ঢাকা শহর। রাত ২:৩৫। একটি অন্ধকার কক্ষে কেবল কম্পিউটারের স্ক্রিন জ্বলজ্বল করছে। স্ক্রিনে একের পর এক নাম ভেসে উঠছে, সঙ্গে ছবি, বয়স, পেশা এবং একটি ছোট্ট লাল চিহ্ন- TARGET LOCKED.

স্ক্রিনের সামনে বসে থাকা ব্যক্তি ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি ফুটিয়ে তুলল। “সময় হয়ে এসেছে।”

বিশিষ্ট প্রযুক্তিবিদ ও সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার মাহির ইসলামকে তার নিজের অ্যাপার্টমেন্টে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। ল্যাপটপ খোলা, স্ক্রিনে একটি মাত্র লাইন।

WELCOME TO THE GAME. পুলিশের ধারণা, এটা আত্মহত্যা। কিন্তু সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অফিসার আদনান রহমান বুঝতে পারলেন, এটা তার চেয়ে অনেক বড় কিছু। এটা শুধু এক রাতের ঘটনা নয়।

এটা “ডেডলক” নামে এক রহস্যময় হ্যাকার-সিরিয়াল কিলারের খেলা। যে মানুষগুলো মরছে, তারা সবাই দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিবিদ, গবেষক বা নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ। কিন্তু কেন? আদনান যখন খোঁজ নিতে শুরু করলেন, তখনই তার ইমেইলে এল এক অদ্ভুত মেসেজ- “Stop chasing me, Detective. Or youll be the next” কিন্তু আদনান জানেন, তিনি থামবেন না। কিন্তু তিনি জানেন না, এই খেলার শেষ কোথায়।

ঢাকার সকালটা নরম রোদের নিচে স্বাভাবিক মনে হলেও, পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের ভেতর এক অদৃশ্য আতঙ্ক কাজ করছিল। “মাহির ইসলামের ল্যাপটপে কোনো হ্যাকিং ট্রেস পাওয়া গেছে?” আদনান রহমান দ্রুত জিজ্ঞেস করলেন ফরেনসিক এক্সপার্ট শাওনকে। শাওন মাথা নাড়ল। “একটা এনক্রিপ্টেড ফাইল পাওয়া গেছে, কিন্তু ওটা আনলক করতে গেলে পুরো সিস্টেম ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কেউ খুব শক্তিশালী সাইবার ওয়েপন ব্যবহার করেছে।”

“মানে?” আদনান ভ্রু কুঁচকালেন। “এটা কোনো সাধারণ হ্যাকার না, এ ধরনের কোড সরকারি সংস্থাগুলো ব্যবহার করে।” আদনানের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। “মানে এই সিরিয়াল কিলার আমাদের দেশের কোনো সংস্থার ভেতর থেকে কাজ করছে?” শাওন কিছু বলল না, কিন্তু তার চোখের ভাষা বলছিল হয়তো এর চেয়েও ভয়ংকর কিছু ঘটছে।

“TARGET LOCKED.” অন্ধকার ঘরে এবার আরেকটি নাম স্ক্রিনে ভেসে উঠল “Adnan Rahman.” সঙ্গে একটি ছোট্ট মেসেজ- “Detective, I warned you. Now it's your turn.” রাত ১:৪৫। আদনান যখন অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে যাবেন, ঠিক তখনই তার ফোন ভাইব্রেট করল। অপরিচিত এক নাম্বার থেকে। “তুমি ভাবছো, আমাকে ধরতে পারবে?”

কণ্ঠটা ঠান্ডা, শীতল। আদনান দ্রুত চারপাশে তাকালেন। “তুমি কে?” “ডেডলক।” “তুমি কি সত্যিই মানুষ খুন করছো, নাকি এটা বড় কোনো ষড়যন্ত্র?”

