হেলাল আরিফীন

নিজেই একটা রোবট বানিয়ে ফেলার খুব শখ সুমনের । পত্রিকার পাতা খুললেই আজকাল অনেক ধরনের রোবটের খবর পাওয়া যায় । এইতো কিছুদিন আগে সোফিয়া নামের রোবটটি সারা বিশ্বেই বেশ হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল । টিভিতে সোফিয়ার সাক্ষাৎকার দেখে রোবট তৈরির ইচ্ছেটা ওকে আরও পেয়ে বসল । কিন্তু যে কারোর রোবট তৈরি করার ইচ্ছে থাকলেই তো হবে না, তার জন্য জানা থাকা চাই রোবটিক বিদ্যা। আবার রোবট বিষয়ে শুধু পড়াশুনো থাকলেই চলবে না, সংগ্রহে রাখতে হবে রোবটের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ।

সুমন রোবট তৈরির অদম্য ইচ্ছেটাকে বাস্তবে রূপ দিতে এই বিষয়ে কিছুদিন খেটেখুটে বেশ পড়াশুনা করল । তারপর একদিন বাবার সাথে ঢাকায় গিয়ে রোবটের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ কিনে আনল। আর সেদিনের পর থেকেই ওর রোবট তৈরির বিশেষ প্রোজেক্ট শুরু হল ।

সুমন পড়ালেখা করার ফাঁকে ফাঁকে ওর নিজের ল্যাব্রেটরিতে বসতে শুরু করল। রোবট তৈরির এই কাজে প্রথমে খুব বেগ পেতে হল ওকে। কারণ কল্পনা ও বাস্তবতা এক জিনিস নয়। মাদারবোর্ডে বিভিন্ন সার্কিটগুলো জুড়ে দিতেই ওর বেশ কিছুদিন সময় লাগল। প্রয়োজনীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গসমূহ সংযুক্ত করে দেহের অভ্যন্তরে ডিসি, স্টিপার ও সার্ভো মোটরস বসানো হল যাতে রোবটটি তার প্রয়োজন অনুসারে চোখ, মাথা ও হাতপা নাড়াতে পারে। অনুভূতি বোঝার জন্য সেন্সর লাগান হল। রোবটটিকে পরিচালনা করার জন্য একটি একটি প্রসেসরের দরকার। মানুষের মস্তিষ্কের মতো এটাই রোবটের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ। এটিই রোবটের প্রধান নিয়ন্ত্রক সিস্টেম। এখানকার প্রোগ্রাম অনুযায়ীই রোবটটি পরিচালিত হবে। রোবট তৈরির এই অংশের কাজ বেশ জটিল। তাই এই অংশের কাজ করতে ওর প্রায় এক মাস সময় লেগে গেল। রোবটটিকে কাজ করানোর জন্য বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজন। লেড এসিড ব্যাটারিতে রোবটটির পাওয়ার সিস্টেম চালু করা হলে রোবটটি তার কার্যক্রম শুরু করল। রোবটটি যখন তার ইরিডিয়ামের চোখের মণি পিটপিট করে সুমনের দিকে তাকিয়ে যান্ত্রিক গলায় প্রথম ওকে অভিবাদন জানাল তখন ও খুব খুশি হল। ও রোবটটির নাম রেখেছে রাফি। রাফি ওর বন্ধু। সড়ক দুর্ঘটনায় কিছুদিন আগে মারা গিয়েছে। রাফি ওর খুব ভলো বন্ধু ছিল এবং রাফিরও ইচ্ছে ছিল ওরা দুই বন্ধু মিলে একটি রোবট বানিয়ে ফেলবে। আজ বন্ধুটি বেঁচে নেই, বন্ধুর নামটি স্মরণীয় করে রাখার জন্যই রোবটটির নাম রাখা হল রাফি। রোবট তৈরিতে সুমনের ইতোপূর্বে কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও প্রথম চেষ্টাতেই ভালো করেছে সুমন। রোবটটি পরিবারের সদস্যদের জন্য ছোটখাটো কাজ করে দিতে পারবে, সবার সাথে গল্প করতে পারবে এবং কোন বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তারও উত্তর দিতে পারবে। পরীক্ষামুলকভাবে কয়েকদিন রোবটটিকে চালানোর পর একদিন ও বাবা মাকে গিয়ে খুশির খবরটা দিল। ওর বাবা মিজানুর রহমান একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। মা শায়লা বেগম একজন গৃহিণী। খবরটা শুনে মিজানুর রহমান খুশি হয়ে বলল, বাঃ, শেষ পর্যন্ত তৈরি করে ফেলেছ। আমি জানতাম তুমি পারবে। চেষ্টা ও অধ্যবসায় থাকলে যেকোন কঠিন কাজই করে ফেলা যায়। শায়লা বেগম পাশেই ঘর গোছানোর টুকিটাকি কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তিনিও হাতের কাজ রেখে খুশি গলায় বললেন, এত তাড়াতাড়ি রোবটটি তৈরি করে ফেলেছিস বাবা! আমাদেরকে দেখাবি না?

