সজীব তাওহিদ
সাদমান দাঁড়িয়ে আছে আল্লাহর দান হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টের সামনে। কফি শপটার যে ঠিকানা দেয়া হয়েছে তা এখান থেকে কাছেই, দুটো দোকান বাদ দিয়ে পাশের একটি গলির ভেতর। ভদ্রমহিলা গত মাসে একটা এসএমই লোনের জন্য বেশ কয়েকবার এসেছিলেন। সামান্য একটু পুঁজি হলেই উনি ওনার দোকানটা সুন্দর করে সাজিয়ে নিতে পারেন। ম্যানেজার সাহেব সরাসরি না বলেননি আবার দেবেন এরকম সিদ্ধান্তও নিতে পারছেন না। একেতো সুন্দরী বিধবা তার উপরে তার সাথে কোনও নিকটাত্মীয় পুরুষও থাকেন না যিনি দৃঢ়ভাবে ওনার পাশে এসে দাঁড়াবেন। তাছাড়া ব্যাবসাও যে বেশীদিন ধরে করছেন এমনও নয়। বড়জোড় বছরখানেক হতে পারে। যদিও কফি শপটা ভালোই চলে, চা কফির সাথে পেস্ট্রি পিঠাও আছে। এ সমস্ত ব্যাবসা হুটহাট বন্ধ হয়ে যেতে সময় লাগে না, আর তাছাড়া জামানত ছাড়া লোন সবসময়ই বিপদজনক। কোন ম্যানেজারই তাই এই রিস্ক নিতে চায় না। ভদ্রমহিলা রিকোয়েস্ট করলেও এ সমস্ত কারণে প্রস্তাবটা ঝুলিয়ে রেখেছিলেন তিনি।
কিন্তু এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের চাপ আছে। বিসিক-এর সাথে যৌথভাবে কয়েকমাস আগে তারা বেশকিছু নারী উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। এখন তাদেরই স্বল্প সুদে লোন দেয়ার একটা স্কীম চালু করেছে সরকার। হেড অফিস থেকেও তাই এই বিষয়ে বরাদ্দকৃত বাজেটের টাকা দ্রুত কাজে লাগানোর কথা বলা হচ্ছে বারবার। ক্ষুদ্র লোনের বিষয়টা যেহেতু সাদমানই দ্যাখে তাই ওকেই আর একবার আনঅফিসিয়াললি দেখে আসতে বলা হয়েছে। সমস্যাটা হচ্ছে ওর চাকরির বয়স বছর পাঁচেক হলেও এই শহরে ওর নতুন পোস্টিং। অনেককিছুই সেভাবে চিনে উঠতে পারেনি।
যাই হোক দোকানটা সহজেই খুঁজে পাওয়া গেছে। দোকানের নাম উইনস্যাম পেস্ট্রি শপ, প্রোপাইটর নুসরাত জাহান। তার ভাবীর নামও অবশ্য নুসরাত জাহান। শুধু ভাবী কেন! স্কুল কলেজের প্রতি ক্লাসেই সে নুসরাত জাহান, ইসরাত জাহান নামে ক্লাসমেট পেয়েছে। আপাতত তাই নাম বিশ্লেষণে না গিয়ে সে দোকানে ঢুকে এক গ্লাস লাচ্ছির অর্ডার করে। কিন্তু দোকানের কর্মচারী ছেলেটা লাচ্ছি বানাতে পারে না। সে ফ্রিজ থেকে একটা কোল্ডড্রিংকস বের করে দিতে চায়। স্বভাবতই সাদমান বিরক্ত হয়ে দু’একটা কঠিন কথা শুনিয়ে দেয়। তবে ভদ্রলোকদের এই টাইপ কঠিন কথায় কর্মচারী সোহেল রানার খুব একটা ভাবান্তর হয় না। সে আপন মনে মোবাইলে গেমস খেলতে থাকে। সাদমান এই ফাঁকে দোকানের চারদিকে চোখ বোলায় -চারটি টেবিলের মধ্যে একটা খালি, বাকি দু’টেবিলের একটিতে একজোড়া ছেলেমেয়ে বসা। সম্ভবত ছেলেটির জন্মদিন, মেয়েটি কেক কেটে ছেলেটিকে খাইয়ে দিচ্ছে, একটু পর ছেলেটিও মেয়েটিকে খাইয়ে দিচ্ছে।
