বিচিত্র কুমার

গভীর জঙ্গলের মাঝে ছিল এক বিস্তীর্ণ রাজ্য, যার শাসক ছিলেন সিংহরাজ। তার গর্বের প্রতীক ছিল একটি সোনার মুকুট, যা তিনি সর্বদা মাথায় পরতেন। এই মুকুট শুধু রাজমর্যাদার প্রতীকই ছিল না, তার ক্ষমতার অহংকারও বয়ে নিয়ে যেত। সিংহরাজ মনে করতেন, এই মুকুটই তার শক্তির প্রমাণ, আর শক্তিই রাজ্য শাসনের একমাত্র উপায়।

প্রতিদিন রাজসভায় তিনি গম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করতেন, “আমি সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে জ্ঞানী! এই মুকুটই তার প্রমাণ!” সভাসদরা করতালিতে মুখর হয়ে উঠত, কেউ কখনো তার কথার বিরোধিতা করার সাহস করত না।

কিন্তু একদিন এক বৃদ্ধ কাছিম সভায় উপস্থিত হয়ে বলল, “মহারাজ, শুধু শক্তি দিয়ে রাজ্য শাসন করা যায় না। প্রকৃত রাজা হন সেই, যিনি ন্যায়বিচার করেন, প্রজাদের ভালোবাসা অর্জন করেন।”

সিংহরাজ হেসে বললেন, “তুমি বৃদ্ধ, দুর্বল। দুর্বলদের কথা শোনার প্রয়োজন নেই। শক্তিই এই পৃথিবীর একমাত্র সত্য।” কাছিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেল। কিন্তু প্রকৃতি যেন সিংহরাজকে নতুন এক শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

রাত গভীর হলে রাজপ্রাসাদের পাহারায় থাকা সিংহসৈন্যরা টের পেল, কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটছে। সকালে উঠে সবাই অবাক হয়ে দেখল, সিংহরাজের মুকুট উধাও! গভীর রাতে একদল চতুর শেয়াল রাজপ্রাসাদে ঢুকে সেটি চুরি করে নিয়ে গেছে!

রাজসভায় তোলপাড় শুরু হলো। সিংহরাজ ক্রোধান্বিত হয়ে গর্জে উঠলেন, “আমার মুকুট ছাড়া কি আমি রাজা নই? যে করেই হোক, আমার মুকুট ফিরে আনতে হবে!” সৈন্যদের আদেশ দেওয়া হলো, তারা জঙ্গলের পথে পথে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল।

একদিন, দু’দিন, তিনদিন, কেউ মুকুটের সন্ধান পেল না। রাজ্য জুড়ে কানাঘুষা শুরু হলো, “মুকুট হারিয়ে রাজা কি দুর্বল হয়ে পড়লেন?” সিংহরাজ ব্যথিত হলেন। তিনি ভাবতে লাগলেন, যদি শুধু মুকুটই রাজত্বের মূল শক্তি হয়, তবে সেটি হারিয়ে গেলে তার অবস্থান কি শূন্য হয়ে যাবে?

ঠিক তখনই এক বুদ্ধিমান পেঁচা উড়ে এসে বলল, “মহারাজ, প্রকৃত রাজা হন সেই, যিনি শুধু শক্তি দিয়ে নয়, ভালোবাসা, জ্ঞান ও ন্যায়ের মাধ্যমে রাজ্য শাসন করেন। যদি প্রজারা আপনাকে হৃদয় থেকে ভালোবাসে, তবে আপনার মাথায় মুকুট থাকুক বা না থাকুক, আপনি সবসময় রাজা থাকবেন।”

সিংহরাজ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। এতদিন তিনি শুধু আদেশ দিয়ে গেছেন, কিন্তু কখনো প্রজাদের কথা শোনেননি, তাদের সমস্যার সমাধান করেননি। তিনি অনুভব করলেন, শুধু ভয় দেখিয়ে রাজত্ব দীর্ঘস্থায়ী করা যায় না। এবার তিনি বদলানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।

তিনি রাজ্যের সব প্রাণীর খোঁজ নিতে শুরু করলেন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করলেন, দুর্বলদের রক্ষা করলেন। ধীরে ধীরে তার প্রতি প্রজাদের ভালোবাসা বাড়তে লাগল। রাজ্যের প্রাণীরা তার ন্যায়ের প্রশংসা করতে লাগল, আর আগের মতো তাকে ভয় পেতে থাকল না, বরং শ্রদ্ধা করতে লাগল।

একদিন, একদল শেয়াল রাজদরবারে এসে বিনয়ের সাথে বলল, “মহারাজ, আমরা ভুল করেছি। আমরা ভাবতাম, মুকুট ছাড়া আপনি রাজা নন। কিন্তু এখন বুঝেছি, আপনার ন্যায়বিচারই আপনাকে সত্যিকারের রাজা বানিয়েছে। এই নিন, আপনার সোনার মুকুট ফিরিয়ে দিচ্ছি।”

সিংহরাজ মুকুট হাতে নিলেন, কিন্তু তা মাথায় পরলেন না। তিনি হাসিমুখে বললেন, “সত্যিকারের রাজা মুকুট দিয়ে নয়, গুণ ও ন্য য়ের মাধ্যমে চেনা যায়”।