তাহনিয়া তরিক
প্রবেশপত্রটা ব্যাগে ঢুকাতে গিয়ে দু’ফোঁটা পানি চলে এল সায়মার চোখে। কেউ দেখার আগেই হাতের পিঠে চোখ মুছে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো কলেজের গেট দিয়ে। বাসায় গিয়ে আব্বু আর ভাইয়ার জন্য রান্না করতে হবে ওকে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাইফ গল্প করছে বন্ধু মাহসিনের সাথে। ‘এ্যাড্মিট নিয়েছ?’ -ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল সায়মা। ঘাড় কাৎ করল সাইফ। নীরবে রিকশায় উঠে বসল দু’ভাইবোন। দু’জনের চোখেই তখন দু’বছর আগের দৃশ্য। এস.এস.সি পরীক্ষার প্রথম দিন কত যত্নে গুছিয়ে দিয়েছিলেন আম্মু। কত মমতা মিশিয়ে রান্না করেছিলেন দু’ ভাইবোনের পছন্দের আইটেম। অথচ আজ আম্মুকে ছাড়া ...................!
‘তারপর?’- মেয়েটা খানিক থামতেই পরম আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন মাহমুদা বেগম। শেষ বিকালের পড়ন্ত রোদ এসে পড়েছে শেফালী নামের মেয়েটার শ্যামলা মায়াবী চেহারায়। একমনে শুনাচ্ছে ফেলে আসা দিনের গল্প। শূন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ও। তারপর মাহমুদা বেগমের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল- তারপর আর কি আপা? কনে যাব? মাতাল স্বামীর হাত থেইকা পালায়া বাঁচছি কিন্তু ভাইরা তো আগেই খেদাইছে। তাই আর কি? পেটের দায়ে নাইমা পড়ছি এই রাস্তায়। জীবনের এক অধ্যায়ে প্রবেশের পিছনের পর্দা উন্মোচন করে থামল ও। তন্ময় হয়ে ওর চেহারায় চেয়ে রয়েছেন মাহমুদা বেগম। আপা!- কারো ডাকে পিছনে তাকিয়ে দেখেন কমলা রাণী দাঁড়িয়ে-‘ আপা এখনি ঘন্টা দিবো। ভিতরে যাবেন না?’ বড় গেটটার দিকে তাকালেন মাহমুদা। একজন দুইজন করে ভিতরে ঢুকে পড়ছে। ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে চত্বর। উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ‘চল অজু করে আসি’ - হাউজের দিকে পা বাড়ালেন। পিছনে শেফালী আর কমলাও। হাউজের কাছে অনেকেই অযু করছে। নতুন অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে গিয়ে ভুল করছে কেউ কেউ। হাসাহাসি করছে একেকজন। তাকে দেখেই থেমে গেল সবাই- আপা, সালাম! ‘ওয়ালাইকুমসালাম’- হাসিমুখে জবাব দিলেন তিনি। কমলার তোলা এক ঘটি বরাদ্দ পানি দিয়ে অযু করে নিলেন। ঘন্টা বেজে উঠল ঢং ঢং ঢং রবে। হৈ চৈ পড়ে গেল চারপাশে- ছয়টা বেজে গেছে। অসহনীয় গুনতি শেষে গেটে ঢুকতেই তালা পড়ে গেল। বারো ঘন্টার জন্য আঁধার নামলো এ জগতে। ধীর পায়ে রুমে ঢুকে দেখেন একমনে কুরআন তিলাওয়াত করছেন ফাহিমা হাসান। সদর উপজেলার জনপ্রিয় মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান হওয়াতেই আজ এখানে তার আগমন। পায়ের শব্দ পেয়েও মাথা তুললেন না। কাছে যেয়ে বসলেন মাহমুদা। ‘আপা শরীর কি অনেক খারাপ লাগছে?’- মাথায় হাত রাখলেন। মুখ তুলে তাকালেন ফাহিমা আপা। কুরআনটা বন্ধ করে রাখলেন। ব্যক্তিত্বপূর্ণ চেহারাটা ঈষৎ মলিন দেখাচ্ছে। ‘এই তো আল্লাহ রেখেছেন। কাল থেকে ছেলেমেয়ে দু’টোর পরীক্ষা। কি না জানি করছে ওরা!-দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। ব্যথায় ফুলে ওঠা পাটা সোজা করলেন। বাতের ব্যথাটা বেড়েছে খুব। পরীক্ষা! - সকালে মনে পড়ে যাওয়া জিনিসটা আবার মনে পড়ল মাহমুদা বেগমের। মাহসিন! তার আদরের একমাত্র পুত্র সন্তান। আজ উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ! অথচ তিনি........! গত পরশু এসে দোআ চেয়ে গেছে ছেলেমেয়েগুলি। খানিকক্ষণ নিশ্চুপ থাকলেন দু’জনেই। চোখের সামনে হয়তোবা ভেসে উঠল বাড়ির কত দৃশ্যপট! নিমিষেই বদলে গেল ক্যানভাস, সেখানে এখন শুধুই শূন্যতা আর অশ্রুর আধিক্য। আজান কানে আসতেই উঠে দাঁড়ালেন তারা। বাইরে মিলিয়ে গেল গোধূলির আভা। হারিয়ে গেল অনিশ্চয়তা আর কষ্টের আরেকটি দিবস। চাদর বিছিয়ে অপেক্ষা করছে শেফালী সহ অন্যান্যরা। কমলাও দাঁড়িয়েছে আজকে। নামটা বদলানোর অপেক্ষায় আছে ত্রিশোর্ধ কমলা রাণী। অপেক্ষমাণ মুখগুলো দেখে প্রশান্তিতে বুক ভরে গেল মাহমুদা বেগমের। ক্রমবর্ধমান ডায়াবেটিস, হাই প্রেসার, খাওয়া না খাওয়া দিনরাত্রি, বাইরের সাথে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অসহ্য কষ্টের মুহুর্তগুলো সব তুচ্ছ হয়ে গেল। আপনজন বিচ্ছেদের সব মর্মযাতনা উবে গেল চোখের পলকে। বুক ভরে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করলেন তিনি।
মাঝরাত। অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করে নির্ধারিত সামান্য জায়গাটুকুতে উঠে বসলেন ভাইস চেয়ারম্যান ফাহিমা হাসান। ঘামে ভিজে গেছে সারা শরীর। ঘুরতে থাকা ফ্যানের বাতাস খুব সামান্যই গায়ে লাগছে। মশার কামড়ে লাল হয়ে গেছে দু’হাত। আচল দিয়ে ঘাম মুছলেন। বাইরে রাতের পাহারাদারের পদশব্দ শোনা যাচ্ছে। গরাদের ফাঁক দিয়ে তীক্ষè হলুদ আলো এসে পড়ছে ঘরে। গ্রীল আঁকড়ে ধরে বসে আছে বীণা। এই পনের দিন ধরে একই দৃশ্য দেখছেন। ১৬ বছর ধরে রাতে ভালেঅ ঘুমাতে পারে না বীণা। আরও দশটা বছর কিভাবে কাটাবে জানে না। ডাকলেই ছলছল চোখে পিছন ফিরে তাকালো। ‘আপা’!-করুণ স্বরে ডাকলো। দু’হাত জড়িয়ে ধরল ফাহিমা হাসানের- ‘আল্লায় কি আমারে ক্ষমা করবো না?’ কি জবাব দিবেন বুঝতে পারেন না। দু’দিন আগেই ক্ষুদে ক্ষুদে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাদের কিভাবে ভিনদেশের পঙ্কিল জগতে ঠেলে দিয়েছে সেই কাহিনী শুনাচ্ছিল মহিলা। ‘আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে তুমি যদি ভাল হয়ে যেতে চাও, তিনি তোমাকে অবশ্যই গ্রহণ করবেন’-ওর মাথায় হাত বুলালেন ফাহিমা হাসান। আশান্বিত মনে হল বীণাকে। তারপর চোখ মুছতে মুছতে বলল- আপা কাইল কি যাইবেন গা ?’ ‘কি জানি, কোর্টে যাওয়ার কথা আছে।’-ফাহিমা হাসানের কথায় আবার মলিন হয়ে গেল বীণা নামের মহিলাটির চেহারা। ভোর হওয়ার আগেই সিরিয়াল পড়ে যায়। বাচ্চার মায়েরা আগে দাঁড়ানোর সুযোগ পায়। তারপর তাদের দুজ’নের জন্য জায়গা ছেড়ে দেয় সবাই। আগে ভাগেই বালতিতে তুলে রাখা পানি দিয়ে অজু করে নিলেন ফাহিমা। বীণাও অজু করল। ওর চেহারা থেকে টপকে পড়া পানির ফোঁটার দিকে তাকিয়ে কেমন ভালো লাগার অনুভূতি বয়ে গেল শিড়দাঁড়া বেয়ে। তাদের বুকে পাথর বাধা কষ্টের এ মুহূর্তগুলো মূল্যহীন হচ্ছে না!! বৃথা যাচ্ছে না!!! এ জগতের মাঝে অবস্থানের অসহ মানসিক যন্ত্রণাটার উপশম হচ্ছে ধীরে ধীরে। নামাযে দাঁড়ালেন । মুনাজাতে চোখের পানি ফেলে দোআ করলেন এই অন্ধ জগতের বাসিন্দাদের জন্য।
প্রতিদিনকার মতো সকালের নাস্তা খাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে রক্ষীকে ক্যান্টিনে পাঠালেন মাহমুদা বেগম। তাদের দু’জনের জন্য ডায়াবেটিস উপযোগী সেই সাথে রুমের মায়া আর সখিনার দুই বাচ্চার জন্য কিছু খাবার আনতে দিলেন। খাওয়া শেষে অভ্যাসমত দোআ শিখতে আসল কয়েকজন। তারপর ব্যাগ ব্যাগেজ কিছু গুছিয়ে রেখে গোছল সেরে নিলেন দু’জনে। সবার মুখে এক কথা- ‘আপা আজ আপনাদের জামিন?’
সন্ধ্যার খানিক পূর্বে যখন গেট দিয়ে প্রবেশ করলেন, হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল চত্বরবাসী। ক’ঘন্টা পূর্বে কান্নাঘন পরিবেশে বিদায় দেওয়া মানুষ দুইজনকে ফেরত আসতে দেখে ওদেরও অভিব্যক্তি যে কত অদ্ভুত আর মিশ্র প্রকৃতির হল তা বোঝানোর সাধ্য নেই কলমের। দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল কমলা -‘আপা কী হইল ?’ শেফালী তো দেখেই কেঁদে ফেললো-‘জামিন দিল না, আপা ?’ একে একে চারপাশে ভিড় জমাতে শুরু করেছে ১৫ দিনের প্রতিবেশীরা। এ জগতে এসে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে সবার সুখ দুঃখ, হাসি কান্না। চল্লিশ বছর ধরে এ জগতের সবচেয়ে প্রাচীন অধিবাসী সেলিনা। সতীনের খুনের দায় সইছে বলে শোনা যায়। সে ধীর পায়ে এগিয়ে এল সামনে। কোমরে হাত রেখে তাকাল চারিদিকে—
‘আপারা চলে যাওয়াতে আমাদের সবারই মনে হর্ইছিল যেন আপনকেও চইলে গেছে। কিন্তু এইহানে আবার ফিরা আসবেন তা চাইনা। আপনাগো তো কোন দোষই নাই। সরকারে খালি খালি আটকায়ে রাখছে। আপনারা ভালয় ভালয় বাড়িতে ফিরে যান আমরা তাই চাইছি। এ অন্যায় সওয়া যায় না। তাইনা ?’ এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে সমর্থনের আশায় সবার দিকে তাকাল ও। হ্যাঁ, হ্যাঁ রব উঠল চারিধারে। কেউ শিশু পাচারের দায়ে ত্রিশ বছর পার করেছে এ জগতে, কেউ খুনের দায়ে ৪২ বছর ধরে মুক্ত বাতাস দেখে না, কেউ দেহ পসারিণী, কেউ পকেটমার, কেউ মাদক বিক্রেতা। লাল দেয়ালের আড়ালের জঘন্য জগতের এই মানুষগুলোর মনে কত অকৃত্রিম ভলোবাসা!
কত জঘন্য এ জগত ! কত পঙ্কিল এ জীবন! বাইরের পৃথিবী এদের ভয়ংকর জানলেও কত সরলতা এদের মনে! বাহিরের ওই স্বার্থলোলুপ দু’ পায়ীদের চেয়ে এরা কত স্বচ্ছ! শুধু জীবনে সঠিক আদর্শের অভাবেই আজ ওরা এ লাল দেওয়ালের বাসিন্দা। ‘আর তারা দু’জন’ - ভাবেন মাহমুদা বেগম - ‘জীবনে সঠিক আদর্শ ধারণ করার অপরাধে আজ এ জগতের বাসিন্দা, সমাজের আঁধারের মাঝখানে আলোকশিখা জ্বালতে চাওয়ার অপরাধে আজ অপরাধী তারা এবং তাদের মত আরো অনেকে!!! আজও সন্ধ্যার গুনতির ঘন্টা বাজলো ‘ঢং’ ...। শেষ হল নিঠুর এ দেয়ালের ভিতরের আরেকটি দিবস।
বাইরে তখন আশাভঙ্গ হৃদয়ে মাকে ছাড়াই দ্বিতীয় পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে মাহসিন, সাইফ আর সায়মা।