কর্মচারী ছেলেটাকে গেমস খেলতে দেখে সাদমান বিরক্ত হলেও ওরা মনে হয় খুশিই হয়েছে। অন্য টেবিলে এক মা তার বাচ্চাটকে নুডুলস খেতে দিয়ে নিজেও মোবাইল টিপছে।
মোটামুটি একটা মিশ্র অনুভুতি নিয়েই ওখান থেকে তার চলে আসতে হয়। সাদমান ঠিক করেছে, সে যা দেখেছে তাই-ই বলবে। ম্যানেজারের ইচ্ছা হয় লোন দেবে না হয় দেবে না। আপাতত তার আইএসএস-এর স্টেটমেন্টটা পাঠানো জরুরি। হাতে আর দ’ুদিন মাত্র সময় আছে। শেষ দিনে আবার সার্ভারে চাপ পড়ে, সাবমিট করতে সমস্যা হয়।
ম্যানেজারের চেম্বারে নুসরাত জাহান এবং সাদমান শরীফ পরস্পরকে চিনতে পারলেও কেউই তা প্রকাশ করেন না। বরং ব্যক্তিগত সম্পর্ককে একপাশে সরিয়ে রেখে তারা উভয়ই অফিসিয়ালি পরিচিত হন এবং কুশল বিনিময় করেন। নুসরাত জাহান ওই সময় দোকানে না থাকার জন্য আফসোস প্রকাশ করেন এবং সোহেল রানাকে আরও পরিণত আরও দক্ষ হিসেবে তৈরি করার কথা জানান। এই বাজারে বিশ্বস্ত একটা ছেলে পাওয়া যে কত কঠিন সে বিষয়ে তিনজনই একমত প্রকাশ করেন। নুসরাত জাহানের মনে হয় লোনের ব্যাপারে ম্যানেজার সাহেব আগের চেয়ে অনেক বেশি ইতিবাচক। শুধু সাদমান ছেলেটা ঝামেলা না করলে হয়!
২.
সাদমানকে দেখে নুসরাতের মা রওশন আরা বেগম ভূত দেখার মতোই চমকে ওঠেন। তবে কোন রকম সিনক্রিয়েট না করে সহজভাবেই তাকে বসতে বলে নুসরাতকে ডেকে দেন। নুসরাত বোধ হয় তৈরি-ই ছিল, তারও হয়তো অনেক কথা জমে আছে।
যখন সাদমান আর ওর বড় বোন নুসরাতকে দেখতে আসেন তখন সাদমানকেই অনেকে পাত্র ভেবেছিল। পরে অবশ্য সবাই জানতে পারে সাদমান নয় ওর বড় ভাই আদনানের জন্য ওরা মেয়ে দেখতে এসেছে। যাই-ই হোক আদনান সাদমানের মতো অত সুদর্শন নয়, বলা যায় একটু অড লুকিং-ই । তবু কি হয়েছে পুরুষ মানুষ তো! সাদমানের তখনও পড়াশুনা শেষ হয়নি, অন্যদিকে আদনান সাব রেজিস্ট্রি অফিসে ক্লারিকাল পদে চাকরি করছে। আয় বাণিজ্যও খুব একটা খারাপ না। একে তো ছেলের সরকারি চাকরি তার ওপরে নুসরাতের ছোট দুটো ভাই বোন আছে। নুসরাতের বাবাও যে বড় কোন চাকরি বা ব্যাবসা করেন এমনটাও নয়। বেসরকারী একটা মাদরাসার শিক্ষক তিনি। নুসরাত আর তার ভাই বোনেরা ওই মাদরাসায়ই পড়াশুনা করছে। সুতরাং চেহারা ভালো না হওয়ার অযুহাতে এই পাত্র হাতছাড়া করার কোন মানে হয় না বলেই আত্মীয়স্বজনদের