ইকবাল কবীর মোহন
তপ্ত মরুর বালুকণাতে রোদ তখনও আগুন ধরায়নি। ভোরের সূর্য ঘন নীল সবেমাত্র আকাশে উঁকি মেরেছে। স্নিগ্ধ সতেজ ঝলমলে সকাল। চারদিকে আজ যেন এক অজানা সুখের সুবাতাস বইছে। বহুদিন পর মক্কার অলিতে-গলিতে আনন্দঘন এক মধুর আমেজ বিরাজ করছে। খেজুর গাছের পাতায় পাতায় যেন সুখের নাচন ধরেছে। মক্কার প্রতিটি ঘরে আজ সাজ সাজ পরিবেশ। যেন এক উৎসবের আমেজ। কী সেই উৎসব? কী সেই আনন্দধারা? সে তো আর কিছুই নয়। আজ যে মক্কা বিজয়ের দিন। মুসলমানদের পরম আনন্দের দিন। দীর্ঘ একযুগ পর আল্ল¬াহর নবী মুহাম্মদ (সা) ফিরে আসছেন মাতৃভূমি মক্কায়। তাই মক্কাবাসীর এই আনন্দ আর কে দেখে? ইসলামে শত্রুরা আজ পরাজিত। ইসলামের আলোর কাছে তারা লজ্জায় অবনত। মহান আল্লাহ এতদিন পর মুসলমানদের মনে শান্তি এনে দিয়েছেন। যে নবীজী (সা)-কে তারা ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, জীবনের চেয়েও বেশি আপন মনে করে, তিনি একদিন মক্কা থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। আজ তিনি আবার আপন ঘরে ফিরে আসছেন। তাই তাদের খুশির সীমা-পরিসীমা নেই।
অথচ অন্যদিকে চলছে ভিন্ন এক চিত্র। একদল কাফেরের মনে দারুণ শঙ্কা। মুসলমানদের খুশির আমেজ দেখে তারা ভীতসন্ত্রস্ত। তাদের মধ্যে বিরাজ করেছে জীবন ও ইজ্জতের শঙ্কা। একটা চাপা আর্তনাদ যেন কান পাতলেই মক্কার বাতাসে শোনা যাচ্ছে। কাফেররা খুবই বিষণ্ন, মর্মাহত। সূর্যের আলো যত বাড়ে, দিন যত এগোয়, তাদের শঙ্কাও যেন ততটাই বেড়ে চলে। ঐ বুঝি এলো শত্রুর দল। এক্ষুণি ওরা তাদের গর্দান কাটবে। লুটে নেবে ইজ্জত-আবরু, ধন-সম্পদ সব। এই ভীত ও কম্পমান মানুষগুলোর মধ্যে যেন মহাত্রাস। তাই তারা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে। আশ্রয় নিচ্ছে পাহাড়ের আড়ালে, অথবা কোনো গুহায় বা জঙ্গলে। যদি কোনমতে জীবন বাঁচানো যায়-এটাই এখন তাদের চিন্তা।
ইতোমধ্যে সকালের সূর্য অনেক দূর উপরে উঠে আসে। তপ্ত বালুতে তখন আগুনের ফুলকি দেখা যাচ্ছে। সেই আগুন মাড়িয়ে দ্রুত পালিয়ে ছুটে ভীত-সন্ত্রস্ত হাজারো মানুষ। ছোট-বড় সবাই। দলে দলে ছুটছে লোকগুলো। কাঁধে কাঁধে তাদের মালের বোঝা, মেয়েদের কোলে কোলে অবুঝ শিশু। হাঁপাতে হাঁপাতে, কাঁদতে কাঁদতে ওরা পালাচ্ছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ভয়ে ভয়ে দৌড়াচ্ছে, কিন্তু ওরা পারছে না। তাই হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ছে, আবার দৌড়াচ্ছে। সে কী এক করুণ দৃশ্য!
মক্কার এই মানুষগুলো পথ চলছে আর ভাবছে আজ বুঝি আর রক্ষা নেই। এই মক্কা থেকেই তো তাড়িয়ে ছিলাম মুহাম্মদ (সা)-কে। আজ সে আসছে হাজার হাজার সেনা নিয়ে। আজ আমাদের ধরে ধরে কাটবে, প্রতিশোধ নেবে। ওরা দেখল হাজার হাজার মুসলমান এগিয়ে আসছে। আত্মগোপন করা অবিশ্বাসীরা দেখল মরুর ধুলা উড়িয়ে তীরবেগে মুসলমানরা প্রবেশ করছে মক্কায়। তাদের কোমরে বাঁধা ধারালো তলোয়ার। কোনো বাধা ছাড়াই শত্রুরা মক্কায় ঢুকে পড়ল। আজ বাধা দেয়ার মতো কেউ যেন উপস্থিত নেই।
এমন সময় দেখা গেল নির্জন মরুতে পড়ে আছে এক বুড়ি। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে কাঁদছে। তার পাশে একটা বড় বোঁচকা। ক্লান্ত-শ্রান্ত সেই বুড়ি। গায়ে শক্তি নেই। তবু ভয়ে পালাচ্ছিল। কিন্তু সে আর এগুতে পারছিল না। নিরুপায় হয়ে বুড়ি কাঁদছিল। বুড়ির এই করুণ দশা দেখে একজন শক্ত সামর্থ্য লোক তার পাশে এসে দাঁড়াল।
লোকটা বুড়িকে জিজ্ঞেস করল, কেন কাঁদছো বুড়ি মা? কী হয়েছে তোমার? আমি কি তোমাকে সাহায্য করতে পারি? লোকটার কথা শুনে বুড়ি চোখ তুলে তাকাল। লোকটাকে তার কাছে অপরিচিত মনে হলো। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে লোকটাকে বুড়ি জিজ্ঞেস করল, তুমি কি মুসলমান?
