ইকবাল কবীর মোহন
শুষ্ক উত্তপ্ত মরুভূমি। প্রচণ্ড খরতাপ। সূর্য ওঠা মাত্রই ঝলসানো রোদ ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। সহসাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে গোটা আরব ভূমি। প্রতিটি বালুকণায় যেন আগুনের ফুলকি চোখে পড়ে। সূর্য যত এগিয়ে চলে বেড়ে যায় তাপের মাত্রাও। তাপের প্রচণ্ডতায় মানুষ হয়ে পড়ে দিশেহারা। নীল আকাশেও যেন আগুনের লেলিহান ছড়িয়ে পড়ে। ফলে তৃষ্ণার্ত হয় মানুষ। পানির তাড়নায় বুক ফেটে যায়।
কিন্তু পানি পাবে কোথায়? সর্বত্রই যে পানির স্বল্পতা। তাই পানির জন্য সর্বত্র পড়ে যায় হৈ চৈ হাহাকার। পানির সঙ্কট মদিনায়ও প্রকট। মাত্র গুটিকতেক কুয়ো আছে মদিনায়। সারা শহরজুড়ে হাতেগোনা কয়েকটি কুয়োই মানুষের সম্বল। কোনো রকমে তৃষ্ণা মেটাতে সবাই ছুটে যায় ঐসব কুয়োর দিকে। তার মধ্যে মিনায় ছিল ব্যতিক্রমী এক কুয়ো। নাম রুমা। সবার নজর এ কুয়োটির দিকে। কেননা, রুমা কুয়োর পানি সুস্বাদু ও বিশুদ্ধ। রুমার পানি সবার বুক জুড়িয়ে দেয়।
তাই রুমা কুয়োর পাড়ে সর্বদা ভিড় লেগেই থাকে। সারা শহরের মানুষ ভেঙে পড়ে রুমার পাড়ে। জাত-ধর্ম কোনো ভেদাভেদ নেই। মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইহুদি সবাই এখানে আসে পানি তুলতে। তবে মুসলমানরা রুমার পানি খুব একটা পায় না। অথচ অন্য সবাই রুমার পানি পেতে তেমন কষ্ট হয় না। ফলে মুসলমানদের অবস্থা হয়ে ওঠে দুঃসহ। রুমা কুয়োর মালিক ছিল ইহুদি। সে মুসলমানদের পছন্দ করত না। বরং সে ইহুদিদের প্রাধান্য দিত। তাই সে নিয়ম করে দিল, আগে ইহুদিরা কুয়ো থেকে পানি তুলে নেবে-তারপর অন্যরা পানি পাবে। এর বিনিময়ে সে পয়সা আদায় করত।
কিন্তু মুসলমানদের কাছ থেকে পয়সা নিয়েও তাদের কোনো সহযোগিতা করত না ইহুদি। তাছাড়া মুসলমানদের অনেকেই ছিল গরিব মানুষ। তাই রুমা কুয়োর পানি তাদের অনেকের ভাগ্যে জুটত না। মুসলমানদের এ করুণ অবস্থান কথা মহানবী (সা)-এর কানে গেল। পিপাসার্ত মুসলমানদের দুর্দশার কথা শুনে তিনি বেশ কষ্ট পেলেন। তাই নবী (সা) ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। কিভাবে মুসলমানদের এ দুঃখ লাঘব করা যায়, এই চিন্তায় মহানবী (সা)-এর মন অস্থির হয়ে উঠল।
একদিন তিনি মসজিদে নববী থেকে ঘোষণা করলেন, ‘কে এমন আছেন যিনি রুমা কুয়োটি কিনে মুসলমানদের জন্য খুলে দেবেন? তিনি আরও বললেন, ‘আমাদের মধ্যে যে কুয়োটি কিনবে, জান্নাতে সে তার চেয়ে অনেক ভালো জিনিস পুরস্কার পাবে।’ মহানবী (সা)-এর কথা শুনে অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠলেন। তবে কুয়োটি কেনার সামর্থ্য সবার ছিল না। মসজিদে সেদিন উপস্থিত ছিলেন হজরত উসমান (রা)। নবীজী (সা)Ñএর ঘোষণা শুনে তিনি কুয়োটি কেনার ইচ্ছা পোষণ করলেন।
