রহমান মাজিদ
আজ প্রথম ও হাসলো। জন্মের পরে হেসেছিল কিনা ওর মনে নাই। হয়তো হেসেছিল। হয়তো তখন ওর দাঁতই ছিল না। এখন দাঁত উঠেছে। ইঁদুরের দাঁতের মতো ছোট ও সুগঠিত। মনে হয় কোন মালাকার রেলের সাদা পাথর ছোট ছোট করে কেটে বিশেষ কায়দায় ওর মুসলোর উপরে সাজিয়ে রেখেছে। আর সেখানে সেট করে দিয়েছে একটা হাই পাওয়ার এনার্জি বাল্ব। ও কেন হাসে না? কেউ কি নিষেধ করেছে? নাকি হাসির বদলে খরিদ করেছে লাইফ টাইম কান্নার লাইসেন্স। জানে না। কিচ্ছু জানে না ও। শুধু জানে হাসতে গেলে কেউ ওর দুই টেবুতে আঙ্গুল ঢুকিয়ে টেনে ধরেছে দুই পাশ থেকে।
তখন নিজাম ক্ষেত থেকে বাড়ি ফিরতো সন্ধ্যায়। হাত মুখ না ধুয়েই সোজা উঠে যেত বারান্দায়। তখনও ওর লুঙ্গির নিচের অংশ উল্টো করে তুলে কোমড়ের সাথে গিঁট দেয়া থাকতো। পায়ে লেগে থাকতো প্যাঁক কেদা। গায়ের ছেঁড়া জামা থেকে বের হতো দুধচাপা ঘাসের তেতো গন্ধ। হাতের কব্জিতে, দাড়িতে পঁচা কাদার ছিটকানি। গামছা থেকে কষ্টিক মেশানো মাড়ির টকটক গন্ধ বের হচ্ছে। কাঁথার ভিতর থেকে টেনে তুলতো মেয়েটাকে। মা কইলে আমাল? এটা কি আমাল মা নাকি গো? বলতো আর ডাইনে বামে দোলাতো। চুমু খেতো ওর নরম গালে। থ্যাকথেকে থুথু লেগে যেত মেয়েটার তুলতুলে গালে। গামছা দিয়ে মুখটা মুছে দিয়ে আবার চুমু খেতো। ইউরিয়া সারের হালকা বিষক্রিয়ায় হাতে উঠেছে ফুসকুড়ি। সেই হাতে আলতো করে টিপে দিত ওর টেপা মাছের মতো থুতনি। ছোট্ট মনিকা এক পলকে চেয়ে থাকতো নিজামের মুখের দিকে। হাত পা ছুড়ে ধরার চেষ্টা করতো লোকটাকে। হেসে উঠতো কলকল করে। গাঁইগুঁই করে করে কি যেন বলতো। আল্লাহ ছাড়া ওই ভাষা বোঝার সাধ্য কারো নাই। চরকার হাতা ঘোরাতে ঘোরাতে ফিরোজা প্যান প্যান করে উঠতো। কেদা পানি ছেনে আইলো। হাত মুখ ধোয়া নাই। মিয়ার গায়ে ফুসকা উইটবে তো! যাও আগে হাত মুখ ধুয়ে আসো। মিথ্যে মিথ্যে রাগ করতো। অন্য দিকে তাকিয়ে মুখ আড়াল করে ঠোঁট চেপে হাসতো। নিজামও হাসতো। দুজনে দুজনের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থাকতো। নিজাম চোখ টান দিত না। যতক্ষণ ফিরোজা লজ্জায় নামিয়ে না নিত। মাঝে মাঝে ফটিকের বৌ এসব দেখে ফেলতো। শরীরের ভিতরে আগুন জ্বলে উঠতো ওর। সহ্য করতে পারতো না। এতো আদিখ্যেতা ভালো না।
যব্বর মিয়ার বাপ হয়ছে। ফোড়ন কাটতো ফিরোজা। এরকম একটা মিয়া আর কয়জনের ঘরে আল্লাহ দেছে? বলতো নিজাম।
খুশিতে তখন ওর চোখমুখ লাল হয়ে যেত। ঠোঁট কাঁপতো। বুকের ছাতি ফুলে উঠতো। কখনো কখনো অজানা আবেগে ওর চোখ ছলছল করে উঠতো। কি এক ব্যথায় যেন বুকটা টনটন করতো।
আ-দেলহের ঘরে হইলো বেটি, নাড়ি থুয়ে ... কাটি। মুতা শলা দিয়ে উঠোন ঝাট দিত আর মনে মনে বকতো ফটিকের বৌ।