হাসির শব্দ ভেসে এলো। “তুমি সত্যের খুব কাছে চলে এসেছো, আদনান। এখন হয় থেমে যাও, নাহলে তোমার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে!” লাইন কেটে গেল।

ঠিক তখনই আদনানের সামনে একটা কালো ভ্যান এসে দাঁড়াল। দুজন মুখোশধারী লোক নেমে এলো। হাতে সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল! “শালার বোকা গোয়েন্দা! এবার মরার জন্য তৈরি হও!”

আদনান দ্রুত পাশের গাড়ির আড়ালে লাফ দিলেন। ঠিক তখনই ঠাস! ঠাস! শব্দে দুটো গুলি তার ঠিক আগের জায়গাটা ভেদ করে গেল। “ওকে দ্রুত শেষ কর!” দুই মুখোশধারী আগাতে লাগল, কিন্তু আদনান ইতোমধ্যে নিজের সার্ভিস পিস্তল বের করে ফেলেছেন।

ঠাস! একটা নিখুঁত শটে প্রথম হামলাকারী পড়ে গেল। কিন্তু দ্বিতীয়জন খুব দ্রুততার সাথে পাশের দেয়ালের আড়ালে চলে গেল। “দেখো, তুমি চাইলে বেঁচে যেতে পারো। শুধু আমাকে বলো, ডেডলক কে?” আদনান হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন। কিন্তু উত্তরে আবারও গুলি!

আদনান বুঝলেন, এই হামলাকারীরা কথার চেয়ে গুলিতেই বেশি বিশ্বাসী। ঠিক তখনই পেছন থেকে একটি কালো বাইক এসে থামল। “আদনান, উঠো!”

আদনান ঘুরে তাকিয়ে দেখলেন-সালমান!

কোনো সময় নষ্ট না করে তিনি বাইকে লাফ দিলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে সালমান দ্রুতগতিতে বাইক চালিয়ে বেরিয়ে গেলো। “তুই এখানে কীভাবে?” আদনান অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন। সালমান হেসে বলল, “ভাই, তোর এই খেলায় আমি আগেই ঢুকে গেছি। তুই শুধু জানিস না।”

সকালে আদনান ও সালমান শহরের বাইরে এক নিরাপদ জায়গায় বসে তথ্য বিশ্লেষণ করছিলেন।

সালমান বলল, “ডেডলক শুধু একজন সাইকোপ্যাথ সিরিয়াল কিলার না, ওর সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংযোগ আছে। ও এমন কিছু মানুষের জন্য কাজ করছে, যারা সরকারকেও নিয়ন্ত্রণ করে!” “মানে?”

সালমান কম্পিউটারে কিছু টাইপ করল। কিছুক্ষণ পর একটি অজানা ডার্ক ওয়েব সাইট খুলে গেল, যেখানে এক ভয়ংকর তালিকা দেখা গেল।

“Next Target: Bangladesh Cyber Security UnitÕs Chief.” আদনান স্তব্ধ হয়ে গেলেন।

“তারা কি সরকারকে হ্যাক করার চেষ্টা করছে?”

সালমান মাথা নাড়ল। “আরও খারাপ কিছু। তারা পুরো দেশের ডিজিটাল সিস্টেম ধ্বংস করে দিতে চায়!” ঠিক তখনই, কম্পিউটার স্ক্রিন কালো হয়ে গেল।

তারপর ভেসে উঠল এক ভয়ংকর মেসেজ।

“STOP OR DIE” আদনান আর সালমান একে অপরের দিকে তাকালেন। গেম এখনো শেষ হয়নি, এটা কেবল শুরু।

স্ক্রিনে ভেসে ওঠা “STOP OR DIE” মেসেজটা মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেল, যেন কখনোই ছিল না।

“আমাদের প্রত্যেকটা মুভমেন্ট মনিটর করা হচ্ছে,” সালমান ধীরে বলল। “কিন্তু কিভাবে? আমার ফোন ট্র্যাক প্রুফ, ল্যাপটপ এনক্রিপ্টেড!” আদনান উদ্বিগ্ন।

