আব্দুস সালাম
মোবারক হোসেন ছিলেন শহরের প্রান্তে একটি ছোট ব্যবসার মালিক। সারা জীবন হিসাবি, কিপটে এবং আত্মকেন্দ্রিক মনোভাবের কারণে তার সুনাম কখনো গড়ে ওঠেনি। ছেলেবেলায় তার পরিবার অভাবী ছিল, কিন্তু বাবা-মা সবসময় চেষ্টা করতেন সন্তানদের প্রয়োজন পূরণ করতে। অথচ সেই মোবারক, সামান্য কিছু টাকা জমাতে গিয়ে বাবা-মায়ের ওষুধ কেনা থেকেও পিছপা হয়েছেন। আত্মীয়স্বজনের বিপদেও কখনো একটি পয়সা দেননি, এমনকি বন্ধুবান্ধবেরও কাছ থেকে দূরে থেকেছেন যেন কেউ ধার চেয়ে বসে।
সময়ের সাথে সাথে মোবারকের ব্যবসা জমে উঠল। দোকান থেকে উপার্জিত টাকা তিনি ব্যাংকে জমাতেন, ফিক্সড ডিপোজিট করতেন, আর স্বর্ণ কিনে লুকিয়ে রাখতেন পুরনো ট্রাঙ্কে। কেউ জানত না তার আসল সম্পদের পরিমাণ। অথচ নিজের বাড়িটাও পুরনো, ফাটল ধরা দেওয়ালে ভরা সেই বাড়িতেই থাকতেন একাকী, রান্নার কাজ করতেন নিজেই, যেন একটা ডিমও অপচয় না হয়।
বয়স যখন ষাট পেরিয়েছে, তখন হঠাৎ একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি একটা বাগানবাড়ি বানাবেন শহরের বাইরে। বুড়ো বুড়ি বয়সে একটু খোলামেলা পরিবেশে থাকা যাবে, এই যুক্তি দেখিয়ে অনেক টাকা খরচ করলেন। বাড়িটি বানাতে গিয়ে বহু শ্রমিক, ইঞ্জিনিয়ার আর মালি লাগলেন, আর মোবারক সব খরচ নিজ হাতে হিসাব রাখতেন। ঘরগুলো আধুনিক, দেয়ালে কাঠের কারুকাজ, বারান্দায় দোলনা সবই পরিপাটি, নিখুঁত। কিন্তু তবুও কেউ ছিল না পাশে।
তিন বছর পর সেই বাড়িতে গিয়ে থাকতে শুরু করলেন মোবারক। বড় গেট, ফুলে ভরা বাগান, হাঁটার পথ, বিশ্রামের ছায়া সব ছিল, কিন্তু সঙ্গী বলতে কেউ ছিল না। একদিন হঠাৎ অসুস্থ বোধ করলেন। গা কাঁপুনি, জ্বর, দুর্বলতা। স্থানীয় ডাক্তার প্রথমে পাত্তা দিলেন না। কিন্তু দিন পেরোতে না পেরোতেই বোঝা গেল, সমস্যাটা গুরুতর। শহরে গিয়ে টেস্ট করালেন—ধরা পড়ল প্যানক্রিয়াস ক্যান্সার, তৃতীয় স্টেজ।
হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে মোবারক প্রথমবারের মতো ভাবলেন এই বিশাল বাড়ি, জমা টাকা, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স সবই কেমন অর্থহীন লাগছে! জীবন এতটাই ক্ষণস্থায়ী, অথচ তিনি সারা জীবন কাটালেন হিসেব কষে। বাবার শেষ সময়ে একটা ইনহেলার কেনেননি, মায়ের ছানি অপারেশনের খরচ দিতে অস্বীকার করেছিলেন। ভাতিজার পড়াশোনার খরচ না দেওয়ায় ছেলেটা কলেজে ভর্তি হতে পারেনি। আজ সেই মোবারকের পাশে কেউ নেই।