ফিরোজা বুঝতে পারতো স্বামীর মনের অবস্থা। দিনের এই একটা সময়েই নিজামের চোখে ঝিলিক দিয়ে ওঠে আনন্দের প্রজাপতি। সারাদিন কাঠফাটা রোদে মাঠে কাজ করে। সন্ধ্যার এই সময়টাতে বাড়ি ফিরে মেয়েটাকে আদর করে। পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে। বুকটা তবু পরিতৃপ্ত হয় না। মন চায় আরও একটু জড়িয়ে রাখে বুকের সাথে। শেষে ফিরোজার বকবকানি শুনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিছানায় নামিয়ে রাখে মেয়েটাকে। এরপর চলে যায় গহেরের তাঁত ঘরে। মাঝরাত পর্যন্ত তাঁত টানে। দুই পিছ লুঙ্গি বুনে বাড়িতে ফেরে। ফিরোজা ঘুমিয়ে পড়ে। ওর জন্য পুঁইশাক ভর্তা আর খেসারীর ডাল টিনের বাটিতে বেড়ে শরপোশ দিয়ে ঢেকে রাখে। নিজাম চুপি চুপি খেয়ে নেয়। মন চায় ফিরোজাকে ডেকে তোলে। কিন্তু ডাকে না। মনিকা ঘুমাচ্ছে। মেয়েকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে ফিরোজাও ঘুমিয়ে পড়ে। ওকে ডাকলে ওউ জেগে যাবে। একবার জাগলে সারারাত আর ঘুমাবে না। আস্তে করে শুয়ে পড়ে। কাঁথাটা টেনে গায়ের উপর চড়াতে চায়। পায়ের দিকে বড় গর্তমতো। সেই গর্তে পা ডুবে যায়। পরাৎ করে আরো খানিকটা ছিঁড়ে যায়। এইভাবে রোজই ছেঁড়ে। কিছুটা পায়ের ঘায়ে আর কিছুটা গোড়ালির ফাটা অংশের সাথে ঘষা লেগে ছেঁড়ে। কিচ্ছু মনে করে না ও। জীবনটাইতো ছিড়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কলার ফাতরার মতো ছিঁড়ে ফাতাফাতা হয়ে যাচ্ছে।
মোড়ের দোকানে নুন কিনতে গেলে রাজ্জাক খুনকার প্রতিদিন গালিগালাজ করে। খানকির বাচ্চা তোর ভোট দিতি যাতি কইছিলাম তুই যাস নাই । আমি কিছু মনে করি নাই। কিন্তু তুই আমার ক্ষ্যাতের আইল কাইটে পানি বের করে নিস, তোর এত্তো বড় সাহস? শালা রাজাকারের বাচ্চা তোর পাখা গজায়ছে? তোর পাখা এবার ভাঙ্গবো আমি। নিজামের বুকের ভিতর ছেড়াৎ করে ওঠে। আসন্ন বিপদ আঁচ করে ভয়ে কাঁপতে থাকে। হাত থেকে নুনের ঠোঁস গড়িয়ে পড়ে মাটিতে। পলিথিনের ঠোঁস ছিড়ে নুন ছড়িয়ে যায় বালিতে। সে কারো আইল কাটে নাই। পানিও বের করে নাই। রাজ্জাক খুনকার যাকে টার্গেট করে তাকে এই বলেই ধরে। প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে ধরে। মারধোর করে। মামলা দিয়ে দেয় চার পাঁচটা। সন্ধ্যায় তাহের এসে সমঝোতা প্রস্তাব দেয়। রাজ্জাক খুনকার যে মানুষ! শালা তো মানসির বাচ্চা না। ওর আইল কেটে পানি বের করেছিস। ও তো তোর নামে মামলা করে দেবে। ভোট দিতি যাস নাই এই কতা খান সাহেবের কান পর্যন্ত চলে গেছে। সে তো হুকুম দিয়ে দেচে তোর ঠ্যাং ভেঙ্গে দেবার জন্য। এখন কি করি ক তো?
এক কাম কর। হাজার বিশেক টাকা দে। খুনকারের সাথে একটা আপোষ করে দেই। তাহের নিজামের পরম বন্ধু হয়ে বিষয়টা মিটমাট করে দেবার চেষ্টা করে। আমি তো ভোট দিতি গিছিলাম। বেটারা কইলো আমার ভোট নাকি দেয়া হয়ে গেছে। পরে ফিরে আসলাম। কেউ তো ভোট দিতি পারে নাই। সগ্গলেরই একই কতা কয়া ফেরত দেচে। তোমাদের কষ্ট করে ভোট দিতি হবিনানে। আমরা দিয়ে দিছি তোমাদের ভোট।
ওসব কতা রাখ। তুই ওসব বুঝবিনানে। এখন টাকা দে আমি খুনকারের কাছে যাই। দেখি তোর জন্য আমি কিছু করতে পারি কিনা।
আমার ওই ঘরখান ছাড়া চার আনা পয়সাও তো নাই। মিয়াডা ঠান্ডায় কাতরাচ্ছে। ডাক্তারের কাছে নিতি পারতিচি নে টাহার অসম্বাবে। বউডাও লগিঢগি করে বেড়াচ্ছে। শরীরে শক্তিবল নাই। কামকাজ ঠিক মতো করতি পারে না। প্রায়ই মাতা ঘুরে পড়ে যায়। আমি এতগুনো টাহা কোনে পাবো কাকা তুমি কও?
ও কতা কলি তো কাম হবিনানে। বিপদ থেকে তো আগে রক্ষা পাতি অবি। এক কাম কর। ঘরখান খুনকারের কাছে বন্ধক রাইখে দ্যাক কত টাহা দেয়। পরে টাহা দিয়ে ঘর ফেরত নিস।
তেরো হাজার টাকায় ঘরটা বন্ধক রাখে খুনকারের কাছে। খুনকার একটা দলিলে সই করিয়ে নিয়ে তেরো হাজার টাকা দেয় নিজাম কে। নিজাম সেই টাকা পুরোটাই তুলে দেয় তাহেরের হাতে। রাতে গিয়ে তাহের ভাঙ্গা স্কুলের পিছনের জঙ্গলে বসে খুনকারের সাথে গাঁজা টানে আর অট্টহাসিতে এ ওর গায়ের উপরে গড়িয়ে পড়ে। উপরের ভাগ রাতেই পৌঁছে দিয়ে আসে তাহের। প্রতিটা গ্রাম থেকে একজন করে প্রতিনিধি এসেছে ভাগের অংশ নিয়ে। প্রতিদিন রাতেই ওদের আসতে হয়। ছিপি আঁটা ভদকার ছয়টা বোতল ওদের সামনে গড়িয়ে দিয়ে কবির খাঁ রওনা হয় তার উপরের নেতার ভাগ নিয়ে।
কাঁথার ছেঁড়া সুতোর টুকরো ফাটা পায়ে ঘা মারে। তখন ওর মাথার চাঁদি ঘুরে ওঠে। শব্দ করে না তবু। শুধু ভিতর থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসে একটা সংক্ষিপ্ত আর্তনাদ। কখন জানি খুনকার এসে ঘর ছাড়ার নোটিশ টাঙায় ওর ঘরের বেড়ার সাথে। দুইজন দুই পাশে শোয়। মাঝখানে ঘুমাচ্ছে মনিকা। চেরাগের লাল আলোয় ওর মুখটা লাল দেখায়। ঘুমাচ্ছে আর চপচপ করে দুধ খাচ্ছে। দুধ না। আসলে খাচ্ছে ওর বুড়ো আঙ্গুল। গালটা তুলতুলে। কপালের ডান পাশে কাজলতার কালো গোল টিপ। ছোট ছোট নিঃশ্বাসের সাথে সাথে ছোট্ট পেটটা উঠছে আর নামছে। নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া এই ঘরে এখন আর কোন শব্দ নাই। ফিরোজার নিঃশ্বাসে অপেক্ষাকৃত জোর বেশি। হালকা স্নোর। নিজামের খুব ভালো লাগে। মন চায় অনেক কিছু। কার্তিকের ঠান্ডা বাতাসে জানালার কপাট নড়ে ওঠে। ভাঙ্গা জানালায় বাড়ি খেয়ে সেই বাতাস ঢুকে পড়ে ঘরের ভিতরে। শীতল ঝাপটা লাগে গায়ে।
