আব্দুস সালাম

মিরান ছোট বেলা থেকেই শান্ত-শিষ্ট । দেখতেও হ্যাণ্ডসাম। পড়াশুনাই তার একমাত্র লক্ষ্য। খেলার সময় খেলা, পড়ার সময় পড়া। এই নিয়ম সে মানতে নারাজ। একটু সময় পেলে বই নিয়ে বসে। সহপাঠিরা যখন বিভিন্ন খেলায় মত্ত থাকে ঠিক তখন তাকে দেখা যায় পড়ার টেবিলে। ছাত্রজীবনে সে কখনো প্রণয় সম্পর্কেও জড়ায়নি। বন্ধু রাহাত তাকে অনেকবার প্রশ্ন করেছে, “তুই কাউকে পছন্দ করিস না?” “অবশ্যই করি।” “কে সে?” “তাতো বলা যাবে না।” যতবারই রাহাত প্রশ্ন করেছে একই উত্তর পেয়েছে। কিন্তু আজ সে নাছোড়বান্দা। মিরানকে বাধ্য করে তার নামটা বলতে। অনেক পীড়াপীড়ির পর সে বলেছিল, “তার নাম আলো। জীবনের আলো।” “কিন্তু কে সে? তার পরিচয়?” “যে আমার জীবনকে আলোকিত করবে সে।” কথাগুলো বলেই সে হা হা হাৃ করে হাসতে থাকে। মিরান সত্য বললেও রাহাত বুঝেছিল সে কাল্পনিক একটা নাম উচ্চারণ করেছে।

পড়াশুনা শেষে মিরান বেসরকারী এক ব্যাংকে চাকরি পায়। সে ভাবে এখনই তার বিয়ে করে সংসার করার উপযুক্ত সময়। সে আর দেরি করতে চায় না। অনেকদিনের লালিত স্বপ্নকে সে বাস্তবে রূপ দিতে চায়। তার দুর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের মেয়ে আলো। সে এখন ম্যাচিউরড। ঠিক এই সময় বিয়ের প্রস্তাব দিলে তারা নিশ্চয় না করবে না। একদিন ছুটিতে গ্রামে এসে আলোকে দেখার মনস্থির করে। সময় করে মোটরবাইকটা নিয়ে ছুটে যায় রশিদপুরে। ক্লান্ত সূর্যটা তখন পৃথিবীকে বিদায় জানাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর সেই বিদায়ের নান্দনিক শোভা বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আলো উপভোগ করছে। ঠিক সেই সময় মিরান বাইকটা নিয়ে আলোর সামনে এসে দাঁড়ায়। লজ্জা নামক অলংকার আলোর চোখেমুখে নৃত্য করে। লজ্জাবতী গাছের মতো তনুর সকল অনুভূতি অবগুণ্ঠনে মুখ ঢাকতে শুরু করে। দু’একটি কথায় কুশল বিনিময় পর্ব শেষ হয়। বাড়ির ভিতরে আসার আমন্ত্রণ জানায় আলো। খালা-খালু বাসায় না থাকায় মিরান বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে না। উদ্দেশ্য সফল হওয়ায় কিছুটা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে মিরান বলে, “না, আজ আর যাব না। একটু কাজ আছে। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। আরেকদিন আসবো।”

অল্প সময়ের ব্যবধানে মিরান অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যায়। সে মনে মনে আলোকে যতটা সুন্দর মনে করেছিল তার চেয়ে ঢের সুন্দর। সারা অঙ্গ জুড়ে সৌন্দর্যের কারুকাজ। তাকে দেখে মিরানের মনে হচ্ছিল খোলা আকাশের নিচে ধরার বুকে সবুজ গালিচায় সদ্য নেমে আসা শ্যামবর্ণের লাস্যময়ী কোন এক পরি। অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে মিরান এতদিন যাকে স্বপ্নে খুঁজেছে। সেই স্বপ্ন কুমারীকেই মিরান আজ ধরার বুকে আবিষ্কার করল। তাকে কোনভাবেই হাতছাড়া করা যাবে না। দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বন্ধু রাহাতের সঙ্গে মিরান সব ঘটনা খুলে বলে। পরিচয় পেয়ে রাহাতের ভুল ভাঙ্গে আলোর অস্তিত্ব কাল্পনিক নয়। বন্ধুর জন্য রাহাত অকাতরে সবধরণের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। একজন ব্যাংকার হিসেবে মিরানও আলোর জন্য সুযোগ্য পাত্র। উভয় পরিবারের সম্মতিক্রমে পরিণয়ে তারা যুগলবন্দী হয়। যাকে বলে মনিকাঞ্চন যোগ।

