আব্দুস সালাম
তাকিয়াদের বাড়ির একেবারে উল্টোদিকেই সজীবের বাড়ি। কিন্তু এত কাছে থাকলেও মেয়েটির সঙ্গে তার খুব একটা কথা হয়নি কখনো। ছোটবেলায় সে প্রায়ই দেখতÑছায়ায় ডোবা উঠোনে তাকিয়া হাসছে, খেলছে তার বান্ধবীদের সঙ্গে। মুখভরা প্রাণ, চোখে ভেসে বেড়ানো স্বপ্নের ঝিলিক। আর সজীব? চুপচাপ, স্বভাবতই একটু গুটিয়ে থাকা ছেলে—চোখে পড়লেও যেন কারও নজরে পড়ে না কখনো।
তখন তাকিয়া হাইস্কুলের ছাত্রী, বয়সে বেশ ছোট; আর সজীব সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছে। দুজনের কথোপকথন ছিল সীমিত, অল্প ক’টি বাক্যে গাঁথা। মাঝেমধ্যে সজীব জিজ্ঞেস করতÑ ‘কোন ক্লাসে পড়ো?’, ‘পরীক্ষা কেমন হলো?’, কিংবা ‘রেজাল্ট ভালো হয়েছে তো?’ এসব প্রশ্নেই সীমাবদ্ধ ছিল তাদের আলাপচারিতা।
কিন্তু সময় তার নিয়মে চলতে থাকে। এক সময় তাকিয়াও কলেজে উঠল, আর সে-ও ভর্তি হলো সেই একই কলেজে, যেখানে সজীব তখন অনার্সের তৃতীয় বর্ষে। লাইব্রেরিতে দেখা, কলেজে যাওয়া-আসার পথে দেখা— এইসব ক্ষণিকের সান্নিধ্য যেন সজীবের জীবনে এক অজানা আলো এনে দেয়। তাকিয়া শ্যামবর্ণ, কিন্তু তার সৌন্দর্য ছিল চোখের ভাষায়, চিবুকের দৃঢ়তায়। সে কোনো ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া মেয়ে নয়— তাকে একবার দেখলেই আর চোখ ফেরানো যায় না। সজীবের মনে তার প্রতি একটা দুর্বলতা জন্মাতে থাকে— নীরব, গোপন, কিন্তু গভীর।
কিন্তু তাকিয়া? সে এক উচ্চাশার অঙ্গিনায় বাস করে। তার চারপাশে ধনী বন্ধুবান্ধব, দামি গাড়ি, স্মার্টফোন, পারফিউমের গন্ধে মোড়া উচ্চবিত্তের আভিজাত্য। সে চায় উঁচু সমাজে উঠতে- সেখানেই তার ভবিষ্যৎ, তার স্বপ্ন। সজীব সেখানে একরকম বেমানানÑ উচ্চতায় সমান, পোশাকে একেবারে সাধারণ, আর পরিবারের আর্থিক অবস্থাও কেবল গড়পড়তা, ঠিক মাঝামাঝি কোথাও আটকে থাকা এক ছায়াপথের যাত্রী।
তাকিয়া একদিন সবার সামনে বলে বসেÑ
“খাটো ছেলেদের আমি সহ্য করতে পারি না। দেখলেই ঘৃণা লাগে। গরিব হলেও মেনে নিতে পারি, কিন্তু খাটো ছেলেকে? না, কখনো নয়।”
তার বান্ধবীরা হেসে ওঠে। কথাটা যে সজীবকে উদ্দেশ্য করে বলা, সে বুঝে যায়। মুখে কিছু বলে না, কিন্তু হৃদয়ের এক গভীর কোণে গড়িয়ে পড়ে রক্ত। অপমান সে করে না, সহ্য করে— নিঃশব্দে।
এরপর থেকে সজীব তাকিয়াকে এড়িয়ে চলে, এমনকি সে যে পথে হেঁটে যায়, সে পথও বদলে ফেলে।
