গল্প
অন্তিম জ্যোৎস্নায়
অন্ধকার রাত্রী, থমথমে পরিবেশ। মাঝেমধ্যে ঝিঁঝিঁ পোকারা তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। এমন রাতে বেশিরভাগ মানুষ আকাশের সাথে বিলাপ করে, কথা পাঠায় আকাশের বুকে। আকাশকে দুঃখবোধের রাফখাতা বানায়। রায়হান সাহেবও তার ব্যতিক্রম নয়।
Printed Edition

মিলাদ হোসেন সুজন
অন্ধকার রাত্রী, থমথমে পরিবেশ। মাঝেমধ্যে ঝিঁঝিঁ পোকারা তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। এমন রাতে বেশিরভাগ মানুষ আকাশের সাথে বিলাপ করে, কথা পাঠায় আকাশের বুকে। আকাশকে দুঃখবোধের রাফখাতা বানায়। রায়হান সাহেবও তার ব্যতিক্রম নয়। ছ’তালার ইট পাথরে ঘেরা বিশাল বাড়িতে একাকিত্বের সঙ্গী কেবল আকাশ আর আকাশের বুকে পাহারায় থাকা শশী। কোনো কিছুর অভাব নেই রায়হান সাহেবের। যখন যা প্রয়োজন চাওয়ার আগেই পেয়ে যান। পরিবারের সবাই আমেরিকায় সেটেল্ড হয়ে গেলেও রায়হান সাহেব জন্মভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য নয়।
দেশের মাটি কামড়ে ধরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চান। বয়স হলে মানুষরা যে এভাবে সঙ্গহীন হয়ে পড়ে তা আগেই অবলোকন করতে পারতেন রায়হান সাহেব।
তাই নিজের মন ভালো রাখার জন্য দেয়ালে দোয়ালে সাজ সজ্জার কোনো কমতিও রাখেন নি। তবুও যেন মনে আনন্দ নেই, সুখ নেই। বিশাল বাড়িতে উপর তলার এক কোনায় ছোট একটি রুমেই কাটে রায়হান সাহেবের বেশিরভাগ সময়। বাকি পুরো বাড়িটায় থাকে ভাড়াটিয়া। দূর সম্পর্কের এক ভাগনে বাড়িটা দেখাশোনা করে। যখন যা প্রয়োজন পড়ে রায়হান সাহেবকে এনে দেয়। মাঝেমধ্যে রায়হান সাহেবের কর্মকাণ্ডে ভাগনে জিয়াউদ্দিন আশ্চর্য হয়। এইতো ক’দিন আগে ব্যাংক থেকে বিশাল পরিমাণ অর্থ তুলে দিলেন একটা মসজিদ নির্মাণের জন্য। অথচ সে অর্থ যে রায়হান সাহেব দান করেছেন তা কেউ জানতে পারেনি। কখনো এতিমখানায় সাহায্য করেন, কখনোবা আশ্রম, কিংবা অসহায় পরিবারে। এই সহযোগিতার মাধ্যমে নাকি তিনি একটু আধটু সুখ অনুভব করেন। কিন্তু সে সুখ স্থায়ী হয় না।
আসলে মানুষের যখন বয়স বাড়ে বৃদ্ধ হয় তখন মানুষ শিশুদের মতো অবুঝ হয়ে যায়। অকারণেই কান্না করে। মনের অবস্থা ভালো থাকে না। এই নিয়মটা হয়তো আল্লাহ প্রদত্ত। হয়তো কেন! আসলেই এটি আল্লাহর সৃষ্ট একটি উত্তম সময়।
এমন সময়ে রায়হান সাহেবের নিঃসঙ্গতাও যেন প্রবল বেদনার সৃষ্টি করে। রায়হান সাহেব একসময় মস্ত বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যবসার খাতিরে হাজার হাজার লোকের সাথে পরিচয় ছিলো। কতই না ব্যস্ত সময় পার করতেন। কিন্তু আজকাল সময় পার করার সময় থাকলেও আশেপাশে মানুষ নেই। বুকের ভেতর আনন্দ নেই। কেমন যেন বিষাদের শহরে বসবাস করছেন।
রায়হান সাহেব বেশিরভাগ সময়ই রুমের দক্ষিণের বারান্দায় বসে কাটান। কখনো পত্রিকার পাতায় চোখ বুলাতে থাকেন, কখনো মনের ব্যকুলতাগুলো ডাইরিবদ্ধ করেন। আবার কখনো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন যান্ত্রিক শহরে। আকাশের বুকে উড়ে চলা পাখির আনন্দ দেখেন। মনে মনে আক্ষেপ করেন, কেন পাখি হয়ে জন্মালাম না। মানুষ হলাম কেন? মানুষের তো সুখ চিরস্থায়ী নয়। এই বারান্দার কোণে ঘর বাঁধা চড়ুইয়ের মতো যদি হতে পারতাম, তবে এতো দুঃখ থাকতো না। একাকিত্ব থাকতো না। আমার মতো কোনো দুঃখী মানুষ আমাকে দেখতো আর সেও আফসোস করতো। আসলে আমাদের জীবন কখনো রঙিন আবার কখনো রংহীন ফ্যাকাসে।
রায়হান সাহেব চড়ুই পাখিটির সংসার দেখে একটু ব্যথিত হন। মনে মনে নিজের সংসারের কথা ভাবেন। অর্ধাঙ্গিনী জ্যোৎস্নার সাথে দুই হাতে বাঁধা সংসার ভালোই ছিলো। তখন টাকার পিছু সাঁতার কাটতে কাটতে একদিন ব্যথার সাগরে ডুবে যাবেন কখনোই ভাবতে পারেননি। আসলে টাকাইতেই যে সুখ পাওয়া যায় তা চরম মিথ্যা একটি প্রবাদ। টাকায় সবকিছু পাওয়া গেলে রায়হান সাহেবের মতো একজন মানুষ কেন সুখী নয়। কেন বেদনার সাগরে সাঁতরাতে হয় দিবসের পর দিবস। রায়হান সাহেব কল্পনা করেন তিনি ব্যবসার কাজে ডুবে থাকতে স্ত্রী জ্যোৎস্নার কল ছিল বিরক্তিকর। বাসায় এসে স্ত্রীকে সাজগোছ অবস্থায় দেখলে নীতিবাক্য শুনিয়ে এড়িয়ে যাওয়া ছিল স্বভাব। খাবার টেবিলে বসে একটু দেরি করে গল্প মেতে উঠার সময়টুকু ছিল কারণহীন। কারণ মানুষ টাকাতে ডুবে গেলে ঢাকা পড়ে যায় ভালোবাসার মতো কোমল অনিন্দ্য সুন্দর সময়। মানুষের মস্তিষ্কে ভালোবাসা হয়ে যায় বিরক্তিকর কারণ। অথচ সেদিনের সেই বিরক্তিকে আজ রায়হান সাহেব খুব করে খুঁজে বেড়াচ্ছেন ।
বিদেশ থেকে ছেলে মেয়েরা কল দিলেও শুনতে পান না, “ওগো তুমি কখন বাসায় ফিরবে” এমন শব্দ। কারণ সংসার আলোকিত করা জ্যোৎস্না যে আর আলো বিলাতে পারবে না। ছ’বছর আগে সে নিজেই নিভে গেছে। সাথে নিভিয়ে গেছে রায়হান সাহেবের ব্যস্ততম সময়কে। দরকার ছাড়া ছেলে মেয়েরা তেমন কথা বলে না। দীর্ঘ সময় কথা বলতে চাইলেও তাদের সময় হয়ে উঠে না। মানুষ এমনই! হারিয়ে যাওয়ার পর হারিয়ে যাওয়া সময়ের কদর বুঝে।
আজ আকাশে জ্যোৎস্নার ছড়াছড়ি। রায়হান সাহেব আজ মনের সমস্ত ব্যথাগুলো আকাশের বুকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। জ্যোৎস্নার কাছে, জ্যোৎস্নাও যেন বেশ সময় নিয়ে কথাগুলো শুনেছে। রায়হান সাহেবের মন বেশ অশান্ত লাগছে। পাথরের মূর্তির ন্যায় বেতের বানানো বিশাল চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে কেঁদে যাচ্ছেন। পাশেই জিয়াউদ্দিন খাবার রেখে গেছে সন্ধ্যায়। এখনো খেয়াল নেই। বুকের ভেতরে যেন তাণ্ডব সৃষ্টি হয়েছে। যখনই অতীতের খাতায় পাতা উল্টান তখনই এমন হয়। দু’চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে। হুটহাট ডাইরি টেনে সবকিছু লিখে রাখেন। সাথে অশ্রু দিয়ে ভিজিয়ে রাখেন ডাইরির পাতা তিনি। বিশ্বাস করেন নিজের দুঃখবোধের গল্পগুলো কেউ একজন পড়বে, জীবনকে বুঝবে। শুধু টাকার পিছে না সাঁতরায়ে হাসিখুশি আনন্দে ক্ষুদ্র এই জীবনকে উপভোগ করবে।
জীবনে উপভোগ করার মতো খুব সিমিত সময় পাওয়া যায়। এই সিমিত সময়কে লুফে নিয়ে পৃথিবীর সবচে সুখী মানুষ হয়ে বাঁচবে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় রায়হান সাহেব স্তব্ধ হয়ে যান।
এক সময় রাতের জ্যোৎস্না বিলীন হয়ে যায়। মুয়াজ্জিনের আহবানি ধ্বনি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু রায়হান সাহেবের কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না। সামনেই পড়ে থাকে অসমাপ্ত ডাইরি আর সাথে কিছু ব্যথাময় অশ্রু।
জ্যোৎস্নার সাথে রায়হান সাহেবও বক্ষভরা ব্যথা নিয়ে বিলীন হয়ে যান। টাকা, সাম্রাজ্য, যশ, খ্যাতি সবকিছু পড়ে থাকে যার যার জায়গায়।