রাখতে হয়। আমি কাল থেকে একটাই রোজা রাখবো। ওহ-হো তাই বুঝি আমার সোনা বাবু অভিমান করেছে! হুম। শোনো! তুমি আমাদের একমাত্র আদরের খোকা। তোমার এখনো রোজা রাখার বয়স হয় নি। তুমি না খেয়ে থাকলে তোমার শরীর শুকিয়ে যাবে। এতে আমাদের অনেক কষ্ট লাগে। তাই তোমাকে এমনটা বলেছি। সবাই তাদের বাচ্চাদের এটাই বলে। যেন সে উৎসাহ পায়। আমাকেও তোমার নানু ছোটবেলায় এমন বলতো। তাই বুঝি? হুম। তাহলে বাবাকেও দাদু এমন বলতো? হুম। আচ্ছা,আম্মু আমি কাল একটা রোজা রাখবো। আর বলবো না। শুধু একটা রোজা রাখতে দাও! পরে আর বলবে না তো? না। বলবো না। সত্যি বলছো? হুম। এক সত্যি, দুই সত্যি,তিন সত্যি। আচ্ছা বাবা ঠিকাছে।
পরের দিন সেহরি খায় ফাইয়াজ রোজা রাখার জন্য। দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেল হয়েছে তখন-ই সমস্যাটা বাঁধে। ফাইয়াজের গলা শুকিয়ে দম যায় যায় অবস্থা। তাও রোজা ভাঙতে রাজি না সে। অনেক বুঝানো হলো, কিন্তু সে তার কথাতেই বলবৎ থাকে। তাকে তার আম্মু ঘুম পারিয়ে দেয়। ইফতারের সময় তাকে ডেকে ঘুম থেকে তুলে ইফতার করানো হয়। এভাবেই ফাইয়াজের প্রথম রোজা আদায় হয়ে যায়। তাই ফাইয়াজ ভীষণ খুশি। আর সেই খুশিতে গদগদ করতে করতে তার দাদা-দাদি ও চাচিকে বলে বেড়ায় আমি একটা রোজা রেখেছি আজ। সবাই তাকে আদর করে জড়িয়ে নেন বুকে। আর দোয়া দেন।