সালমান চিন্তিত মুখে বলল, “তোর শরীরের কোথাও ট্র্যাকার লাগানো হয়েছে কি না, চেক করা দরকার।”

আদনান ধাক্কা খেলেন। “মানে? আমি কি একটা ওয়াকিং ট্র্যাকিং ডিভাইস?” সালমান উঠে দাঁড়াল। “ভাই, ডেডলক যে লেভেলের হ্যাকার, সে চাইলে তোকে ট্র্যাক করা কোনো ব্যাপারই না। আমরা এতদিন ওর দিকে নজর রাখছিলাম, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি ও আসলে শুরু থেকেই আমাদের ট্র্যাক করছিল!”

“আমরা কি তাহলে ওর ফাঁদে পড়েছি?”

সালমান হেসে বলল, “না ভাই, ফাঁদে পড়েছিও। এখন ওর খেলা আমরাই খেলব!”

রাত ৩:১০। ঢাকার বাইরে এক পরিত্যক্ত ফ্যাক্টরির ভেতর, এক অন্ধকার কক্ষে একটা বিশাল স্ক্রিনে কিছু লাইভ ফিড দেখা যাচ্ছে। একজন মানুষ ঘরের কোণে বসে, তার পুরো শরীর ছায়ায় ঢাকা। “তাদের এবার সত্যিই থামাতে হবে,” সে নিচু গলায় বলল।

আরেকজন এসে মাথা নাড়ল। “তাদের খেলা এখানেই শেষ হওয়া উচিত, স্যার?” “না। খেলা শেষ হবে আমার নিয়মে। এবার পরিকল্পনা বদলাতে হবে”।

সকাল ৮:০০। আদনান আর সালমান যখন তাদের গোপন ডেটা সেন্টারে ঢুকলেন, তখনই চারপাশের বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠল। “আমাদের সব ব্যাকআপ ডাটা ডিলিট হয়ে গেছে!” এক মুহূর্তে সালমানের মুখ শুকিয়ে গেল।”কি? সেটা তো তিনটা ভিন্ন সার্ভারে রাখা ছিল!” “সবই হ্যাকড! আমাদের এক স্টেপ আগেই ডেডলক আমাদের গেম বুঝে গেছে!”

ঠিক তখনই একটা মেইল নোটিফিকেশন ভেসে উঠল— “CHECK YOUR POCKET.” আদনান দ্রুত পকেটে হাত দিলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে গা শিউরে উঠল।

একটা ছোট USB ড্রাইভ। কিন্তু সেটা কবে, কিভাবে এল? সালমান ফিসফিস করে বলল, “ও আমাদের এত কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, যে আমরা জানতেই পারিনি।”

আদনান চোখ বন্ধ করলেন, তারপর ফিসফিস করে বললেন, “গেমের এন্ডগেম শুরু হয়ে গেছে”

আদনান আর সালমান স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তাদের সব ডাটা হ্যাকড, নিরাপত্তা ধ্বংস হয়ে গেছে। আর সবচেয়ে বড় ধাক্কা- ডেডলক এতটাই কাছাকাছি, যে তারা টেরও পায়নি! সালমান চাপা গলায় বলল, “আমরা কী করব?” আদনান USB ড্রাইভের দিকে তাকালেন। ধীরে ধীরে বললেন, “এটাই আমাদের শেষ সুযোগ। এটা একটা ফাঁদও হতে পারে, আবার আমাদের জেতার চাবিকাঠিও হতে পারে।”