তারপর তিনি কুয়ো কেনার জন্য ইহুদির কাছে প্রস্তাব পাঠালেন। ইহুদি লোকটি ছিল খুবই লোভী মানুষ। সে প্রথমে প্রস্তাাবে রাজি হলো না। কেননা, এটা তার আয়-উপার্জনের বড় উৎস ছিল। হজরত উসমান (রা) অনেক কথাবার্তা বললেন ইহুদির সাথে। অথচ সে কোনক্রমেই কুয়োটি হাতছাড়া করতে চাইল না। অবশেষে হজরত উসমান (রা) এক লোভনীয় প্রস্তব পাঠালেন। এবার সে আর লোভ সামলাতে পারল না। চার হাজার দিরহামের বিনিময়ে ইহুদি লোকটি কুয়োর অর্ধেক বিক্রি করতে সম্মত হলো। হজরত উসমান (রা) তাতেই রাজি হয়ে গেলেন। অথচ পরক্ষণে তিনি ভাবলেন, অর্ধেক কুয়ো নিয়ে ভবিষ্যতে মুসলমানরা সমস্যায় পড়তে পারে। কেননা, কুয়োতে মুসলমানরা অর্ধাংশের মালিক হবে। ফলে পানি তুলতে গিয়ে নির্ঘাত ঝগড়া বাধবে। বাস্তবে সমস্যাও হলো। পানি তোলা নিয়ে ইহুদি ও মুসলমানরা প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হলো। এতে গোলমাল বেধে গেল। এই গোলমাল শেষতক বিবাদের রূপ নিলো।
অনেক ভেবেচিন্তে দুই দলের মধ্যে একটা আপসরফা করা হলো। ঠিক করা হলো, কুয়ো থেকে একদিন পানি নেবে ইহুদিরা আর একদিন নেবে মুসলমানরা। এভাবে কিছুদিন ভালো ভালোই চলল। কিন্তু এতেও সমস্যা থেকেই গেল। বিরোধও মিটল না। সমস্যা হলো ইহুদিদের নিয়ে। এরা ছিল অতি লোভী, হিংসুক ও অবিবেচক।
ইহুদিরা পানি তোলা নিয়ে চালাকি করত। ইহুদিদের যেদিন পানি তোলা থাকত, তারা সেদিন বেশি করে পানি নিয়ে যেত। পরের দিন মুসলমানরা যাতে পানি কম পায় সেই জন্যই তারা এই চালাকি করত। ফলে পরের দিন মুসলমানরা যা পানি পেত তা দিয়ে তাদের প্রয়োজন মিটত না। এভাবে অল্প পানি দিয়ে চলছিল কিছুদিন। অথচ মুসলমানদের সমস্যা থেকেই গেল।
এদিকে ইহুদি মালিক দেখল কুয়ো থেকে তেমন আয়-রোজগার আর হচ্ছে না। তাই সে কুয়োটির বাকি অংশও বিক্রি করতে সিদ্ধান্ত নিলো। ইহুদির ইচ্ছার এ খবর হজরত উসামান (রা)-এর কানে গেল। আর যায় কোথায়? উসমান (রা) তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলেন। তিনি আট হাজার দিরহামের বিনিময়ে কুয়োটির বাকি অংশ কিনে নিলেন। মুসলমানদের পানি পেতে আর কোনো অসুবিধাই থাকল না। তারা সুস্বাদু ও মিষ্টি পানি পান করার অপূর্ব সুযোগ পেয়ে গেল। এদিকে মহানবী (সা)-এর ইচ্ছা পূরণ করে উসমান (রা) যারপরনাই খুশি হলেন। উসমান (রা)-এর কাজে রাসূল (সা) অত্যন্ত খুশি হলেন।
হজরত উসমান (রা) এভাবেই ইসলাম ও মুসলমানদের খেদমতে তার অর্থ সম্পদ ব্যয় করেছেন। কল্যাণের কাজে অর্থ ব্যয়ের প্রতিযোগিতায় তিনি সব সময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয়ে হজরত উসমান (রা) যে অবদান রেখে গেছেন তার কোনো তুলনা হয় না।