সুমন হাসি মুখে বলল, তোমাদেরকে দেখাতেই তো ডাকতে এসেছি। এসো তাড়াতাড়ি আমার রোবট রাফিকে দেখবে। মিজানুর রহমান হেসে বললেন, বাঃ, খুব সুন্দর নাম তো । নামটা তো বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে ।

সুমন বলল, পরিচিত মনে হচ্ছে কি বাবা, রাফি নামটা যে আমার বন্ধুর নাম তা এত তাড়াতাড়ি তুমি ভুলে গেলে?

মিজানুর রহমান গম্ভির গলায় বললেন, ও, ভেরি স্যাড, তোমার যে বন্ধুটা রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে সেই বন্ধুটার নাম রাফি? হ্যাঁ বাবা। মিজানুর রহমান ও শায়লা বেগম সুমনের রোবটটির সামনে এসে দাঁড়াতেই রোবটটি যান্ত্রিক ভারি স্বরে বলল, গুড আফটারনুন। মিজানুর রহমান বিস্মিত হয়ে বললেন, গুড আফটারনুন! হাউ আর ইউ?

রোবট রাফি তার চৌকো চোয়াল নাড়িয়ে বলল, আই অ্যাম ফাইন। থ্যাঙ্ক ইউ এভরিবডি। সুমন মিজানুর রমানের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা, তুমি আমার রোবটটিকে একটা প্রশ্ন কর। মিজানুর রহমান বললেন, কী ধরনের প্রশ্ন করব? সুমন বলল, যে কোন ধরনের প্রশ্ন? রাফি তোমার কণ্ঠস্বরে উত্তর দিতে পারবে। মিজানুর রহমান বিস্মিত হয়ে বললেন, হুবহু আমার গলার আওয়াজে উত্তর দিতে পারবে ?

সুমন আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, হ্যাঁ বাবা, তুমি একটা প্রশ্ন করেই দেখ না ? শায়লা বেগম বললেন, শুধু তোর বাবার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে, আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না ? সুমন বলল, অবশ্যই পারবে। তুমিই প্রথম ওকে একটা প্রশ্ন কর মা? শায়লা বেগমের প্রশ্ন করার আগেই সুমন রোবটটিকে ভয়েস সিন্থেসাইজার অন করার জন্য কমান্ড করল। শায়লা বেগম রোবটটির উদ্দেশে বললেন, রোবট বাবাজি, বল তো তুমি আমাদের বাসায় কীভাবে এলে?

শায়লার প্রশ্ন করার ধরন দেখে মিজানুর রহমানও সুমন হেসে ফেলল। রোবটটি ভয়েস সিন্থেসাইজারে শায়লা বেগমের গলায় বলল, আমি কোথাও থেকে আসিনি। আমাকে তৈরি করা হয়েছে। আই অ্যাম মেইড বাই মিস্টার সবুজ আহমেদ। শায়লা বেগম হেসে বললেন, এখানে থাকতে তোমার কেমন লাগছে?

রোবট রাফি বলল, ভাল লাগা মন্দ লাগা সম্পূর্ণ মানবিক ব্যাপার। আমার সেন্সরে এখনও এই ধরনের কোন অনুভূতি দেয়া হয়নি। মিজানুর রহমান বললেন, তার মানে তুমি হিউম্যানয়েড রোবট নও?

রোবট রাফি এবার মিজানুর রহমানের গলায় বলল, আমি হিউম্যানয়েড রোবট নই। তবে আমার সেন্সরে মানবিক গুরুত্বপূর্ণ কিছু অনুভূতি সংযোজিত হলে আমি হিউম্যানয়েড রোবট হয়ে উঠতে পারব।

সবুজদের বাসা মফস্বল শহরে। তবু সবুজের রোবট তৈরির ঘটনাটি এলাকায় বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করল। প্রতিদিন এলাকার অসংখ্য মানুষ ওদের বাড়িতে ভিড় জমাতে শুরু করল। সবুজ ও রোবট রাফির সাক্ষাৎকার নিতে টিভি চ্যানেলগুলো আসতে শুরু করল। বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ওকে বেশ ঘটা করে সংবর্ধনা দেয়া হল।

আজ সবুজের জন্মদিন। জন্মদিন উপলক্ষে আমন্ত্রিত অতিথিরা ওকে ঘিরে বসে রয়েছে। ওর পাশেই বডি গার্ডের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে রোবট রাফি। সবুজের জন্মদিন উপলক্ষে সবাই এলেও সবারই উৎসুক দৃষ্টি রোবটটির দিকে। সবাই রোবটটির সাথে এটাসেটা বলে আনন্দে মেতে রয়েছে। পেছন থেকে রাফির মা এসে রোবটটির দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, বাঃ, অনেক সুন্দর একটা রোবট বানিয়ে ফেলেছ তো তুমি বাবা। আহারে আমার রাফি যদি আজ বেঁচে থাকত তাহলে খুব খুশি হত।

রোবট রাফি ভয়েস সিন্থেসাইজারে রাফির কণ্ঠস্বরে বলল, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। বলুন, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি? সুমন একটি অডিও ক্লিপ থেকে ওর বন্ধু রাফির কণ্ঠস্বর রোবটটির ভয়েস সিন্থেসাইজারে অ্যাড করে দিয়েছিল। রাফির মা রোবটটির কথায় নিজের মৃত সন্তানের কণ্ঠস্বর শুনে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লেন । তিনি মায়াময় চোখে রোবটটির দিকে তাকিয়ে রইলেন ।