অভিমত। তাছাড়া ছেলে পক্ষ থেকেও কোন দাবিদাওয়া নেই। যেহেতু আদনান দেখতে অতটা ভালো নয়, তার চাহিদাও ছিল সুন্দরী মেয়ে। পরিবার থেকে শুধু যুক্ত হয়েছিল ভদ্র, ঘরোয়া, পর্দানশীন ইত্যাদি, ইত্যাদি। সেই দিক থেকেও নুসরাত একশো তে একশো। ঘরের বড় সন্তান হওয়ায় সংসারের সব কাজ তার বান্ধবীদের থেকে একটু আগেই শিখে ফেলেছিল সে। প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা বাইরেও যাওয়া হতো না তার। অবসরে শেখা সেলাই, পিঠা বানানোর মতো কাজগুলোই তার ব্যবসায় অন্যতম সম্পদ আজ। দোকানের অধিকাংশ পিঠা, কেক তার নিজের হাতেই বানানো। অর্ডার বেশী থাকলে অবশ্য তার মাও হাত লাগায়।
আদনানের সঙ্গে বিয়ের পর নুসরাত মন দিয়েই সংসার শুরু করতে চায়। কিন্তু আদনান দেখতে যতটা খারাপ মুখের ভাষা ছিল তার চেয়েও জঘন্য। ছোটখাট বিষয় নিয়ে তুলকালাম করে ফেলত, তা সে ঘরের লোকই হোক বা রিকশাওয়ালা। না বলে একদিন বাইক নেয়ার জন্য সাদমানকে যেভাবে গালিগালাজ করেছে তা মনে করলে ওর আজও কান গরম হয়ে ওঠে। সাদমান অবশ্য ভাইয়ের সঙ্গে তেমন প্রতিউত্তর করেনি কিন্তু নিজের একটা বাইকের জন্য বাসায় বেশ ঝামেলা শুরু করলো।
যত ছোট ঘটনাই হোক না কেন দিনের পর দিন এই সমস্ত ব্যাপারগুলো নুসরাতের মনোজগতকে অস্থির করে তোলে। যাবতীয় অপ্রাপ্তি, সব বিষয়ে আদনানের সন্দেহ ওদের দাম্পত্যকে ক্রমাগত উত্তপ্ত কড়াইয়ে পরিণত করেছিল। শাশুড়িও কেন জানি নুসরাতকে সহ্য করতে পারতো না, একটু এদিক ওদিক হলেই বলতো রুপের দেমাগ! যাই-ই হোক তারপরও চলছিল কোনরকম, কিন্তু কফিনের শেষ পেরেকটা পড়ে যখন নুসরাতের নামে টাকা চুরির অপবাদটা তোলা হয়, ওই সময় নুসরাতের বাবা ওনার বাড়িটা মেরামতের কাজে হাত দিয়েছিলেন। জমানো টাকার বাইরেও অতিরিক্ত কিছু টাকার দরকার পড়েছিল তখন। তিনি সরল মনেই জামাইয়ের কাছে কিছু টাকা ধার চেয়েছিলেন। আদনানও অবশ্য না করেনি কিন্তু তার আগেই এ টাকা চুরির ঘটনা ঘটলো। সরাসরি না বললেও মা আর ছেলের আচরণে প্রকাশ পেতে থাকলো তারা নুসরাতকেই সন্দেহ করছে। অপবাদটা যে ডাহা মিথ্যা ছিল তা নুসরাত আর সাদমান ভালো করেই জানে। লজ্জায় অপমানে ক’দিন বাদেই নুসরাত বাপের বাড়ি চলে আসে। আদনানের সঙ্গে আর সংসার করবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়।
এমন অবস্থায় আদনানও কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে। যত যাই-ই হোক নুসরাতকে সে ভালোও বাসে। শেষ পর্যন্ত ভালোবাসার জন্য হোক, কিছুটা হলেও ভুল বুঝতে পাড়ার জন্য হোক সে নুসরাতকে ফিরিয়ে আনতে শ্বশুর বাড়ি যায়। আর ওই রাতেই তার বুকে ব্যথা ওঠে। যথারীতি হাসপাতালেও নেয়া হয়। কিন্তু অধিকাংশ ঘটনার মতো হাসপাতালে নেয়ার পথেই সম্ভবত মারা যায় আদনান।
অবধারিতভাবেই এক পরিবার আর এক পরিবারের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ আনে। কথা ছোড়াছুড়ি, কাদা ছোড়াছুড়ির একটা পর্যায়ে দু’পরিবারই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বহুদূর।
আদনানের মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে সাদমান তার শখের বাইকটা কিনে ফেলে। শুধু ওর নিজের জমানো টাকায় সাদমান যে বাইকটা কিনতে পারেনি তা আদনান দুদিন পরেই বুঝতে পারে। অতিরিক্ত আর একটা টিউশনি করিয়ে সাদমানও ঠিক করেছিল ভাইয়ের আলমারিতে টাকাটা রেখে আসবে। কিন্তু যাবতীয় ঘটনার আকষ্মিকতা, তীব্র অপরাধবোধ ওকে হতভম্ব করে ফেলে। ভাবী যখন রাগ করে চলে যায় তখন গাঢ় চোখে কিছুক্ষণ সাদমানের দিকে তাকিয়ে ছিল সে। ওর মনে হচ্ছিল বাইক নিয়ে মাটির নিচে চলে যেতে পারলে সবচেয়ে বেশি ভালো হতো আজ।
৩.
সাদমান লোনের জন্য আবেদনপত্রের একটা ড্রাফট নুসরাতের দিকে এগিয়ে দেয়। বলে, পড়ে দেখো ঠিক আছে কিনা।
তুমি দেখেছো না, তাহলেই হবে।
-আমি দেখেছি ব্যাংকার হিসেবে, তুমি দেখবে গ্রাহক হিসেবে।
-লাগবে না। কোথায় সই করতে হবে দেখিয়ে দাও।
হঠাৎ অদ্ভুত স্বরে সাদমান বলে ওঠে লোনটা কি না নিলেই নয়?
টাকা পাবো কই! এখনই ব্যাবসাটা আর একটু বড় করা দরকার। আর তাছাড়া বড় কোন লোন তো আর দিচ্ছ না। টাকার অংকে দেখতে গেলে পাঁচ লাখ মাত্র।
যদি আমি টাকাটা দেই।
-কেন দেবে?
ভাবী, খুব ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছি। ভাইয়া মারা যাওয়ার কিছুদিন পরে মাকেও হারিয়েছি। বিশ্বাস কর, তুমি চলে যাওয়ার পর একটা বারের জন্যও বাইকটি চালাই নি। পরিত্যাক্ত হয়ে গ্যারেজে পড়ে আছে ওটা। আমাকে কি একটি বারের জন্যও ক্ষমা করা যায় না?
তোমার প্রতি আমার কোন রাগ নেই। আদনান যখন বিশ্রীভাবে তোমাকে গালি দিচ্ছিল তখন আমিও তো তাকে কিছু বলতে পারিনি। অপরাধ তো আমারও আছে।
আমার অপরাধ তার থেকে অনেক অনেক বেশি।
টাকা দিয়ে সে জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে চাও?
একদমই না
তাহলে
বড় আপুকে তোমাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতে বলেছি। দেনমোহর হবে পাঁচ লাখ, আমি সাথে সাথে শোধ করে দেব।
-আগে বাইকটা ঠিক করাও।
-কেন?
বিয়ের পর আমাকে পেছনে বসিয়ে ঘুরবে তাই।