আসাদ সরকার
গ্রীষ্মের খা খা রৌদ্র। আমি অফিস থেকে বাসায় যাব দুপুরে খাবার খেতে। বাসা থেকে অফিসের দূরত্ব প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। আমি যে রাস্তায় চলাচল করি সেটা মোটামুটি ব্যস্ত একটি রাস্তা। কিন্তু রাস্তার আশেপাশে তেমন বাড়িঘর নেই। বেশ কিছু জমিতে ফল্ট তৈরি হচ্ছে। কিন্তু তেমন বাড়িঘর নেই। মাঝখানে কিছু বাড়ি ঘর হয়েছে। রাস্তার পাশে একটি মসজিদ, তারই পাশে ছোট একতলা দুতলা দালান। নামাজের সময় হয়ে গেছে। আমি নামাজে যাব এই মহূর্তে সামনে দেখি একটি বিড়ালের ছানা। মিউ মিউ করে কাঁদছে। দেখে আমার অনেক মায়া লাগল! ঠিক রাস্তার মাঝখানে বসে আছে। প্রথমে মনে করছিলাম ভূত হতে পারে। কারণ মায়ের কাছে শুনেছি ঠিক দুপুরে বিড়াল অথবা কাকের বেশ ধরে অনেক সময় ভূত বসে থাকে। প্রথমে মনে সন্দেহ হলেও পরে আবার সন্দেহ কেটে যায়।
হঠাৎ দেখি সামনে থেকে একটি বাইক আসছে। আমি বিড়াল ছানার সামনে দাঁড়ালাম। লোকটি বাইক নিয়ে সাইড কেটে চলে গেলেন। আমি বিড়াল ছানাটিকে রাস্তার পাশে রেখে দিই। মসজিদে যেতে না যেতে আবার সে মাঝ পথে এসে বসে পড়লো। হঠাৎ দেখি সামনে থেকে একটি রিক্সার আসতেছে। আমি জোরে চিৎকার করে রিক্সাটা থামাই। শেষবারের মতো ছানাটি প্রাণে বেঁচে যায়। কিন্তু ছানাটি প্রচুর কান্না করছিল। এত মিউ মিউ করতেছে যে আমার মনে হল সে খাবারের জন্য কান্না করতেছে। আশেপাশে কোন দোকান আছে কিনা খুঁজতে থাকি। অনেক খোঁজার পরে একটি দোকানের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেটিও আবার বন্ধ। হঠাৎ দেখি একটি বালক বিড়াল ছানাটিকে দেখে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার বয়স আনুমানিক প্রায় ১০-১১ হবে।
আঙ্কেল আঙ্কেল বিড়াল ছানাটি আপনার?
তখন আমি সুযোগ বুঝে জিজ্ঞাসা করলাম
কি নাম তোমার বাবা?
মোঃ রিফাত হোসেন?
তোমাদের বাসা কোথায়?
সামনের গলিতে।
তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
মসজিদে নামাজ পড়তে। আঙ্কেল আঙ্কেল বিড়াল ছানাটি কি আপনার? না বাবা।
তাহলে আপনি এই ছানার জন্য এতক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে রইলেন। ছানাটিকে বাঁচাতে জোরে চিৎকার করতে লাগলেন।
ছেলেটি মনে হয় আমাকে অনেক সময় ধরে ফলো করছে। আপনি বিড়ালকে খুব ভালোবাসেন তাই না?
না তেমন না, কিন্তু একটি প্রাণ চোখের সামনে মারা যাবে এটা কি হয়?
তোমার বাবা মা আছে? জ্বি আঙ্কেল আমার বাবা মা আছে, কিন্তু বিড়াল ছানাটির তো বাবা নেই। সে তারা বাবা মা কে হারিয়ে ফেলেছে। হয়তো দুই তিন দিন ধরে কিছুই খেতে পায়নি। তাই কান্না করতেছে।
তাহলে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
ছেলেটি বুঝতে চাচ্ছে না। তারপর আমি বললাম ধরো তুমি বাবার সাথে অনেক দূরে ঘুরতে গেছ। হঠাৎ তোমার বাবা তোমাকে হারিয়ে ফেলল। তখন তুমি কি করবে? হয়তো তুমিও বিড়াল ছানার মতো রাস্তার মাঝখানে বসে বসে কাঁদতে থাকবে। তখন আমি কি করবো বলতো। আমি তোমাকে ফেলে চলে আসতে পারতাম, না অবশ্যই তোমার খিদে লাগলে খাবার কিনে দিতাম? তোমার বাবাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করতাম। রিফাত একটু চুপ থেকে বললো, আঙ্কেল আপনি একটু দাঁড়ান আমি বাসা থেকে আসতেছি। রিফাত দৌড়ে বাড়ির ভেতর চলে গেল। দুই মিনিট পরে হাফ পেলেট ভাত নিয়ে আসলো। আঙ্কেল আঙ্কেল বিড়াল ছানার জন্য আমি ভাত এনেছি। ওকে খেতে দেন।
আমি রাস্তার পাশে নিয়ে ভাত খেতে দিলাম। ভাত দিতে যতক্ষণ দেরি খেতে মনে হয় তত সময় লাগেনি। আমার মনে হলো এক মিনিটে খেয়ে সাবাড় করে দিল। তখন বুঝতে পারলাম। আসলে বিড়াল ছানাটি কতটা ক্ষুধার্ত ছিল। আমার মনে হলো সে দুইদিন যাবৎ খাবার পায়নি তাই এত চিৎকার চেঁচামেচি। তাই তো কবি বলেছেন “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়”। আমি তাকে আদর করলে কি হবে। তার পেটে তো ক্ষুধা। তার মিউ মিউ বন্ধ হয়নি। কবি আরও বলেন পেটে যদি থাকে ক্ষুধা কি হবে গায়ে চন্দ মেখে, সুসজ্জিত ফুলের ডালা রেখে, আমাকে দাও পেট ভরে খেতে।
ছেলেটি আবার বাড়ি থেকে দৌড়ে গিয়ে তার মা এবং বড় বোনকে আমার কাছে নিয়ে আসে। সে বিড়াল ছানাটি বাড়িতে লালন পালন করবে। আমি যদি দিতে রাজি না হই। সেজন্য তার মা এবং বোনকে নিয়ে আসে। আমি মনে মনে চিন্তা করি বাসায় নিয়ে আসবো। আমার কাছ থেকে এক প্রকার জোর করে বিড়াল ছানাটি ওরা নিয়ে গেল। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু আমার ছেলেটির প্রতি একটু বিশ্বাস জন্ম নিল। হয় তো খুব ভালো করে ছানা পুষবে। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অফিসে চলে আসলাম। আজকে আর বাসায় যাওয়া হল না। অফিস শেষে বাসায় এসেও বারবার ছানাটির কথা মনে পড়ছে।
সপ্তাহ বাদে আবার ইচ্ছে করে এই মসজিদে নামাজ পড়তে গেলাম। নামাজ শেষ করে দেখি রিফাত নামের ছেলেটি আমার জন্য অপেক্ষা করতেছে। আমি বের হওয়ার সাথে সাথে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো আঙ্কেল কেমন আছেন।
আলহামদুলিল্লাহ! তুমি কেমন আছো?
আলহামদুলিল্লাহ! বিড়াল ছানার কি খবর?
আঙ্কেল বিড়াল ছানা নয়, ওর নাম রেখেছি মিঠু। সে আমার প্রিয় বন্ধু। বাসার সবার সাথে খেলাধুলা করে। রাতে আমার সাথে ঘুমায়। আমাদের বাসায় চলেন। আজকে আর একদিন যাবো। আঙ্কেল আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমাকে একটি ভালো বন্ধু উপহার দেওয়ার জন্য। সালাম দিয়ে ছেলেটি চলে গেল।