মুহাম্মদ রফিক ইসলাম

দিনার। দিদারুল ইসলাম দিনার। বছর দশের ফুটফুটে বালক। গায়ের রং শ্যামবর্ণ হলেও মুখাবয়বে একটা মায়া মায়া ভাব আছে। তার ঠোঁটের কোণে চাঁদবাঁকা হাসিতে যেন দিনার নামক পুরো আকাশটা হেঁসে ওঠে। আর তার চোখের দিকে তাকিয়ে যে কেউ ধূসর মেঘের পালক দেখতে পায়, প্রেমে পড়ে যায়।

কেটলির শরীরচর্চা দিয়েই দিনের শুরু হয় দিনারের। নাকে-মুখে যেন কালো কার্বনের ধূসর ফোঁটার মতো ফুটে থাকে কৃষ্ণবর্ণের তিল। কেটলির চকচকে শরীরে ভেসে ওঠে তার ছবি। যেখানে সে নিজেকে দেখে, কেটলি দিনারকে দেখে না। দেখা-না দেখার আ-শৈশব সম্পর্ক মিষ্টি লাগে, চাকের মধুর মতো মিষ্টি। মৌয়ালের পরখ ছাড়া সে মধু পানসে। পাতলা কাগজে আগুন জ্বলে। আগুন দিয়েই চুলোর উদ্বোধনযজ্ঞ। আগুন জ্বালাতে উদ্বোধকের পূর্ব প্রস্তুতি লাগে না। উপস্থিত ব্যাপারে অভিজ্ঞতা কাজেও আসে না, প্রয়োজন কাজে আসে। প্রয়োজনের প্রশিক্ষণ নেই, প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। জ্বলতে জ্বলতেই নিভে যায় চুলোটা। দিনারের খারাপ লাগে না মোটেও। খারাপের সাথে বসবাস করলে খারাপটাই একদিন ভালো লাগতে শুরু করে, খারাপের ভালো। ভালোলাগার নিজস্ব অভিধানে হয়তো খারাপ-ভালো বলে কোনো বিপরীত শব্দও নেই।

কন্টেইনার থেকে এক কৌটা কিরোসিন চুলোতে গড়িয়ে যায়। আগুনের জিভ লম্বা হয়, ধারালো হয়; লাকড়িকে কাটে। কাটার সাথে একটা আনন্দ কাজ করে , জয়ের আনন্দ। কেউ পুড়ে আনন্দ পায়, কেউ পুড়িয়ে। আগুনের আনন্দ পোড়ানোর সাথে। আর কাজের মাঝে ব্যর্থতা সফলতার মাঝারি ধাপ, পাতলা-সরু ধাপ। যে ধাপ আলগা আলগা সিঁড়ি বেয়ে ওঠে-নামে। সে ধাপের স্বাদ বোধ হয় মিষ্টির পর শরবতের মতো।

দিনারের হাত দৌড়োয় চায়ে-কাপে। ময়লাটে কাঁচের গ্লাসগুলো চকচক করে। শিশুর মুখে গজানো দুধদাঁতের মতো নরম চকচক। পাশাপাশি সাজিয়ে নেয় গ্লাসগুলো দিনার। দাঁতগুলো খিলখিল করে। রহস্য নেই সে খিলখিলে, সাদা-মাটা খিলখিল। চিনির বৈয়ামটাও ময়লাটে তেনার ঝাড়ফুঁক নিয়ে গ্লাসগুলোর পাশে বসে। গ্লাসগুলোর বসার ভঙ্গিতে একটা ফিলিংস আছে, অদৃশ্য ফিলিংস। কোকিলের পাশে কাকের স্থান পেয়ে বৈয়ামটা ধন্য হলেও কোকিলের চোখে একটা আড়-চাহনি কাজ করে, পঙ্গু চাহনি। আভিজাত্যের ভিড়ে তুচ্ছ চাহনির মতো।

চা নাড়ানোর ছোট চামচটা ওঠে আসে বড় থালাটার উপর। টুন করে শব্দ হয়; জড়তা ভাঙার মতো শব্দ। শব্দের মাঝে তীব্রতা নেই, নম্রতা আছে; বায়ুশূন্য নম্রতা, আনুগত্যের নম্রতা। পাশে রাখা পানিভর্তি মাঝবয়েসী প্লাস্টিকের গামলাটার বা’পাশে জোয়ান বয়েসী একটা মগ চেয়ে থাকে জগটার দিকে। প্লাস্টিকের জগ হলেও হয়তো ওটার আত্মসম্মানে বাঁধে মগের উপস্থিতিতে। বিব্রতবোধ করে এটা, আভিজাত্যের বিব্রতবোধ। জগের পাশে মগ যেন কুমারীর গালে তিলের মতো, গোল তিল। ধনীর পাশে গরীব যেমন জগের পাশে মগটাও তেমন, নিজেরে গর্বিত লাগে।

