সাগর আহমেদ
ইউরোপের একটি ছবির মতো সুন্দর ও সমৃদ্ধ দেশ জার্মানি। চারিদিকে নয়নাভিরাম প্রকৃতি আর সারা দেশ জুড়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা নদ, নদী দেখে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য। টোকন মামা কিশোর দলের তিন সদস্য অপু,তিয়ান ও টিয়ানাকে নিয়ে ট্যুরিস্ট হিসেবে জার্মানিতে বেড়াতে এসেছেন। উদ্যেশ্য: জার্মানির বড় বড় শহর ঘুরে দেখা। বন, বার্লিন, রাইখস্ট্যাগ ইত্যাদি প্রসিদ্ধ শহর ঘুরে বেড়িয়ে ওরা পৌঁছল হ্যানোভার শহরে। এখানের ফাস্টফুডের দোকানগুলোতে বিশেষ ভাবে তৈরি ও খুব সুস্বাদু ডোনাট, বার্গার, মমো ইত্যাদি পাওয়া যায়। আর মজাদার খাবারের সন্ধান পেলে তিয়ান যে খুব খুশি হয় তা বলাই বাহুল্য। ওরা সেভোয়ারি ট্রিট নামের একটি ফাস্টফুডের দোকানে মজা করে ডোনাট,মমো ও লেমনেড খেয়ে বাইরে বেরুতেই টোকন মামা বললেন, বলতো আর কোথায় যাওয়া যায়? টিয়ানা ঠোঁট উল্টে বলল, সেটা আমরা কি জানি? আপনি এ দেশে আগে অনেকবার এসেছেন, আপনি জানেন ঘুরে বেড়ানোর মতো আর কোথায় যাওয়া যায়, কোথায় গেলে আমরা মজা পাবো। টোকন মামা মুখ টিপে হেসে বলল তোমরা হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার গল্পটা পাঠ্যবইয়ে পড়োনি? অপু, তিয়ান ও টিয়ানা সমস্বরে চেঁচিয়ে বললো পড়েছি,পড়েছি। টোকন মামা বললেন এবার আমরা হ্যামিলন শহরে যাবো। ওরা আরেকবার চেঁচিয়ে উঠলো, হুররে। কিছুক্ষণ পর টোকন মামা ও কিশোর দলের সদস্যরা একটা ভোক্স ওয়াগন গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিলো হ্যামিলন শহরের দিকে। বেশি দূরে নয়, হ্যানোভার শহর থেকে মাত্র ৩৩ মাইল দক্ষিণে। এক ঘন্টা পেরুবার আগেই ওরা হ্যামিলন শহরে পৌঁছে গেলো। ওরা শহরের ভিতর দিয়ে গাড়িতে চড়ে প্যারাগন সাফারি পার্কের দিকে যাচ্ছিলো, পথে একটা বিশাল জুয়েলারি শপ থেকে হৈচৈ, চিৎকার, চেঁচামেচির আওয়াজ শোনা গেল। জুয়েলারি শপটার নাম অর্নেট গ্রান্ড জুয়েলারি। টোকন মামা অপু,তিয়ান ও টিয়ানাকে বললেন, চলতো দেখে আসি কি হয়েছে ওখানে। সবাই ভোক্স ওয়াগন গাড়ি থেকে নেমে জুয়েলারি শপটার দিকে এগিয়ে চললো। বাট উয়িং ডোর ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই তারা অবাক হয়ে গেল। জুয়েলারি শপটার সবগুলো শোকেস খালি। একটাতেও কোনো অলঙ্কার নেই। ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা সেলসম্যানদের চোখে মুখে আতঙ্ক। কিছুক্ষণ পরেই একদল পুলিশ এসে ঢুকলো। সেলসম্যানদের কাছ থেকে জানা গেল একজন মুখোশ পরা অদ্ভুত লোক, মুখে লম্বা, লিকলিকে একটা বাঁশি হঠাৎ করে দোকানে ঢুকে পড়ে। সে হঠাৎ বাঁশিটা বাজাতে শুরু করে। আর দোকানে যত সেলসম্যান ও কাস্টমার ছিলো তারা সবাই যেনো স্থির, নিশ্চল ও ঘোরের ভিতর ঢুকে পড়ে। তারা যে যেখানে ছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। বাঁশিওয়ালা লোকটি সবার চোখের সামনে দিয়ে শোকেসের গহনাগুলো একটা লম্বা ঝোলায় ভরে নিয়ে চলে যায়। সবাই সম্মোহিত হয়ে আরো বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর হঠাৎ করেই সবার জ্ঞান ও সচেতনতা ফিরে আসে। অনেকেই হৈচৈ শুরু করে দেয়। একজন সেলসম্যান পুলিশে ফোন করে। প্রায় সাথে সাথেই পুলিশ এসে হাজির হয়ে যায়। তারা সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে টোকন মামা,অপু, তিয়ান ও টিয়ানা সেখান থেকে বেরিয়ে এসে আবার গাড়িতে চড়ে প্যারাগন সাফারি পার্কের দিকে রওনা দেয়। সাফারি পার্কে অনেক পশু,পাখির সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয়। বাঘ, সিংহ, হরিণ এগুলো তো পরিচিত প্রাণী। কিন্তু ওরা অবাক হলো পান্ডা পিঁপড়া নামক এক মজার প্রাণী দেখে। এটি বড় আকৃতির এক ধরনের পতঙ্গ। পিঁপড়ার মতো দেখতে কিন্তু শরীরটা পান্ডার মতো সাদা কালোয় ডোরাকাটা। প্যারাগন সাফারি পার্ক থেকে বেরিয়ে তারা হ্যামিলন শহরের ড্রাগন হিরো ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে উঠলো। ক্লান্তিতে তারা সবাই দ্রুত ঘুমিয়ে পড়লো। পরের দিন হোটেলে সকালের নাস্তা খেয়ে ওরা আবার শহরটা ঘুরে দেখতে বের হলো। টোকন মামা কিশোর দলের তিন সদস্য অপু,তিয়ান ও টিয়ানাকে নিয়ে রিজ ম্যাক্স ব্যাংকে গেলেন। তার টাকা ফুরিয়ে গেছে। ট্রাভেলার্স চেক দিয়ে যখন তিনি টাকা তুলছিলেন তখন হঠাৎ করে হ্যামিলনের সেই বাঁশিওয়ালার দেখা মিললো। লম্বা চওড়া সেই লোকটি ঝোলা থেকে বাঁশি বের করে বাজাতে শুরু করলো। অদ্ভুত মোহন সুর ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে।সাথে খুব হালকা একটা মিষ্টি গন্ধ। গন্ধটা নাকে আসতেই টোকন মামা কিশোর দলের সবাইকে দম বন্ধ করতে বললেন। ততক্ষণে ব্যাংকের অফিসাররা অনেকটা হতভম্ব ও সম্মোহিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাঁশিওয়ালা বাঁশি বাজাতে বাজাতে ব্যাংকের ক্যাশ সেকসনের ভিতরে ঢুকে পড়লো। সে হেড ক্যাশিয়ারের টেবিল থেকে ভল্টের চাবিগুলো নিয়ে ভল্টের দিকে এগিয়ে চললো। এমন সময় টোকন মামা ও অপু দুদিক থেকে বাঁশিওয়ালাকে আক্রমণ করলো। অপু ফ্লায়িং কিক মেরে বাঁশিওয়ালাকে মেঝেতে ফেলে দিলো। বাঁশিওয়ালা দ্রুত উঠে টিয়ানার দিকে পিস্তল তাক করে ওকে সামনে টেনে মানব ঢাল তৈরি করলো।