লোকটা বলল, হ্যাঁ আমি মুসলমান। একথা শোনা মাত্রই বুড়ি ভয়ে কেঁপে উঠল। এরা যে তার জানের দুশমন। তাই বুড়ি আর কিছুই বলল না। চুপ করে রইল। লোকটা এবার বলল, মা, তুমি বড়ই ক্লান্ত। তুমি কোথায় যাবে? চল, আমি তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি। বুড়ির খুবই ভয় পাচ্ছিল। লোকটাকে সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তারপরও কাঁপা কণ্ঠে সে বলল, তা হলে বাবা-এ বোঁচকাটা পাহাড়ের ওপারে পৌঁছে দাও। লোকটা বোঁচকা কাঁধে তুলে নিলো। আর এক হাতে বুড়ির হাত ধরে তাকে এগিয়ে নিয়ে চলল। লোকটা বুড়ির সাথে গল্প করতে করতে পথ চলছিল। বুড়িও তার দুঃখের কথা খুলে বলল লোকটাকে। বুড়ি এক সময় বলল, জানো বাবা-আমারও একটা ছেলে ছিল, দেখতে ঠিক তোমারই মতো। সে আজ বেঁচে নেই। একথা বলেই ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠল বুড়ি।
লোকটা সস্নেহে বলে ওঠে, মা আমি আছি না, আমি তোমারই ছেলে। এ কথাটুকু শুনে বুড়ির চোখে আর পানি ধরে না। চোখ ভেঙে ঝর ঝর করে পানি গড়িয়ে পড়ে তার বুক ভেসে গেল। লোকটা বুড়ির চোখ মুছে দিল। এমন সময় বুড়ি হঠাৎ লোকটার হাত চেপে ধরে, আর বলে, বাবা ! আজ তুমি আমার সাথেই থাকো, নইলে মুসলমানরা আমাকে মেরে ফেলবে। বুড়ির চোখ মুছতে মুছতে লোকটা বলল, ভয় পেয়ো না মা। ওরা তোমাকে মারবে কেন? ঐ তো মুসলমানরা এখান দিয়েই চলে গেল। কই, তোমাকে তো কিছুই বলল না।
বুড়ি বলল, ওরা কিছুই বলবে না। অথচ সেই যে মুহাম্মদ নামে লোকটা, সে দেখতে পেলেই আমাকে খুন করে ফেলবে। জানো, সে তো বড়ই ভয়ানক মানুষ। সে পাষাণ, নিষ্ঠুর। ওর হাত থেকে বাঁচার উপায় নেই।
বুড়ির এসব কথা নবীজী (সা)-এর মনে তীরের মতো বিঁধল। দয়াল নবী (সা) বুুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ। তারপর বুড়ির হাত দু’টি জড়িয়ে ধরে বললেন, মা, আমিই সেই হতভাগা। আমিই মুহাম্মদ। আমার ভয়ে যদি তোমার এতই কষ্ট হয়, তা হলে কী শাস্তি দেবে আমাকে দাও। আমি তা মাথা পেতে নেবো।
বুড়ি মহানবী (সা)-এর পরিচয় জেনে হতচকিত হয়ে গেল। আর কোনো কথাই বেরুল না তার মুখ থেকে। বুড়ি অনেকক্ষণ মুহাম্মদ (সা)-এর সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। কিছুক্ষণ পর বুড়ির দুই চোখ বেয়ে নেমে এলো অঝোরধারায় অশ্রু। সে ভাবছে, এমন সুন্দর মানুষ মুহাম্মদ (সা)! কতই না ভালো এই মানুষটি! কতই না মহৎ তাঁর মন। বুড়ি ভাবতে ভাবতে আর স্থির থাকতে পারল না। এবার সে মুখ খুলল। এতদিন মুহাম্মদ (সা) সম্পর্কে তার খারাপ ধারণার জন্য সে নবীজি (সা)-এর কাছে ক্ষমা চাইল। এবার বুড়ি নবীজি (সা)-কে বলল, ‘আমাকে কালেমা পড়িয়ে দিন, আমি মুসলমান হবো।’
বুড়ি কালেমা পড়ে নিলো। সে মুসলমান হলো। এবার নবীজি (সা) বুড়ির কাছ থেকে বিদায় নিতে চাইলেন। কিন্তু এত বড় মনের মানুষটিকে ছেড়ে দিতে বুড়ির মন চাইল না। তবুও তাকে যেতে দিতে হলো। এ সময় তার মনটা আরেকবার কেঁদে উঠল। বুড়ি প্রাণভরে নবীজি (সা)-এর জন্য দুআ করল। তখনও সে ডুকরে ডুকরে কাঁদছিল।