কেটলির ঢাকনাটা লাফিয়ে ওঠে। দিনার বুঝতে পারে পানি পুড়ছে। পোড়ার গন্ধ নেই, ঝাঁঝ আছে; আত্মোৎসর্গের ঝাঁঝ। পানি নিজেকে পুড়িয়ে মজা পায়, মানুষকে আরাম দেয়। আরাম ব্যাপারটা মনের, শরীরের না। মনের সাথে শরীর চলে না, চলতে পারে না। পানি পোড়ার সাথে চায়ের আর মানুষ পোড়ানোর সাথে আরামের সম্পর্ক। আরাম অনুভবে আসে, অনুভবে যায়; দৃশ্যায়ন হয় না। দৃশ্যমানের আরাম থাকে না, আগুনে পোড়া ঝাণ্ডার মতো আরাম। চা-পাতি নেমে যায় পানিতে। নিমিষেই ধবধবে সাদা পানি লালচে হয়ে ওঠে। শুরু হয় রক্তের মতো বুদবুদ। ফেনা জমে। ফেনার শরীর হতে মিষ্টি গন্ধ লাগে নাকে, হ্যাংলা মিষ্টি-গন্ধ!

নেত্রকোণা জেলাস্থ কেন্দুয়া উপজেলার গন্ডা গ্রামে দিনারদের এই হাট অনেকটা হারিকেন ধরা বৃদ্ধের মতো। গোটা কয়েক দোকান নিয়ে এলোমেলো পায়ে হাঁটে। হাঁটে দিনারদের চায়ের দোকানটাও। লাঠির খটাখট শব্দে টোলগুলো এগিয়ে আসে। একটার পর একটা, বিধবার হাতে চুড়ির মতো সারিসারি হয়ে। টোলগুলো বুক পেতে দ্যায়, নিজেদের ধন্য মনে করে ওরা। জীবের মতো এরা স্বার্থপর নয়, নিঃস্বার্থ। দানের বিপরীতে প্রতিদান চায় না বলেই এরা মানুষ নয়, বস্তু। বস্তুর ত্যাগ নির্ভেজাল, ফরমালিনহীন।

এক দুই তিন করে হরেক মানুষের সমাগম। বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন দর্শনের মানুষ; পাতলা আয়ের মানুষ, ঘন আয়ের মানুষ; খাটো মস্তিষ্কের মানুষ, লম্বা মস্তিষ্কের মানুষ এবং মানুষ সদৃশ মানুষ। বয়স্কদের কেউ কেউ বাড়িতে কাজ না থাকায় আড্ডায় সময় কাটানোর জন্য আসেন, কেউ কেউ নেশার বশে আসেন। অভ্যাসের দাস হয়ে নেশার গোলামি করেন। নেশাখোরদের অনেকের আবার চা না খেলে ছোট ঘরে তালা ঝুলে। চা খেয়ে বিড়িতে টান দিলেই তাদের জন্য ঐ ঘরের দরজা খুলে যায়। আড্ডাবাজদের অনেকেই সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম নিয়ে বেফাঁস মন্তব্যে হইচই বাঁধিয়ে বসেন। চাপাবাজি, গলাবাজিতে অনেকেই নিজ নিজ জায়গা দখলে রাখার একতরফা বুলি আওড়িয়ে চলেন। পাতলা আয়ের মানুষগুলো চা কম খেয়ে গাল-গল্পে মেতে ওঠেন বেশি। লবণ ছাড়া গাল-গল্পের মতো তাদের মনগড়া মতবাদ অন্যরা না খেলেও নিজ নিজ দর্শনের পাণ্ডিত্য জাহির করেই চলেন। মতবাদে যার দর্শন বেশি, তার রসায়নও বেশি। সবুজ রসায়ন। ঘন আয়ের মানুষগুলোর চেহারা সরিষার তেলের মতো চিকচিক করে। আঙুল ফেটে কলাগাছের মতো, বীচি কলাগাছ। সমাজের তোষামোদ শ্রেণির মানুষের কাছে এরা বিভিন্ন সম্মানসূচক উপাধিও পেয়ে থাকেন। হাওয়া খেয়ে ফুলে ওঠা এদের তৃতীয় স্বভাব। খাটো মস্তিষ্কের মানুষগুলো বাচাল টাইপের। আবাল বাচাল। লম্বা মস্তিষ্কের মানুষগুলো কৌশলে অন্যের উপর চা-খরচ চালিয়ে দেন। মানুষ সদৃশ মানুষগুলো কিছু না বলে ড্যাপড্যাপিয়ে চেয়ে থাকেন। নেশা নয়; অভ্যাসে আমিও একজন নিয়মিত মানুষ, অনিয়মে।