এক সন্ধ্যায় হাসপাতালের জানালায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ভিজে উঠল। একটা ছোট মেয়ে পাশের রুগীকে তার বাবার জন্য ফল খাওয়াচ্ছে সেই দৃশ্য তাকে মনে করিয়ে দিল তার একটাই দোষ“ভয় আর অবিশ্বাসে ভরা এক হৃদয়”। তিনি ভালোবাসতে পারেননি, কাউকে বিশ্বাস করতে পারেননি, এমনকি নিজের কাছেরজনকেও সাহায্য করতে পারেননি। টাকা ছিল, হৃদয় ছিল না।
মোবারক সেই রাতে একজন নার্সকে ডেকে বললেন, “একটা কাজ করে দেবে মা?” নার্স বলল, “বলুন কাকা।”
তিনি বললেন, “এই চিঠিটা আমার এলাকার মসজিদের ইমাম সাহেবকে পৌঁছে দেবে। আর যদি আমি বেঁচে না থাকি, আমার ঘরের আলমারির ভিতর থেকে সব কাগজপত্র ও টাকা আমার গ্রামের দরিদ্র মানুষদের জন্য ওয়াকফ করে দিও।”
চিঠিতে তিনি তার কিপ্টামির স্বীকারোক্তি লিখেছিলেন। ক্ষমা চেয়েছিলেন মা-বাবার কাছেও। আর সব সম্পত্তি দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন এতিমখানা, হাসপাতাল, এবং গ্রামের দরিদ্রদের জন্য। দুদিন পর মোবারক হোসেন মারা গেলেন। কেউ খুব একটা কাঁদেনি, কিন্তু তার চিঠি যখন প্রকাশিত হলো, তখন অনেকের চোখে পানি এসেছিল। এক কাপুরুষ, কিপটে মানুষ শেষ জীবনে বুঝেছিল মানুষের জীবনের আসল সম্পদ টাকা নয়, বরং সম্পর্ক, সহানুভূতি, আর উদারতা।
তার তৈরি বাগানবাড়িটি এখন এক বৃদ্ধাশ্রম, যেখানে অনাথ ও অসহায় বৃদ্ধরা বসবাস করেন। তার কিপ্টে জীবনের শেষ অধ্যায়ে পাওয়া অনুশোচনাই হয়ত মানুষের জন্য বড় একটি প্রাপ্তি হয়ে রয়ে গেল একটা নিঃশব্দ শিক্ষা:
গত শুক্রবার (২৮ নভেম্বর) বিকেল ৩.০০টায় বাংলা একাডেমির জসীমউদ্দিন ভবনের সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ মিলনায়তনে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পবিত্র কুরআন তেলওয়াতের মাধ্যমে শুরু হওয়া সম্মেলনটির উদ্বোধনী পর্বে কবি আফসার নিজামের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথির বক্তব্যে কবি আব্দুল হাই শিকদার বলেন, ‘সাহিত্যের পথপরিক্রমায় পত্রিকা হিসেবে তাইরান এক ব্যতিক্রমি চমৎকার উদ্যোগ নিয়েছে। আমি এ পত্রিকাটির শতায়ু কামনা করি।’
সেমিনার পর্বে সম্মেলন বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক গল্পকার মুজতাহিদ ফারুকীর সভাপতিত্বে প্রফেসর জসীমউদ্দিন উপস্থাপিত “বিশ্বসাহিত্য থেকে বাংলাদেশ : লিটল ম্যাগাজিনের গতিপ্রকৃতি এবং ‘তাইরান’-এর প্রতিশ্রুতি” শীর্ষক প্রবন্ধ আলোচনায় প্রধান অতিথি বিশিষ্ট ব্যাংকার মো: আব্দুল মান্নান বলেন, ‘ভাটি বাংলার এ অঞ্চলের মানুষের ঐতিহ্যগত ইতিহাস ধারা অনেক বৈচিত্র্যময় ও সম্মৃদ্ধ। সাহিত্যের এ ধরনের আয়োজনের মাধ্যমে আমাদের সেই সমৃদ্ধধারাকে মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে।’
