আব্দুস সালাম

নন্দীপুর ছিল খুব সুন্দর এক গ্রাম। গ্রামের পাশে ছিল এক ঘন অরণ্য, যেটি নদী দিয়ে ঘেরা ছিল। এই জঙ্গলের গভীরতা এত বেশি ছিল যে দিনের আলোতেও ভেতরে ঢোকার সাহস কেউ করতো না। আশেপাশের গ্রামের কিছু মৌয়াল জঙ্গলের কিনারা থেকে মধু সংগ্রহ করতো, কিন্তু তারাও কখনো গভীরে যেত না। এই অরণ্যের ভেতরে বাস করতো একদল ভয়ংকর দস্যু। তারা দিনের বেলা জঙ্গলে বিশ্রাম নিতো আর রাত হলে বের হতো ডাকাতির জন্য। শুরুতে তারা আশেপাশের গ্রামে ডাকাতি করতো না, তাই গ্রামবাসীরাও ভাবতো ওদের নিয়ে ভাবার কিছু নেই।

কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই আশপাশের গ্রামগুলোতে ডাকাতির ঘটনা ঘটতে শুরু করলো। অজানা মুখোশধারীরা মাঝরাতে এসে টাকা-পয়সা, গয়না আর মূল্যবান জিনিস লুট করে নিয়ে যেত। তাদের হাতে থাকতো ধারালো অস্ত্র, আর মুখ ঢেকে রাখতো কালো কাপড়ে। গ্রামের লোকজন এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে, কেউ কিছু বলতে সাহস করতো না।

গ্রামের মানুষ ভয়ে-আতঙ্কে দিন কাটাতে লাগলো। তখন দশ গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা মিলে এক গোপন বৈঠক করলেন। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রথমে ডাকাতদের গতিবিধি নজরে রাখতে হবে। তারা কোন পথে আসে, কয়জন থাকে, কখন আসেÑ সব কিছু জানার জন্য কিছু সাহসী লোককে পাহারার কাজে লাগানো হলো।

এক জোৎস্না রাতে পাহারাদাররা দেখলো, একটি বড় নৌকায় প্রায় ২০-২২ জন মুখোশধারী দস্যু নদী পার হয়ে নন্দীপুর গ্রামের দিকে যাচ্ছে। জঙ্গলের বাইরে যেকোনো গ্রামে যেতে হলে নন্দীপুরের মধ্য দিয়েই যেতে হয়। নৌকাটি তারা একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে যায় এবং হাঁটা দিয়ে গ্রামের দিকে যায়। ভোর হওয়ার আগেই তারা আবার ফিরে গিয়ে নৌকায় চড়ে পালায়।

এই খবর শুনে মাতব্বর আজান চাচা বললেন, “যদি আমরা ওদের নৌকাটি নষ্ট করে দিতে পারি, তবে তারা আর পালাতে পারবে না।” সবাই তার কথায় সায় দিলো। ঠিক হলো, দস্যুরা যখন আবার আসবে, তখন তাদের অনুপস্থিতিতে নৌকাটি ভেঙে ফেলা হবে।

কিছুদিন পর আবার এক জোৎস্না রাতে দস্যুরা এলো। এবার তাদের সংখ্যা আরও বেশি। পাহারাদাররা চুপিচুপি গিয়ে নৌকার পাটাতন খুলে দিলো। ধীরে ধীরে নৌকাটি পানির নিচে ডুবে গেল।

ভোরে যখন দস্যুরা ফিরে এলো, তখন তারা দেখে নৌকা নেই! তারা ভয় পেয়ে গেল। কেউ কেউ নদীতে ঝাঁপ দিল, কেউ আবার জিনিসপত্র ফেলে দিয়ে গাছের আড়ালে লুকাতে চাইল। কিন্তু বেশিরভাগ দস্যুই বুঝে গেল এবার রক্ষা নেই।

সকাল হতেই গ্রামের মানুষ লাঠিসোঁটা, দা-বটি নিয়ে জঙ্গলের দিকে গেল। তারা দস্যুদের খুঁজে বের করলো। শুরু হলো এক তুমুল সংঘর্ষ। গ্রামের লোকজন সাহসিকতার সঙ্গে লড়লো এবং সব দস্যুকে ধরে ফেললো। কেউ পালাতে পারলো না।

এই ঘটনার পর থেকে নন্দীপুরসহ আশপাশের কোনো গ্রামে আর কখনো ডাকাতি হয়নি। সবাই মিলে আনন্দ উৎসব করলো। বাচ্চারা আবার মুক্ত মনে খেলাধুলা করতে পারলো। গ্রামবাসী বুঝে গেল সাহস, একতা আর বুদ্ধিমত্তা থাকলে যেকোনো বিপদ মোকাবিলা করা যায়।