জোবায়ের রাজু

টুটুল তামান্নাকে প্রথম আবিষ্কার করে ফেসবুকে। তখনও জানা ছিল না ওরা একই জেলার নাগরিক। জেলা শহরের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নৃত্য পরিবেশন করতে প্রথম তামান্নাকে দেখে সে নিশ্চিত হল তারা একই জেলার মানুষ। নাচের মঞ্চে প্রথম তামান্নাকে দেখে টুটুল হাতেনাতে প্রমাণ পায় এই মেয়ে মোবাইলে ফেসবুকের ভেতর থেকেও বাস্তবে দেখতে মন ভরানো সুন্দরী। টানা টানা চোখের পলকে যেন ময়ূরের পেখম নাচে।

তারপর থেকে নিয়মিত ফেসবুকের নক করে গেল তামান্নাকে। ইনিয়ে বিনিয়ে অনেকবার বোঝাতে চেয়েছে ‘তুমি কি আমার হবে!’

কিন্তু টুটুলের ইশারা ইঙ্গিত বুঝতে পারত না বলে তামান্নাকে একদিন মেসেজ লিখে পাঠায়, ‘ভালো লাগে তোমাকে।’ মেসেজের রিপ্লাই না পাঠিয়ে সরাসরি মেসেঞ্জারে ফোন করে সুদর্শণা তামান্না।

- কেন আমাকে তোমার এত ভালো লাগে?

- তুমি সুন্দর, তাই।

- বিয়ে করবে আমাকে?

- করব।

- পেশা কি তোমার?

- চাকরি খুঁজছি।

- উঁহু। বেকারকে বিয়ে করে মাছে ভাতে মরব না।

- অসীম সুখে রাখব তোমায়।

- বেকারদের সুখ হচ্ছে কাল্পনিক অনুভব। আমার বড় ভাই যখন বেকার ছিল, তাকে ভালোবেসে যে মেয়েটা এক কাপড়ে আমাদের সংসারে চলে এসেছে, অবশেষে সে স্বামীর বেকারত্বের কাছে বলি না হয় ফিরে গেল নিজের বাড়ি। দুজনের সম্পর্কের সমাধান হয় গিয়ে তালাকনামায়।

- আমাকে এত যুক্তি দেখাতে চাও কেন?

- যুক্তি নয় তো, লজিক। তুমি দেখতে সুন্দর। প্রেমে পড়ার মতো ঐশ্বরিক আবেদন তোমার চেহারাতে আছে। কিন্তু তুমি আমার জন্য উপযুক্ত নও।

- কেমন পাত্র চাই তোমার?

- অবশ্যই পয়সাওয়ালা। ইউরোপীয় বা আমেরিকান।

তামান্নার জবাবে লজ্জা পেয়ে গেল টুটুল। এতক্ষণ সে যতগুলো কথা বলল, কোনো কথাকেই যেন অগ্রাহ্য করা চলে না। তামান্না রূপ সৌন্দর্যের বিনিময়ে হয়ত ইউরোপিয়ান বা আমেরিকান পত্র ডিজার্ভ করে, কিন্তু টুটুলের অনুভবের বাগিচাতে তামান্না যে প্রতিনিয়ত ফুলপরী হয়ে রঙিন পাখনা দুটো মেলে ধরে, সেটাকে চেপে রাখা বড় দুষ্প্রাপ্য টুটুলের জন্য।

দিন দিন ভালো যোগাযোগে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ওরা। টুটুলের কোনো মেসেজের রিপ্লাই না দিলেও তামান্না নিয়মিত টুটুলের পোস্ট করা স্ট্যাটাস বা ছবিতে লাইক কমেন্ট দিতে ভুল করে না। এক সময় মেসেঞ্জারে তামান্নার এক তরফা নীরবতা দেখে টুটুল আর মেসেজ পাঠায় না।

২.

অনেক মাস পর আচমকা এক বিকেলে টুটুলকে মেসেজ পাঠায় তামান্না, ‘আমাকে কল করবে?’

বিলম্ব না করে টুটুল কল দেয়। কিন্তু কল যায় না।ইন্টারনেটের ডাটা অফ। বিশ মিনিট পর ওপার থেকে মেসেজ আসে, ‘টুটুল, আছো?’ মেসেজের রিপ্লাই নয়, কল দেয় টুটুল।

- তুমি কি এখনো বেকার টুটুল?

- হুঁ। জব তো পাইনি। জবের জন্য অনেক লড়াই করছি।

- আগামীকাল তো আমার বিয়ে।

- ইয়ে মানে...

- তুমি কি আমাকে অভিনন্দন জানাবে না?

- সত্যি সত্যি বিয়ে?

- বিয়ে কি মিথ্যে মিথ্যে হয় নাকি বোকা! আচ্ছা শোনো, তুমি কি আমাকে নিয়ে পালাতে পারবে?

- মানে?

- কোনো মানে নেই। পালাতে পারবে কিনা সেটা বলো।

- কিন্তু তোমার যে কাল বিয়ে?

- তুমি একটা অপদার্থ। যাই হোক, আমার ভালো ঘরে বিয়ে হচ্ছে। ছেলে আমেরিকার নাগরিক। আমাকে ওখানে নিয়ে যাবে। কিন্তু ছেলেটাকে আমার পছন্দ হয়নি। বয়স বেশি, জল্লাদের মতো চেহারা, মাথায় টাক, যে ক’টা চুল আছে, তাও সাদা। আবার ইয়া বড় একটা পেটও আছে।

- তুমি কি আমার সঙ্গে তামাশা করছো?