না থাক। ঘুমাক। সারাদিন ধরে ললি ভরে। সুতো পাড়ি করে। মেয়েকে সামলায়। বিচেনে পিঠ ঠেকাবার সময় পায় না। এখন ডেকে ওর কষ্ট বাড়ানো ঠিক হবে না। ও ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে ফিরোজা আগে ওঠে। নিজামকে ডাকে না। লোকটার জীবনটাই কষ্টে ভরা। ছোটকাল থেকে খাটছে একটানা খাটুনি। সামান্য একটু জিরোনোর সময় পায় না। একটু জিরোক। বেশি করে ঘুমাক। সারাদিনের ক্লান্তি ধুয়ে যাক ঘুমের স্বচ্ছ পানিতে। হাতমুখ ধুয়ে চুল আঁচড়ায়। চুলোর পোড়া মাটি দিয়ে দাঁত মাজে। ঘুঁটের ছাই দিয়ে বাসি বাসনকোসন মেজে ছড়িয়ে রাখে উঠোনের শেষ দিকের চুলোর ধারে। পাশেই মুরগির খোপ। একটা মোরগ আর দুটি মুরগী ছিল এতে। এখন আর নাই। মধ্য আগষ্টের রাতে চুরি হয়ে গেছে সবগুলো।
মুখে একটু ভেজলিন মাখে। স্নো পাউডার মাখতে পারলে ভালো হতো। সুন্দর একটা বাশনা বের হয়। বাশনাটা আবার নিজামের খুব ভালো লাগে। কিন্ত স্নো পাউডারের যে দাম। নুন কিনতেই ফুঁ ফুরোয়। স্নো কিনবে কি দিয়ে? মন চাইলেও কিছু করার নাই। মন তো কত কিছুই চায়। তার কি আর চাওয়ার শেষ আছে। সে তো ডালিম গাছের দোয়েল। এই নিচের ডালে তো ফুরুত করে উড়ে গিয়ে বসে মগডালে। চার মুড়া সুতো নিয়ে বসে পড়ে চরকায়।
নিজামের ঘুম ভেঙ্গে যায়। চৌকি থেকেই শুনতে পায় চরকি ঘোরার ফুনফুন শব্দ। বাইরে আসে। তাকায় ফিরোজার দিকে। কাঁধের উপরে ঝুলে আছে সুবিন্যস্ত চুলের জঙ্গল। হালকা বাতাসে উড়ছে দুই একটা চুল। সকালের ময়লা আলো ছড়িয়ে পড়েছে ফিরোজার মুখে। মুখটা চকচক করছে মেঘহীন স্বচ্ছ আকাশের মতো। নাকটা বেশি ঝলকাচ্ছে। মনে হচ্ছে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঠোঁটের কোনায় চাপা হাসি ফুটিয়ে, ডাকো নাই কেনে? ওর নাকের মাথা ফুলে ওঠে। চোখের ভিতর থেকে বের হয়ে আসে উদাসীন বিহ্বলতা।
তুমিও তো সকালে ডাকো নাই। মুচকি হেসে জবাব দেয় নিজাম। তাহলে কাল। এইভাবেই অতিক্রান্ত হয় প্রতিটা রাত। ডাকা আর হয়ে ওঠে না ওদের কেউ কাউকে। কাঁচামরিচ ভেঙ্গে একবাটি পান্তা ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়ে গড়ের মাঠে।
দুপুরে মনিকাকে গোসল করাচ্ছে ফিরোজা। চমকে ওঠে হঠাৎ। মেয়ের মাথার সামনে টিকলি বাঁধার জন্য একগুচ্ছ চুল বড় করে রেখেছিল। ওর খুব শখ যে মেয়ের মাথার সামনে কপাল জুড়ে একটা রুপোর টিকলি ঝুলবে। দুপুরের ময়লা রোদ এসে পড়বে সেই টিকলির উপরে। বাটা মাছের পিঠের মতো ঝিলিক দিয়ে উঠবে। তখন মনিকাকে যে কেউ দেখলে মনে হবে সূর্য উঠেছে রাজপ্রাসাদের মিনারের উপরে। ফিরোজা চিৎকার করে ওঠে। ওরে তুরা কিডা কোনে আছিত? কিডা যিনি আমার মনিকার মাথার চুল কাইটে নেছে। ওকে বাণ মারবে। যাদু টোনা করে শুকিয়ে মারবে আমার মেয়েটাকে। আল্লারে আমি মানুসির কি এমন ক্ষতি করিছি যে মানুষ আমার পিছনে এইভাবে লাগেছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে ফিরোজার একটানা কান্না। ফটিকের বৌ এসে শান্তনা দেবার চেষ্টা করে। কোন কাজ হয় না। ভিতর থেকে বমির হলকার মতো কান্না গুমরে গুমরে বেড়িয়ে আসে। বিরক্ত হয়ে ঘরে ফিরে যায় ফটিকের বৌ।
নিজাম ঘরে ফিরলে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে আর এক ল্যাওট। সব শুনে নিজাম বোবা হয়ে যায়। ওর মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হয় না।
এসব কথা হয়তো মনিকার মনে নাই। মনে থাকারও কথা না। বাঙালীর মন এমনিতে আত্মভোলা। সহজেই এরা ভুলে যায় গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সব মুহূর্ত। আয়না ঘরের গুম কাহিনি, মানুষের ঠোঁটের উপরে মস্ত তালা, মস্তিষ্কের উপরে ওয়ান ফোরটি ফোর, ক্রসফায়ার, এইসব ভয়ঙ্কর সময় পর্যন্ত তারা ভুলে যাবে কত অবলীলায়। নিজ দেশে পরবাসের মতো। ভিনদেশী মহাজনদের সকাল বিকাল চোখ রাঙানী। একই পিতার ঔরসজাত সন্তানদের ভিতরে রাজনৈতিক মতাদর্শের বিচারে পক্ষ শক্তি- বিপক্ষ শক্তিতে রুপান্তর। আরো কত কি। তবে বাপের শেষ দিনের স্মৃতি আর মায়ের সাথে কালসি বস্তিতে কিভাবে এসেছিল সেইটা মনিকার খুব ভালো মনে আছে। বলতে গেলে ওর চোখের সামনে সবসময় ভাসে এটা। এর জন্য মাঝে মাঝে মনিকা বিরক্তও হয়। রাগও হয় খুব। ভুলে যেতে চায় ওসব। মনকে প্রবোধ দেয়। কিন্ত ডালিম গাছের দোয়েলের মতো বারবার ওর চোখের সামনে লেজ নাড়ায় ঘটনাটা।
মনিকার বয়স তখন নয় বছর। মাঘ মাসের নরম রোদের ছোট বেলা। সূর্য পুব আকাশে উঁকি মেরেই যাই যাই বলে ওঠে। কুয়াশা ছাড়ে বেশ বেলা করে। কোনদিন ছাড়েই না। কাচি মাথাল নিয়ে নিজাম চলে গেছে গড়ের মাঠে। মনিকা ঘুম থেকে উঠে মায়ের কাছে বসে আলিফ বা তা ছা পড়ছে। বরফের কুঁচি মেশানো বাতাস ওর চোয়ালে একটানা থাপ্পড় মেরে যাচ্ছে। ফলে হরফগুলো মুখের ভিতর থেকে স্পষ্ট হয়ে বের হচ্ছে না। আটকে যাচ্ছে জিহবার কানায়। হলকুমের