কয়েক বছর পরÑ খবর আসে, তাকিয়ার বিয়ে হয়েছে। পাত্র এক শিল্পপতির ছেলে- প্রচুর অর্থ, গ্ল্যামার, গাড়ি-বাড়ি, সব আছে। সজীব তখন আইন পাশ করে নিজের এলাকাতেই ওকালতি শুরু করেছে। অল্পদিনেই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েÑ একজন সৎ, পরিশ্রমী, দৃঢ়চিত্ত উকিল। লোকের মুখে মুখে তার নাম।
তাকিয়ার জীবন, প্রথমদিকে রঙিন স্বপ্নের মতো ছিল। কিন্তু সময় যত গড়ায়, স্বপ্নের রঙ মুছে গিয়ে ভেসে ওঠে নির্মম বাস্তবতা। স্বামী নেশাগ্রস্ত, রাত্রে ঘরে ফেরে না, কথায় কথায় গায়ে হাত তোলে। তাকিয়া সহ্য করে, লজ্জায় কাউকে কিছু বলে না। কিন্তু এক রাতে মার খেয়ে অসহ্য হয়ে বাবার কাছে সব খুলে বলে। মামলা হয়Ñ স্বামী ক্ষিপ্ত হয়, তাকিয়াকে প্রাণে মারার হুমকি দেয়।
তখন তাকিয়া বলেÑ
“আমার বিচ্ছেদ চাই, তবে আইনের পথেই।”
তাকিয়ার বাবা যে উকিলকে ধরে, তিনি আর কেউ ননÑ সেই সজীব। সজীবের কথামতো তাকিয়া একদিন সজীবের চেম্বারে আসে। সজীব চুপচাপ শুনে যায় সব কথা। একটুও ভেঙে পড়ে না, প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করে না। শুধু পাথরের মতো বসে থাকে।
তাকিয়া এক সময় বললÑ
“ভাই, একদিন আপনাকে খুব অপমান করেছিলাম। আজ সেই দুঃখ নিয়েই এসেছি। আমাকে ক্ষমা করবেন?”
সজীবের চোখে জমে ওঠে অচেনা জল। ঠোঁটের কোণে একটুকরো বিষণ্ন হাসি। কণ্ঠে মৃদু অনুযোগÑ
আমি নই, তাকিয়া তুমি নিজের স্বপ্নকে অপমান করেছিলে। আমি তো ছিলাম শুধু সেই স্বপ্নের এক নীরব পথচারী
তাকিয়া মাথা নিচু করে বলে-
“আজ বুঝতে পারছি, যাকে হেয় করেছিলাম, আজ সে-ই পাশে দাঁড়িয়েছে। আর যাকে শ্রেষ্ঠ ভেবেছিলাম, সে-ই আমার সর্বনাশ করেছে।”
সজীব তাকিয়ে থাকে— অতীতের সব দুঃখ যেন এক মুহূর্তে গলে গিয়ে কোথাও হারিয়ে যায়। সে শুধু বলেÑ
“আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব, তোমার সঙ্গে যে অন্যায় করেছে, সে যেন শাস্তি পায়।”
তাকিয়া বাড়ি ফেরেÑ ক্লান্ত, ভগ্নহৃদয়, কিন্তু একটুখানি শান্তি নিয়ে। মনে মনে ভাবেÑ
“আজ যদি সেদিন আমি অহংকার না করতাম, যদি ছোটবেলায় সেই ছেলেটার দিকে একটু মানবিক দৃষ্টিতে তাকাতাম— তাহলে হয়তো আমার জীবনের দৃশ্যপট অন্যরকম হতো। সে উপলব্ধি করে- মানুষের মূল্য পরিমাপ করা যায় না তার উচ্চতা বা ধনে। হৃদয়ের গভীরতা আর চরিত্রের উজ্জ্বলতাই মানুষের আসল পরিচয়। অহংকার, আত্মপ্রশংসা আর বাহ্যিক চাকচিক্যে বিভ্রান্ত হয়ে কখনোই প্রকৃত মূল্যবান সম্পর্ক হারিয়ে ফেলতে নেই। অন্ধকারের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে আত্মদর্শন আর নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে।