মিজানুর রহমান
জাহিদের বাড়ি ছিল নদীর ধারে, ছোট্ট এক গ্রামে। চারদিকে সবুজ ধানক্ষেত, মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে নীল রঙের ছোট্ট নদী। এই নদী ছিল জাহিদের ছেলেবেলার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। স্কুল শেষে প্রতিদিন বই ব্যাগ রেখে দৌড়ে চলে যেত নদীর পাড়ে।
একদিন স্কুল থেকে ফিরে জাহিদ দেখলো, নদীর ধারে একটা ছোট্ট মাছরাঙা পাখি বসে আছে। তার শরীর ঝলমলে নীল-সবুজ রঙে চকচক করছে, আর লম্বা ঠোঁট দিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করছে। জাহিদ মুগ্ধ হয়ে পাখিটিকে দেখতে লাগল। সেইদিন থেকেই তাদের অদ্ভুত এক বন্ধুত্বের শুরু।
প্রতিদিন বিকেলে জাহিদ নদীর ধারে যেত, আর মাছরাঙা পাখিটিও সেখানে থাকত। জাহিদ চুপচাপ দূরে বসে থাকত, আর মাছরাঙাটি তার কাজ চালিয়ে যেত, পানিতে ঝাঁপ দিত, মাছ ধরত, আবার কোনোদিন শাখার উপর বসে বিশ্রাম নিত। জাহিদ কখনোই পাখিটিকে ভয় দেখাত না, তাই পাখিটিও ওর উপস্থিতিতে নির্ভয়ে থাকত।
একদিন হঠাৎ আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল। বিকেলেই অন্ধকার নেমে এলো। বাতাসের ঝাপটা শুরু হলো। জাহিদ দৌড়ে নদীর ধারে গিয়ে দেখলো, মাছরাঙা পাখিটি কাঁপছে। কোথাও আশ্রয় পাচ্ছে না। জাহিদ তার ছোট্ট গামছাটা খুলে এগিয়ে দিল। পাখিটি যেন বুঝে গেল, এ হাত নিরাপদ। সে জাহিদের হাতে উঠে এল। জাহিদ পাখিটিকে বুকে আগলে নিয়ে দৌড়ে ঘরে ফিরল।
সেই দিন রাতে জাহিদের কাছে পাখিটি ছিল। সে একটা ছোট বাক্সে তুলো বিছিয়ে দিল পাখির জন্য। এক পাশে কিছু ভিজে চাল রাখল। রাতে জাহিদ বারবার উঠে পাখিটার দিকে তাকিয়ে দেখত, ঠিক আছে তো?
ভোর হতেই বৃষ্টি থামল। আকাশে রোদের ঝিলিক দেখা দিল। জাহিদ ছোট্ট পাখিটিকে নিয়ে নদীর ধারে গেল। পাখিটি একবার ডানা ঝাপটালো, তারপর নদীর উপর উড়ে গেল। জাহিদের মনে হলো, ও যেন তাকিয়ে মিষ্টি করে একটা ধন্যবাদ দিল।
এরপর থেকে, মাছরাঙা পাখিটি আরও আপন হয়ে উঠলো। কখনো জাহিদ নদীর ধারে গেলে পাখিটি কাছে উড়ে আসত, তার চারপাশে চক্কর দিত। কখনো জাহিদের কাঁধে বসে থাকত, কখনো আবার জলের উপর মাছের খোঁজ করত। পাড়ার লোকেরা অবাক হয়ে বলত, “জাহিদ আর মাছরাঙা যেন দুটো ভাই!”
দিন চলছিল দারুণ আনন্দে। কিন্তু সুখের দিন বেশিদিন স্থায়ী হলো না। একদিন গ্রামে খবর এল, বড় একটি প্রকল্পের জন্য নদীর এই অংশ ভরাট করা হবে। বড় বড় ট্রাক এসে মাটি ফেলবে, নদীর গতিপথ বদলে দেবে। গ্রামের অনেকে খুশি, উন্নতির কথা ভেবে। কিন্তু জাহিদের মন ভেঙে গেল।
“আমার মাছরাঙা বন্ধুরা কোথায় যাবে?” জাহিদ চিন্তায় পড়ে গেল। সে চুপচাপ নদীর ধারে বসে, মাছরাঙাটির অপেক্ষা করতে লাগল। পাখিটিও এলো। জাহিদ পাখিটিকে দেখে চোখের পানি লুকাতে পারল না। সে ফিসফিস করে বলল,
“তোমাকে হয়তো চলে যেতে হবে... এই নদী আর থাকবে না।”
পাখিটি মাথা একপাশে হেলিয়ে চেয়ে থাকল। যেন বোঝার চেষ্টা করছে, কী যেন হারিয়ে যেতে চলেছে। জাহিদ জানতো, এই পাখি শহরের কংক্রিটের ভিড়ে বাঁচতে পারবে না। নদী, গাছ, শান্ত পরিবেশ এগুলোই তার জীবন।
কয়েকদিন পর কাজ শুরু হলো। বড় বড় মেশিন এসে নদীর পাড় কেটে মাটি ফেলতে লাগল। জাহিদ ছুটে এসে দেখলো তার ছোট্ট নদী আর নীল পানির ধারা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আর কোথাও দেখা মিললো না সেই প্রিয় মাছরাঙার। দিন যায়, মাস যায়। নদীর জায়গায় উঠে এল নতুন রাস্তা। চারপাশে দোকান, বাড়ি, যানবাহন। কিন্তু জাহিদের চোখে তার নদীর ছবি আঁকা থাকল চিরদিনের জন্য।
একদিন হঠাৎ স্কুল থেকে ফেরার পথে, একটি নতুন ছোট্ট জলাশয়ে জাহিদ দেখলো চেনা রঙের ঝলক। হ্যাঁ! একটি মাছরাঙা পাখি! সে জানে না, এটি তার সেই পুরনো বন্ধু কিনা, তবে মন বলে পাখিটিও হয়তো খুঁজেছে জাহিদকে ঠিক যেমন জাহিদ খুঁজেছে তাকে।
জাহিদ সিদ্ধান্ত নিল, বড় হলে সে প্রকৃতি রক্ষার জন্য কাজ করবে। যেন আর কোনো জাহিদ তার প্রিয় নদী, প্রিয় পাখি হারাতে না বাধ্য হয়।
আর সেই দিন থেকে জাহিদের মনে এক নতুন স্বপ্নের জন্ম হলো নদী, পাখি, গাছপালা আর শিশিরভেজা সকালে ভরা এক সুন্দর পৃথিবী গড়ার।