জীবন যে এত সুন্দর হতে পারে মিরান আলোকে বিয়ে না করলে হয়তো তার সবটাই অজানাই থেকে যেত। অফিসের কাজে ঠিকমতো মন দিতে পারে না। ক্ষণে ক্ষণে চোখের সামনে আলোর মায়াবী মুখখানা ভেসে ওঠে। তাকে স্পর্শ করার জন্য মিরানের যানটা ছটফট করতে থাকে। আলোকে দেখলে মিরানের সারাদিনের ক্লান্তি মুহূর্তেই দুর হয়ে যায়। উপাদেয় নানান খাবারে ডাইনিং টেবিল সাজিয়ে আলোও মিরানের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এই পৃথিবীতে কোন ভালোলাগাই যেন বৃদ্ধ হয় না। যৌবনের তাদের মৃত্যু ঘটে। আলোর বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ইদানিং সবকিছুই কেমন যেন একঘেয়েমি লাগছে তার কাছে। কোনকিছুই ভালো লাগছে না। অনুভূতিগুলো কেমন যেন মৃতপ্রায়। মিরানের পরশে তারা আর জেগে ওঠে না। আলো যখন একাকী বসে থাকে গ্রিলে দাঁড়িয়ে বিশাল আকাশ পানে চেয়ে থাকে। মুক্ত বিহঙ্গের মতো স্বাধীনতাকে উপভোগ করার চেষ্টা করে। সবকিছু আলোকে কেমন যেন বন্দী করে রেখেছে। প্রথাগত সংসারের খাঁচা ভেঙে সে বাইরে বের হতে চায়। কিন্তু কীভাবে? মনের কাছে বার বার প্রশ্ন করেও কোন সদুত্তর পায় না। সে মনে মনে ভাবে মিরান যা কিছু করে সবই তার স্বার্থের জন্য। মিরানের কাছে আলোর ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোন গুরুত্বই নেই। তার সকল ইচ্ছা মিরানের কাছে ধুলিময় তৃণসম। যার স্থান শুধু পদতলে। আলো মনে মনে ভাবে- আমি এই সংসারে ফুলদানিতে সাজানো ফুল। ফুলের সৌরভ বেশিদিন টিকে থাকে না। দিন শেষে তাকে ছুঁড়ে ফেলা হয় ডাস্টবিনে। তাই যত দ্রুত সম্ভব আমাকে শৃঙ্খল মুক্ত হতে হবে। কিন্তু কে তাকে সাহায্য করবে? একসময় অবলীলাক্রমে মায়ের কাছে সব কথা শেয়ার করেছি। এখনও কি তাই করবো? ছি! ছি! এসব কী ভাবছি! মাকে কষ্ট দেওয়া কোনভাবেই ঠিক হবে না। বাবা-মা মিরানকে নিয়ে খুব গর্ব করে। তার মতো শান্ত-শিষ্ট ভদ্র ছেলে তারা জীবনে দ্বিতীয় কাউকে দেখেনি। অতিযত্নে তারা তাদের আদরের সন্তানকে মিরানকে উপহার দিয়েছে। এভাবে আকাশ-কুসুম ভাবতে ভাবতে আলোর এখন অধিকাংশ সময় পার হয়। অবশ্য শৃঙ্খল মুক্তির উপায় খুঁজতে তাকে খুব বেশিদিন কষ্ট করতে হয়নি। হঠাৎ একদিন সে তার গর্ভে স্বতন্ত্র অস্তিত্বের উপস্থিতি টের পায়। সেই উপস্থিতি সকল চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেয়। সব চিন্তা-চেতনাকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়। নতুন করে আলো আবার ভাবতে শুরু করে। আলোর ভিতরে যে প্রতিনিয়ত আঁধারের যুদ্ধ চলছে তা উপলব্ধি করার সক্ষমতা মিরান অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে। নতুন অতিথির ভালোমন্দের কথা ভাববার অবকাশ তার নেই। অনাগত অতিথির আসার সময় সন্নিকটে হলেও মিরান ক্ষান্ত হয় না। সে তনুর গন্ধে মাতাল বিবেক বর্জিত মহামানব। সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে কোন এক শুভক্ষণে আলো ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। সন্তানের মুখ পানে চেয়ে সে সব কষ্ট ভুলে থাকে। আগের চেয়ে আলোকে সংসারে আরো বেশি সময় দিতে হয়। আরো বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়। শিশির বিন্দুর মতো বেলা বাড়ার সাথে সাথে কোমরের শক্তিগুলোও যেন অদৃশ্য হতে চায়। শরীরটাকে ভালোবেসে নানান রোগব্যাধিও ইদানিং বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। তবুও স্বামী-সন্তান দু’জনকেই সমান তালে সামলিয়ে চলেছে। কাউকে কিছু বুঝতে দেয় না। শুকনো হাসির রেখা ক্ষণে ক্ষণে তার ঠোঁটে ফুটে ওঠে। সব কষ্ট বুকের মাঝে কবর দিয়ে আলো প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে থাকে সন্তানের অনাগত ভবিষ্যতের কথা ভেবে। সত্যিকারের আলোকিত জীবনের সুখানুভূতির প্রত্যাশায় একদিন হয়তো ক্ষান্ত হবে প্রতীক্ষার প্রহর গোনা। আলোর জীবন হবে আলোকিত। এভাবেই আলো-আঁধারের বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে চলতে থাকে দু’জনার জীবন চলার দুটি পথ।