হাতে হাতে চা। চায়ে-কাপে ঠোঁট। ঠোঁটে ঠোঁটে কথা। কেউ কথা বলে, কেউ কথা বলায় আর কেউ কথার কথায় ঢোক গিলে। ছোট কথা, মাঝারি কথা, বড় কথা; সব কথায় সব কিছু টোলে টোলে এলোমেলো ঘুরে। কথায় কথায় আলোচনা গাঢ় হলে কে শ্রোতা, কে বক্তা আর কে শ্রোক্তা বুঝা মুশকিল। শ্রোক্তাদের বলা ও শোনা দুটোই আছে বলে তারা শ্রো+ক্তা! কেউ চা খায়, কেউ পান করে। আমি পানীয়কে পান করে মজা পাই, আরাম লাগে। বোকা বোকা আরাম। যারা খায় তারা মজা পায়, আরাম পায় না। নেশায় খায়, অভ্যাসে না।

দিনারের গালভর্তি হাসি পকেটে গড়ায়। চা চলে, চলছে...কেটলির পর কেটলি। পানের সাথে সুপারি। কাঁচা-শুকনো ও পচা সুপারি। কাঁচা সুপারি পানিতে ভিজিয়ে পচা বানানো হয়। কাঁচা ও পচা সুপারিতে মুখ লাল হয়। মুখ লাল হলে বউয়ে না কি বেশি খাতির করে বলে একে অন্যেকে খোঁচা মারে, ভাবের খোঁচা। যার বেলায় সত্যি সে মুচকি হাসে, নিয়ন হাসি; যার বেলায় সত্যি নয় সে হাসে না, হাসির ভান করে। আমার বেলায় কোনোটাই নেই! তাই নিরস রইলাম।

চা-সিগারেটে; ফুঁ, চুষা, ধোঁয়া। আজব পরিবেশ। চায়ের কাপ হাতে, পানির আদেশ দিয়ে সিগারেটের তাগিদ। এই ব্র্যান্ড নয় ঐ ব্র্যান্ড...। কুকুর পায়ে দিনার হাঁটে; ওই দোকান-এই দোকান...। ব্র্যান্ড চেঞ্জ হলে কড়া ধমক! জর্দ্দা নেই...অমুক? দিনারের হাসিমাখা মুখে মেঘ জমে। নীলের মতো মেঘ। যে মেঘ অস্থায়ী বাতাসে ওড়ে না, ভারী হয়; গরীবের আকাশে গলে না যাওয়া মেঘ। নতমাথায় এগিয়ে যায় দিনার শূন্য কাপ ধরে। হাতে কাঁপন, ঘৃণার কাঁপন। পায়ে লাজের লতাপাতা। ধিক্কারের শেখরে মলাটবদ্ধ লতাপাতা। কাপ গরম জলে ধোয়ার সময় বাড়তি তাগিদ, ভালো করে ধোয়া চাই। চিনি কম কেনো, জানিস না বেশি খাই? কাপ বদল হলে নতুন ধমক বেশি কেন কম খাই; কান গেল না কি? দিনার কিছু বলে না। খদ্দের যাই বলুক, লক্ষ্মী! যত্ন করে পুষতে হয়, পেট পূজার জন্য পোষা।

দিনার বিরামহীন বালক। সাত-সকালের সতেজ বাতাসেও গায়ের গেঞ্জিটা আগাগোড়া ভেজা। কপালের ভাঁজে একটুও ক্লান্তির ছোঁয়া নেই তার। গরীবের শরীরে ক্লান্তি থাকে না, ধনীর থাকে; সুখের ক্লান্তি।

দোকানের পাশেই প্রাথমিক বিদ্যালয়। হৈচৈয়ে সরব। মাঠে ছেলে-মেয়ে খেলাধুলা করছে। দিনার চুলোয় লাকড়ি ঠ্যালতে ঠ্যালতে স্কুল ক্যাম্পাসের দিকে তাকায়। নিজের বয়েসী ছেলেমেয়েদের মধ্যে দিনার কখন যেন হারিয়ে যায়। শরীরচর্চা স্যারের ইশারায় ওর অবচেতন শপথবাক্যের মুষ্টিবদ্ধ হাত সামনে এগিয়ে গেলে, কেটলিটা পড়ে যায়। মাগো, ওমা...! পুড়ে গেল, জ্বলে গেল!