তিনি ড্রাইভটা ল্যাপটপে লাগালেন। একটা ভিডিও ফাইল।

ভিডিওটা চালাতেই অন্ধকার ঘর, সামনে একটা মুখোশধারী মানুষ। তার কণ্ঠ শীতল। “অভিনন্দন, আদনান। তুমি আমার দেওয়া চ্যালেঞ্জ টপকে এখানে এসেছো।” “কিন্তু তুমি কি জানো, আমি কেন এই কাজ করছি?” ভিডিওতে একের পর এক ক্লিপ দেখানো হতে লাগল— একটি রহস্যময় সংস্থা, যারা দেশের সাইবার সিকিউরিটিকে দুর্বল করতে চায়। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দুর্নীতি, যা তারা গোপন রাখতে চায়। একটি ভয়ংকর সাইবার অস্ত্র, যা পুরো দেশের নেটওয়ার্ক ধ্বংস করতে পারে। “আমি কোনো সিরিয়াল কিলার নই,” ডেডলকের কণ্ঠে শীতলতা। “আমি নায়কও নই। আমি শুধু সত্যকে সামনে আনতে চাই। কিন্তু তুমিই ঠিক করবে, আমার পথটা সঠিক কি না।”

ভিডিওর শেষদিকে একটাই লাইন

“STOP ME OR JOIN ME.”

আদনান গভীর শ্বাস নিলেন। “ডেডলক একজন একক অপরাধী না। ওর পেছনে বড় কিছু আছে!”

সালমান দ্রুত বলল, “আমাদের হাতে একটাই সুযোগ ডেডলককে খুঁজে বের করা আর ওর পরিকল্পনা নষ্ট করা।” “কিন্তু যদি ওর কথাগুলো সত্যি হয়?”

সালমান চুপ। এক মুহূর্ত পরে আদনান উঠে দাঁড়ালেন। “আমরা সত্য বের করব। আইনকে পাশ কাটিয়ে নয়, আইন দিয়েই!” তারা শেষবারের মতো সমস্ত সাইবার ট্র্যাকিং শক্তি ব্যবহার করল, ডেডলকের অবস্থান বের করল গাজীপুরের এক পরিত্যক্ত ফ্যাক্টরি।

তারা দ্রুত সেখানে পৌঁছাল।

ভেতরে ঢুকতেই তারা দেখল একটি বিশাল সার্ভার রুম, যেখানে শত শত তার ঝুলে আছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক ব্যক্তি, মুখোশ খুলে নিচ্ছে ধীরে ধীরে। আদনানের চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। “তুমি?”

সালমান হতবাক। “এটা কি সম্ভব?” ব্যক্তিটি হেসে বলল, “অবশ্যই সম্ভব, কারণ আমি সব সময় তোমাদের পাশে ছিলাম। কিন্তু এখন, এটা শেষ করতে হবে!” ঠিক তখনই বিল্ডিংয়ের চারপাশে পুলিশের বিশেষ ইউনিট ঢুকে পড়ল। ডেডলক শেষবারের মতো হাসল। “আমি হেরে গেছি, কিন্তু খেলা এখানেই শেষ নয়” সে পকেট থেকে একটি ছোট ডিভাইস বের করল।

আদনান চিৎকার করলেন, “ঘঙ!!”

ঠাস! একটি গুলির শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো।

ডেডলক ধীরে মাটিতে পড়ে গেল, হাতে থাকা ডিভাইস নিচে পড়ে গেল। সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল।

আদনান এগিয়ে গিয়ে দেখলেন ডিভাইসটি এক সেকেন্ডের ব্যবধানে একটিভ হতে পারত এবং পুরো দেশের ইন্টারনেট সিস্টেম ধ্বংস করে দিতে পারত!

সালমান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “আমরা শেষ পর্যন্ত জিতেছি?” আদনান ফিসফিস করে বললেন, “জানি না। কারণ ডেডলক বলেছিল’ খেলা এখানেই শেষ নয়’।” তারা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের গাড়ির দিকে তাকালেন, যেখানে ডেডলকের মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু মনে হলো গাড়ির ভেতর থেকে একটা অদ্ভুত হাসির শব্দ ভেসে এল। গেম এখনো শেষ হয়নি।