গল্প
মরুভূমির ফুল
সকালবেলার সূর্যের আলো মরুভূমির বালিতে চিকচিক করছে। বাতাসে একধরনের শান্ত নীরবতা, আর সেই নীরবতার মাঝেই ফুটে উঠেছে এক ছোট্ট কুটির। এই কুটিরে থাকত এক বৃদ্ধ এবং তার নাতি, ইসমাইল। ইসমাইলের বয়স মাত্র দশ বছর,
Printed Edition

রুশো আরভি নয়ন
সকালবেলার সূর্যের আলো মরুভূমির বালিতে চিকচিক করছে। বাতাসে একধরনের শান্ত নীরবতা, আর সেই নীরবতার মাঝেই ফুটে উঠেছে এক ছোট্ট কুটির। এই কুটিরে থাকত এক বৃদ্ধ এবং তার নাতি, ইসমাইল। ইসমাইলের বয়স মাত্র দশ বছর, কিন্তু তার মনে অনেক প্রশ্ন। দাদা ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ। প্রতিদিন তিনি ইসমাইলকে কুরআনের গল্প শোনাতেন। দাদার কাছে বসে ইসমাইল শিখত ধৈর্য, শোকর এবং আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপনের গভীরতা।
একদিন সকালে ইসমাইল দাদার কাছে গিয়ে বলল, ‘দাদা, আমাদের জীবন কেন এত কঠিন? আমরা এত কষ্ট করি, তবুও কেন আল্লাহ আমাদের দুঃখ দেন?’ তার চোখে একধরনের কৌতূহল আর কিছুটা অবুঝ দুঃখ।
দাদা মুচকি হেসে বললেন, ‘আয়, ইসমাইল। আজ তোমাকে এক বিশেষ গল্প শোনাব।’
দাদা বললেন, ‘অনেক দিন আগে এক গরিব কৃষক ছিল। তার ছিল মাত্র একটি পানি তোলার কলসি, কিন্তু সেই কলসিটা ছিল ফাটা। প্রতিদিন সে সেই কলসি দিয়ে কষ্ট করে পানি আনত, আর ফাটা থাকার কারণে তার অনেকটা পানি রাস্তায় পড়ে যেত।
কৃষক একদিন কলসিটিকে বলল, ‘তুমি কেন ফাটা? তোমার কারণে আমার এত কষ্ট।’
তখন কলসি কৃষককে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, আমি ফাটা, কিন্তু তুমি কি লক্ষ্য করেছ, আমি যেই পথে পানি ফেলে আসি, সেই পথেই সবচেয়ে বেশি ফুল ফোটে?’
‘কৃষক দেখল, সত্যিই তো! সেই পথের পাশে ফুটে আছে রংবেরঙের ফুল, যা প্রতিদিন তার পথকে সুন্দর করে তোলে। তখন সে বুঝল, কলসির ফাটলই তার আশীর্বাদ।’
ইসমাইল দাদার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তাহলে কি আমরাও আল্লাহর তৈরি এমন কোনো কলসি?’
দাদা হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, ইসমাইল। আমাদের জীবনের কষ্টগুলোই হয়তো অন্য কারো জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহ সবসময় জানেন আমাদের জন্য কী ভালো। আমাদের কাজ হল ধৈর্য রাখা এবং তাঁর ওপর ভরসা করা।’
গল্পটি শেষ করার পর দাদা আবার বললেন, ‘ইসমাইল, তুমি জানো, আমাদের জীবনও এই মরুভূমির মতো। এখানে কখনো মেঘ থাকে না, বৃক্ষের ছায়া থাকে না। তবুও আল্লাহ এখানেও ফুল ফোটান। তুমি কি জানো কেন? কারণ তিনি চান, আমরা যেন জানি, জীবনের কঠিন সময়েও সৌন্দর্য তৈরি হয়। আমরা যদি ধৈর্য ধরে তাঁর উপর ভরসা রাখি, তবে সেই কষ্টই একদিন আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার হয়ে দাঁড়ায়।’
ইসমাইল কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর সে বলল, ‘তাহলে কি এই কষ্টগুলোও আমাদের পরীক্ষার অংশ? যেন আমরা ধৈর্য আর বিশ্বাস শিখতে পারি?’
দাদা মাথা নাড়লেন, ‘ঠিক তাই। মনে রেখো, আল্লাহ যাকে ভালোবাসেন, তাকেই পরীক্ষা করেন। পরীক্ষা মানে আমাদের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ। যেমন একটি পাথর তীব্র আগুনে পুড়ে সোনা হয়ে ওঠে, তেমনি আমাদের কষ্টগুলো আমাদের মানুষ হিসেবে আরও শক্তিশালী আর সুন্দর করে তোলে।’
একদিন দুপুরে দাদা আর ইসমাইল মরুভূমির মধ্যে হাঁটছিলেন। হঠাৎ ইসমাইল একটি ছোট্ট সবুজ গাছের চারা দেখতে পেল। সে অবাক হয়ে বলল, ‘দাদা, এখানে কীভাবে এমন গাছ জন্মায়? এত খরা, এত গরম তবুও কীভাবে?’
দাদা বললেন, ‘এটাই আল্লাহর রহমত, ইসমাইল। এই গাছের বীজ হয়তো অনেক দূরের বাতাস থেকে এখানে এসেছে। আল্লাহ তার জন্য এখানে একটু পানি, একটু ছায়ার ব্যবস্থা করেছেন।
আমাদের জীবনও এমন। কখনো কখনো আমরা অজানা কষ্টে থাকি, কিন্তু সেই কষ্টের মাঝেও আল্লাহ আমাদের জন্য কিছু না কিছু ব্যবস্থা করে রাখেন। আমরা যদি তাঁর প্রতি বিশ্বাস রাখি, তাহলে সেই ছোট ছোট দানাই আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে ওঠে।’
সেদিন থেকে ইসমাইল আর কখনো দুঃখের কথা বলে না। বরং তার কষ্টের মাঝেও সে খুঁজে নেয় আল্লাহর রহমতের চিহ্ন। দাদার কাছ থেকে শোনা গল্পগুলো তার মনে গভীরভাবে ছাপ ফেলে।
মরুভূমির সেই ছোট্ট কুটিরে তখন থেকেই যেন প্রতিদিন নতুন ফুল ফুটতে শুরু করে।
ইসমাইল বড় হয়ে যায়। তার হৃদয়ে থাকে দাদার শেখানো সেই শিক্ষাগুলো। জীবনের যে কোনো কঠিন সময়ে, সে দাদার কথা মনে করে। মনে করে, প্রতিটি কষ্টের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে একটি আশীর্বাদ। আর সেই বিশ্বাসেই সে এগিয়ে চলে জীবনের পথে।