- নো। নেভার। তুমিতো অপদার্থ। তাই বিশ্বাস করো না। তোমার বিশ্বাস করা না করা দিয়ে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আচ্ছা তুমি এক কাজ করো, একটু পর আমি পার্লারে যাব গায়ে হলুদের জন্য সাজতে। বরের বাড়ি থেকে গায়ে হলুদের জন্য যে শাড়িটা পাঠানো হয়েছে, সেটা অনেক দামী। কিন্তু আমি এই দামী শাড়িটি পরব না। তুমি আমার জন্য একটা হলুদ শাড়ি নিয়ে পার্লারে এসো। সস্তা দরের হলেও চলবে। দামী শাড়ি কেনার সামর্থ্য তো তোমার নেই। তুমি যে বেকার।

- তামান্না, এভাবে কেউ তামাশা করে? কি হয়েছে তোমার? তোমার কি সত্যি সত্যি বিয়ে?

- সত্যি সত্যি বিয়ে নাকি মিথ্যে মিথ্যে বিয়ে, তোমাকে সেসব কৈফিয়ত দিতে হবে না। তুমি শুধু আমার জন্য একটা হলুদ কালারের কম দামী গায়ে হলুদের শাড়ি নিয়ে পার্লারের নিচে আসবে। এসে আমাকে কল দিবে। আমি পার্লারের কোনো মেয়েকে নিচে পাঠিয়ে দেব। পার্লারের নাম হচ্ছে- সাজ বিউটি পার্লার।

তামান্না লাইন কেটে দেয়। টুটুল বুঝতে পারে তামান্নার শেষের কথাগুলো খুব আবেগঘন শোনাল এবং কন্ঠ ছিল কান্নারত। দ্রুত তামান্নার টাইম লাইন চেক করে দেখে ঘটনা সত্যি। তামান্নার কাজিনরা তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বিভিন্ন পোস্ট করেছে তামান্নার টাইমলাইনে। তারমানে সত্যি সত্যি তামান্নার বিয়ে? অনায়াসে চোখ ভিজে যায় টুটুলের।

৩.

সন্ধ্যার পর কম দামের একটা হলুদ শাড়ি নিয়ে সাজ বিউটি পার্লারের নিচে এসে তামান্নাকে কল দেয় টুটুল। কিছুক্ষণ পর পার্লার থেকে একটা মেয়ে নিচে আসে, যাকে তামান্না পাঠিয়েছে। টুটুল মেয়েটির হাতে গায়ে হলুদের শাড়ির প্যাকেট দিতেই মেয়েটি টুটুলের হাতে একটা চিরকুট দেয়। সেখানে লেখা, ‘আমেরিকার ওই জল্লাদের সাথে বাবা আমাকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে। দিন তারিখ ঠিক হবার পর শুধু কেবল তোমার কথাই মনে পড়ছে বারবার। ইচ্ছে করলেই আমি তোমার কাছে চলে আসতে পারতাম। কিন্তু তোমার বেকারত্ব আমার পায়ের শিকল বেঁধে দিয়েছে অদৃশ্যে। আমি আসতে পারিনি তোমার কাছে। তোমার বউ হতে পারেনি বলে হয়তো সারা জীবন আমি কষ্ট পাব। তাই মনে হল আমার বিয়ের বিশেষ কোনো অংশে তোমার অবদান থাকুক। এজন্য গায়ে হলুদের শাড়িকে বেছে নিয়েছি। বেনারসি চাইতে পারতাম, কিন্তু সেটা কেনার ক্ষমতাতো তোমার মতো বেকারের নেই।’

টুটুল কাঁদছে। কান্নার সাথে তার যোগাযোগ নেই। শেষ কবে কখন কেঁদেছে, সেটাও মনে করতে পারছে না। তবে এই কান্না তার আজীবন মনে থাকবে। এই চিরকুটের কয়েকটি লাইন তাকে এভাবে কাঁদাবে, ভাবতে পারেনি। হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে। একটা আননোন নাম্বার। রিসিভ করে টুটুল৷ ‘অভিনন্দন, আপনি আমাদের কোম্পানিতে গত সপ্তাহে যে ইন্টারভিউ দিয়েছেন, আমরা আপনাকেই মনোনীত করেছি। অনেক গবেষণার পর মনে হল আমাদের চাহিদা অনুযায়ী আপনিই যোগ্য। বেকার জীবনের ইতি টেনে আপনি আমাদের কোম্পানিতে যোগদান করবেন, এইটুকু আশা করি।’

বেকারত্বের বিষবাষ্পের দম আটকে থাকা টুটুলের চাকরি হচ্ছে জেনেও এই মুহূর্তে সে হাসতে পারছে না। তার হাতের চিরকুটটির দিকে তাকিয়ে সে চোখের জলকে আটকে রাখার চেষ্টাতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। হায়রে বেকারত্ব! এই চাকরিটা আরো আগে হলে তামান্নাকে সে হারাতো না। কিন্তু বেকারত্ব নিয়ে তামান্নার যেসব মন্তব্য আর যুক্তি ছিল, সেগুলো অবশ্যই জীবনকেন্দ্রীক।