সমাপণী ও তাইরান লেখক সম্মাননা ২০২৫ প্রদান পর্বে কবি রহমান হেনরীর সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জাসাসের সাবেক সভাপতি রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী। এ সময় প্রধান অতিথি হিসেবে এনবিআরের সদস্য (প্রশাসন) জনাব মুতাসিম বিল্লাহ ফারুকী তার বক্তব্যে বলেন, ‘তাইরানের এমন শৃঙ্খল আয়োজন আমাকে আপ্লুত করেছে। তাইরান এই সম্মৃদ্ধির পথ ধরে অনেক দূর এগিয়ে যাবে এবং সমাজের কাক্সিক্ষত পরিবর্তনে জোরালো ভূমিকা রাখবে এমন প্রত্যাশা করি।
এ সময় উপস্থিত মেহমানরা তাইরান লেখক সম্মাননা ২০২৫ প্রাপ্তদের হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট ও সনদ তুলে দেন। সম্মাননা প্রাপ্তরা হলেন, ছোটগল্পে ফিরোজ আহমদ, কবিতায় নয়ন আহমেদ, চারুশিল্পে ফরিদী নুমান, ছড়ায় ফরিদ সাঈদ, প্রবন্ধে মোহাম্মদ জসীম উদ্দীন, অনুবাদে তানজিনা বিনতে নূর এবং তরুণ লেখক হিসেবে সম্মাননা পান মরিয়াম মুন্নী, জীনাত রহমান, আবুল হাসান জারজিস, আজীজ হাকিম।
তানজিনা বিনতে নূর ও ফয়েজ বিন আকরামের উপস্থাপনায় উপভোগ্য এ সম্মেলনের স্বাগত বক্তব্যে কবি ও তাইরান সম্পাদক তাসনীম মাহমুদ বলেন, ‘তাইরান একটি অরাজনৈতিক সাহিত্য পত্রিকা। নির্দিষ্ট কোনো রাজনীতির সংস্রব এখানে নেই। রাজনৈতিক কোনো বক্তব্যও আমাদের কাম্য নয়। তবে, এই পত্রিকা দেশ এবং দেশের অধিকাংশ জনগণের ঐতিহ্যগত চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এই প্রকাশ ভঙ্গিকে যদি আপনাদের কাছে কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম মনে হয়, তাহলে এটিই তাইরানের রাজনীতি।’
সম্মেলনে “তাইরান” ৫ম সংখ্যা এবং তাসনীম মাহমুদ’র ৪র্থ কাব্যগ্রন্থ “আগুনের ফুলকি নাচে” বই দু’টির মোড়ক উন্মোচন করা হয়। সভাপতির বক্তব্যের শেষে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হয়। অনুষ্ঠানে গান, কবিতা এবং জুলাই বিপ্লবের ওপর নির্মিত মঞ্চ নাটক উপস্থাপন করা হয়।
সম্মেলনটিতে অতিথি হিসেবে আরো বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও রাষ্ট্রচিন্তক কর্নেল আশরাফ আল দীন, কবি মোশাররফ হোসেন খান, কবি ও সম্পাদক জাকির আবু জাফর, কবি মনসুর আজিজ, ড. ইয়াহহিয়া মান্নান, শিক্ষা অনুরাগী মোস্তাফিজ শিহাব, নজরুল গবেষক এমদাদুল হক চৌধুরী, ছড়াকার আতিক হেলাল, কবি মাহমুদুল হাসান নিজামী, অ্যাডভোকেট শাহানারা স্বপ্না, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শেখ মিজানুর রহমান, মাহবুব মুকুল, শামসুল আবেদীন প্রমুখ।
-ফারজানা তাসফিয়া