তারপর হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা চেঁচিয়ে বললো, তোমরা কেউ এগুতে চেষ্টা করলে ওকে গুলী করে মেরে ফেলবো। একথা বলে সে টিয়ানাকে টানতে টানতে ভোল্টের দিকে এগিয়ে চললো। তার উদ্দেশ্য ভল্ট থেকে টাকা বের করে নিয়ে টিয়ানাকে কাভার বানিয়ে ব্যাংক থেকে বের হয়ে যাওয়া। বাঁশিওয়ালার চোখ সাবধানে টোকন মামা,অপু ও তিয়ানের দিকে নিবদ্ধ। আচমকা টিয়ানা একটু নিচু হয়ে দুই হাতে বাঁশিওয়ালার পিস্তলে আঘাত করলো। পিস্তলটা উড়ে কয়েক হাত দূরে পড়লো। তিয়ান এগিয়ে এসে প্রচন্ড জোরে বাঁশিওয়ালার চোয়ালে ঘুসি বসিয়ে দিলো। তিয়ান ব্যায়াম করা বলিষ্ঠ এক কিশোর। তার ঘুসি খেয়ে হ্যামিলনের সেই রহস্যময় বাঁশিওয়ালা জ্ঞান হারালো। একটু পরেই টোকন মামার ফোন পেয়ে পুলিশ এলো। পুলিশের এস আই ম্যাক্স মুলার কালকেও অর্নেট গ্রান্ড জুয়েলারিতে টোকন মামা ও কিশোর দলকে দেখেছিলেন। তিনি আজকে এগিয়ে এসে তাদের সাথে পরিচিত হলেন। অপু বলল, আমরা তিন কিশোর কিশোরী গোয়েন্দা দল গঠন করেছি। এই দলের নাম কিশোর দল। আমরা সারা বিশ্বে ঘুরে রহস্য সমাধান করি আর অ্যাডভেঞ্চার করে বেড়াই। বেশিরভাগ অভিযানে টোকন মামা আমাদের সাথেই থাকেন। টোকন মামা তখন পুলিশ চিফ ম্যাক্স মুলারকে বললেন, আমার বিশ্বাস বাঁশিওয়ালার বাঁশিতে কোনো যাদু নেই, নিশ্চয়ই সে বাঁশি কে স্প্রে হিসেবে ব্যাবহার করে চেতনানাশক ঔষধ ছড়িয়ে সবাইকে এক ধরনের ঘোরের মধ্যে ফেলে এই অপরাধগুলো করে।যাহোক, সাথে সাথে ডাক্তার ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এনে বাঁশিটা পরীক্ষা করতেই টোকন মামার সন্দেহের সত্যতা প্রমাণিত হলো।বাঁশির ভিতরের কনটেইনারে লাইসারজিক এসিড ও ডায়েথিলামাইডের সংমিশ্রণে তৈরি একটি শক্তিশালী চেতনা নাশক ও বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী ঔষধ রয়েছে। এই ঔষধের সাহায্যেই সে সবাইকে সম্মোহিত করে লুটতরাজ চালাতো। এরপর বাঁশিওয়ালার মুখোশ পরীক্ষা করে দেখা গেল ,মুখোশটির সাথে আধা ঘন্টা চলার উপযোগী অক্সিজন সিলিন্ডার যুক্ত আছে। ফলে তাকে ঔষধ যুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে হয় না। ইতোমধ্যে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার জ্ঞান ফিরে এসেছে।
সে চোখ পিটপিট করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। পুলিশ চিফ ম্যাক্স মুলার টোকন মামা ও কিশোর দলকে ধন্যবাদ জানিয়ে , হ্যামিলনের সেই ভন্ড বাঁশিওয়ালাকে পিছমোড়া করে বেঁধে থানায় নিয়ে চললো। অপু,তিয়ান ও টিয়ানার মাথা তখন কিছুটা ঝিমঝিম করছিলো। কারণ কিছুক্ষণ দম বন্ধ করে থাকলেও চেতনা নাশক ঔষধের সম্পুর্ণ প্রভাব থেকে তারা মুক্ত হতে পারেনি। তারা তাড়াতাড়ি ভোক্স ওয়াগন গাড়িতে চড়ে ড্রাগন হিরো ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে পৌঁছে ঘুমিয়ে পড়লো। পরের দিন টোকন মামা ও কিশোর দলের সদস্যরা সুস্থ শরীরে হ্যানোভার শহরে ফিরে গিয়ে বিমান যোগে রওনা দিলো মাতৃভূমি বাংলাদেশের উদ্দেশে।