মোহাম্মদ অয়েজুল হক

ঠিক কতোরাত অনুমান করতে পারে না মারুফ। গতরাতে ঘুম হয়নি। সামান্য একটু বৃষ্টি, তাতেই কারেন্ট অফ সারারাত। লোডশেডিং হোক তাই বলে সারারাত? কয়েকদিন টানা বৃষ্টির পর হুট করে ভ্যাপসা গরম। কারেন্ট না থাকায় মশার উতপাত বেড়েছে। মশা তাড়ানোর ইলেকট্রিক ফুয়েল, ফ্যানের তীব্র বাতাস মশাকে নিশ্চিত গন্তব্যে পৌঁছাতে বাধা সৃষ্টি করে। এগুলো সব বন্ধ। সুযোগ বুঝে মশার দল ঝাঁকে ঝাঁকে মিছিল করে ঘরে ঢুকে সুরে বেসুরে গলায় গান করে। বিদ্যুৎ অফিসে ফোন করলে ওনারা বলেন, লাইন ফল্ট। এরপর ফোনের পর ফোন। শুধু বিজি টোন শোনা যায়। শেষরাতের দিকে সৌভাগ্যক্রমে কল যায়। ভাই কি সমস্যা আপনাদের? সেই একই কথা। লাইন ফল্ট কাজ চলছে।

- কি ফল্ট?

- লাইন ফল্ট।

- কিসের লাইন? লাইনের কি শেষ আছে মিয়া। মারুফের মেজাজ গরম। গ্যাস লাইন, পানির লাইন, ডিশ লাইন, ফোন লাইন, মোবাইল লাইন, প্রেম লাইন। বাথরুমে গোসল করতে গেলাম পানি নাই। তাদের লাইন ফল্ট। ফেসবুকে বন্ধুর সাথে কথা বলবো নেটওয়ার্কের লাইন ফল্ট। ফোনের পর ফোন বিজি। লাইন ফল্ট। ওদিকে মশার ঝাঁক ঠিকই লাইন দিয়ে আসছে। গান করছে, রক্ত খাচ্ছে।

লোকটা যেন থেঁতো মুখে একটা কথাই বলতে পারে। কয়েক শব্দের বাক্য। আবার বলে, লাইন ফল্ট কাজ চলছে।

- এই ব্যাটা রাতভর লাইন ফল্ট! কাল থেকে গরুর খামারে যাবি। ঘাস কাটবি বুঝলি। ঘাস। দেশ ও দশের উপকার হবে।

ওপাশ থেকে খট করে লাইন কেটে দেয়।

হাসফাস করে সময় কাটে। সকালে অফিস। সারাদিন অফিস করে বাড়ি ফিরে ঘুম। একঘুমে রাত। কতোরাত! মোবাইল টা কোথায় কে জানে! পাশের রুমে মিতা। লাইট জ্বলছে। নড়েচড়ে বসতেই একঝাঁক মশা পিন পিন শব্দে উড়ে যায়। মিতা ওই মিতা। মারুফ ডাকে।

মিতা ছুটে আসে। বেসুরে গলায় বলে, কি হয়েছে ভাইজান?

এই মেয়েটা দিন দিন কেমন যেন বোধজ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। মাঝেমাঝে উদ্ভট উদ্ভট কথা বলে। ডাকতে ডাকতে এক প্যাকেট স্যালাইন পরিমাণ ঘাম শরীর থেকে বেরিয়ে গেলেও সাড়াহীন। দেখা যায় রুমেই আছে। একটা ডাইরি খুলে কবিদের মতো উদাস ভঙ্গী। ছাদে মাকড়শা যে জাল বুনেছে অথবা একটা টিকটিকি ডাকছে সেদিকে তাকানো। মারুফের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী। তার রুমের পর বাবা-মায়ের রুম। প্রতিবেশীর আচরণ প্রতিবেশী সুলভ না হলে বসবাস করা কঠিন। আজ অবশ্য ডাক দেয়ার সাথে সাথে ছুটে এসেছে।

- কি আর হবে! এই যে আমি অফিস থেকে এসে বেহুঁশের মতো পড়ে রইলাম।

- দেখেছি। ঘুমাচ্ছিলে। কাল রাতে ভাল ঘুম হয়নি এজন্য আর ডাকিনি।

- এই যে একঝাঁক মশা কিলবিল করে উড়ে গেল। কতো রক্ত খেয়েছে কে জানে! আমি তো ব্লাডব্যাংক খুলে বসিনি।

- তা আমি কি করবো?

- সন্ধ্যার সাথে সাথে স্প্রে, মশা মারা ইলেকট্রিক ফুয়েল প্লাগে দেয়া, বারান্দায় মশার কয়েল জ্বালানো, মশারী টানিয়ে দেয়া। কটা কাজ?

- আর?

- আর কি! এ কাজগুলো করলে কি এতোগুলো মশা এসে রক্ত খেয়ে যেতে পারতো?

- মশারা কি খাবে না! বাঁচবে না?

- ধুর ছাই। এজন্যই তো তোকে দেখলে আমার মেজাজ গরম হয়। সৎ বোন সেও এতোটা নিষ্ঠুর হয় না। যা ভাগ।

-ইস, আমার যেন থাকতে বয়েই গেছে। মুখ ঝামটি দিয়ে চলে যায় মিতা।

ইলেকশন হলো। নতুন নতুন মেয়র। বিজয়ীরা কি করবেন কে জানে? মশা, পানিজমা, সড়ক দুর্ঘটনা কতো সমস্যা। জনগণ সমাধান চায়। এই যে মশা নিয়ে মারুফের এতো ভোগান্তি। দশজন মানুষ থাকলে মশা কাউকে না কামড়িয়ে মারুফকে এসে ধরবে। আজকাল মশাকেও হেলাফেলা করা যাচ্ছে না! ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া কি সব অদ্ভুত নামের মশা বের হয়েছে। কামড়ে মানুষের মৃত্যু পযর্ন্ত হয়! সামনে কেউটে মশা, গোখরা মশা বের হবে কিনা কে জানে। সেদিন একজন বলেই ফেলে, ভাইজান আপনাকে তো সিটি কর্পোরেশন থেকে পুরস্কার দেয়া উচিত।

মারুফ অবাক হয়ে জানতে চায়, কেন!

-মশা মারতে কয়েকদিনে আপনার যে প্রচেষ্টা দেখলাম! সত্যিই অসাধারণ।

-পুরস্কার দেবে! মশা ভাজি করে সবার গালে তুলে দেবে অপেক্ষা করেন।

মারুফ কি এমন করেছে! ড্রেনের মশা মারতে প্রথম কয়েকদিন কেরোশিন ছিটিয়েছে। খুব একটা কাজ হয়নি। মাশার কিছু ডিম্বাণু নষ্ট হলেও বাচ্চা মশাগুলো চোখের সামনে দিয়ে উড়ে যায়। কিলবিল করে ধরে। এরোসল কিনে ব্যবহার করেও ফল কিছু হয়নি। সারা শহর মশায় ভরা। কতো যায়গায় স্প্রে করবে! চারটে মশা মারা ইলেকট্রিক ব্যাট কিনেছে। কদিন বাদেই ব্যাটগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দু’একটা মশা মরলেও শব্দ হচ্ছে না। আর যাইহোক দাবড়িয়ে মশা মারা যে কতো কষ্টকর সেটা মারুফ ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। একজন বলে, সব যায়গয় ফেনাইল দেন। কাজ হবে। চার ড্রাম, কুড়ি লিটার ফেনাইল হালকা পানিতে মিশিয়ে ড্রেন, আশপাশের মশা থাকা সম্ভাব্য সকল স্থানে মন ভরে ছড়ায়। সেদিন রাতে মশার কি হয়েছিল কে জানে! ফিনাইল ছোঁয়া কটূ গন্ধের বাতাসে বাড়িসুদ্ধ মানুষের দম বন্ধ হয়ে মরার মতো অবস্থা। সিটি কর্পোরেশনের কোন উদ্যোগ তার শহরে চোখে পড়ে না। অন্তত তার ওয়ার্ডে নেই। নতুন নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কাজ করবেন। আশা করা যায়। তাদের শুভেচ্ছা জানাতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস লেখে মারুফ, নির্বাচিত সকল প্রতিনিধিকে শুভেচ্ছা। তারা মশা সমস্যা আর সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর ব্যাপারে সচেষ্ট হবেন। অবশেষে, শুভ রাত্রি।

সাথে সাথেই শুভ বেচারা ম্যসেজ দেয়, হ্যা ভাই বলেন।

- কি বলবো!

- আমাকে নিয়ে স্ট্যাটাস দিলেন খুশি হয়েছি, কিন্তু রাত্রির সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই, ইভেন আমি তাকে চিনি না...........

মারুফ হাসিতে গড়াগড়ি দেয়। ঠিক আছে যাও তোমার কথা বিশ্বাস করলাম।

- থ্যাংক ইউ ভাই।

একটু পরেই আবার ইনবক্সে নক করে শুভ। ভাই কেমন আছেন?

- এই তো মশা মাছি নিয়ে আছি।

- আচ্ছা ভাই একটা কথা বলি।

- হ্যা, বলো।

- ভাই রাত্রি মেয়েটা আসলে কে!

- খুব কালো। মাঝেমধ্যে চাঁদের আলোয় মায়াবী হয়। মারুফ হাসে। ঠিক কপালের ওপর একটা মশা এসে পড়েছে। সেটা তাড়াতেই পিঠে আরেকটা। মারুফ সজোরে হাত চালায়। হাতটা তুলতুলে কিসে গিয়ে আঘাত করে। সেই সাথে পেছনে ফ্লোরের ওপর গুড়ুম করে শব্দ। মশা পড়লে কি গুড়ুম শব্দ হয়! ঘ্যা ঘ্যা করে কেঁদে ওঠে মিতার ছোট ছেলেটা।