ভিতর থেকে বের হওয়া হরফগুলো দাঁতে তাঁতে বাড়ি খেয়ে বিকৃত উচ্চারণে ঝনাৎ করে উঠছে। ফিরোজা নলি ভরছে আর আনমনে তাকিয়ে আছে উঠোনের শেষ মাথার গাব গাছের দিকে। দুটি শালিক লাফাচ্ছে এ ডাল থেকে ও ডালে। প্রচন্ড শীতে কাঁপছে মেয়ে শালিকটা। পুরুষ শালিক তার ডানা দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে। শরীরের উত্তাপ দিয়ে ওকে ওম দিচ্ছে।
হঠাৎ ফটিকের বৌ চিৎকার করে ওঠে।
ও ভাবি! ভাই নাকি মাঠের ভিতরে মরে পড়ে আছে। কান ফাটানো একটা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ফিরোজা। ছোট মনিকা কি করবে বুঝতে পারে না। ও..ও কি কাঁদবে? এখন কি করা উচিত ওর? বুঝতে পারে না। মুহূর্তেই বাড়িটা লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। মানুষের দঙ্গলের ভিতর থেকে গুমরে ওঠে কান্নার হলকা। শেষে গ্রামের অধিকাংশ মুরুব্বিদের সমস্বরের কান্নায় ওউ কেঁদে ওঠে। লাশের সামনে বসে কাঁদছে সবাই। ফটিকের বৌ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে আত্মীয় স্বজনের কাছে খবর পাঠাতে। দুলাই চাচা আর দেলবর গেছে কবর খুঁড়তে। আছরের আগেই দাফন কাফন শেষ করা দরকার। ফিরোজার হুঁশ এখনও ফেরে নাই। বারান্দার মাথায় চিৎ করে শোয়ানো। স্যালাইন চলছে বাম হাতের শিরায়। লাশের গোসল দেবার জন্য মজিদ এসেছে। মজিদই পালন করেন এই দায়িত্বটা। কেউ দেয় নাই। তিনি নিজে থেকেই পালন করেন। মজিদের আগে ওর বাপ পালন করতো এই দায়িত্ব। গোসল দিতে গিয়ে মজিদ হাঁউমাউ করে কেঁদে ওঠে। কান্নার সাথে কি যেন বলছে সে। কিন্তু সামনের তিনটা দাঁত না থাকায় কথার আগেই বেরিয়ে যাচ্ছে পেটের বাতাস। ফলে ওর কথা কেউ বুঝতে পারে না। সবাই এগিয়ে গিয়ে দ্যাখে লাশের লজ্জাস্থান থেকে রক্ত ঝরছে। তার মানে এটা হার্টফেল নয়। সিদ্দিক কোন ফাঁকে পুলিশে খবর দিয়ে দেছে। পুলিশ এসে লাশের মুষ্টিবদ্ধ হাত থেকে রাজ্জাক খুনকারের বেলজিয়াম ঘড়িটি উদ্ধার করে। ময়নাতদন্ত শেষে পুলিশ লাশটা কাফন দাফনের অনুমতি দেয়। সুরতহাল রিপোর্টে বলা হয় রাষ্ট্র বিধ্বংসী অস্ত্র বানাতে গিয়ে সেটার বিস্ফোরণে তিনি ঘটনা স্থলেই মারা যান। স্বামীর অপরাধে সহযোগিতার অভিযোগে ফিরোজাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ছোট একটা কাপড়ের পুটলি দেখিয়ে পুলিশ বলে, লাশের কোমড়ে লুঙ্গির গিঁট থেকে এটি পাওয়া গেছে। পুলিশের ধারণা এইটা দিয়েই নিজাম বোমা বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল।