আরিফুর রহমান সেলিম
বেকারীর গরম চুলা থেকে সবেমাত্র নামানো হলো পাউরুটিগুলো। একটার পর একটাকে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে টেবিলে। তারপর এগুলোকে প্যাকেট করা হবে বিক্রি করার জন্য। যে পাউরুটিগুলো টেবিলে রাখা হলো তার মধ্যে একটা পাউরুটি খুব সুন্দর হয়েছে। গায়ের রংটাও হয়েছে চমৎকার। ফুলে ফেঁপে কেমন নাদুস নুদুস চেহারা। সে জন্য তাঁর অহংকারের যেন শেষ নেই। সেই সুন্দর পাউরুটির অস্থিরতা দেখে পাশের পাউরুটি টি বললো “তুই এত নাচানাচি করছস কেন? ঠাণ্ডা হয়ে বস।
হি হি হি করে হাসি দিয়ে সুন্দর পাউরুটিটি বললো দেখেছিস আমাকে ? কি সুন্দর আমি, দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যাবে সবার। পাশের পাউরুটিটা বললো, হাতে নিয়ে যখন কুট্টুস করে তোকে কামড় দিবে তখন বুঝবি কি মজা। ওহ মাই গড একি বলছিস তুই? আমাকে দিবে কামড়? কামড় দিবে না তো তোকে চুমু দিবে। তোর জন্মই তো হয়েছে কামড় দেওয়ার জন্য।
এরকম পচা কথা বলবি না। আমাকে কেউ কামড় দিবে না। মানুষ আমাকে হাতে নিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে। আর কল্পনা করবে সে উড়ে উড়ে চাঁদের দেশে যাচ্ছে। পিছনে পিছনে হাঁটছে ফুলপরীরা, নীল পরীদের বাচ্চারা। আমাদের পিছু পিছু গান গাইতে গাইতে ছুটবে। প্রজাপতি, মৌমাছি আমার সুঘ্রাণে মুগ্ধ হবে। একবার নাকের কাছে নিতে পারলে বলবে ওহ কি দারুণ সৌরভ।
ঢং! তোরে নিয়ে এমনে হাঁটতে গেলে তো হোঁচট খেয়ে পড়বে। পড়ে নাক মুখ ফাটবে, রক্তাক্ত হবে। শেষে লাথি দিয়ে বলবে দূর হ হতচ্ছারা। আর শোন এত অহংকার করিস না। বেশি অহংকার ভালো না। পাশের পাউরুটি বললো।
তুই এতো নিচু কেন? কথার কি শ্রী! সব সময় সুন্দর সুন্দর কথা বলবি। যেন তোর কথা শুনে প্রাণ জুড়ায়। আর আমাকে দেখ। তোদের তো কিনবে রিক্সাওয়ালা, চানাচুরওয়ালা। আর আমাকে কিনবে স্কুলের ছাত্র, নয়তো অফিসের বস। চেহারা দেখ আমার। সুন্দর পাউরুটিটা বললো।
কিছুক্ষণ পর একটা স্কুলের ছাত্র এলো দোকানে। এসে দোকানিকে বললো আমাকে একটা পাউরুটি দাও। দোকানি তখন সুন্দর পাউরুটির পাশের পাউরুটিটি ছাত্রটিকে দিয়ে দিলো। পাশের পাউরুটিটি ছাত্রটির মুখে যেতে যেতে বললো দেখলে তো আমাকে কে কিনেছে। আমি চিন্তায় আছি তোর যে শেষ পর্যন্ত কি হয়।
ততক্ষণে সুন্দর পাউরুটিটি একা হয়ে গেলো। তার সাথে থাকা অন্য পাউরুটিগুলোও বিক্রি হতে লাগলো। এভাবে দুইদিন হয়ে গেলো সুন্দর পাউরুটি আর বিক্রি হয় না। ততক্ষণে সুন্দর পাউরুটির ভিতরে জন্ম নিলো এক ব্যাকটেরিয়া। সে শুধু পাউরুটিকে এদিকে খোঁচা দেয়, ও দিকে খোঁচা দেয়। পাউরুটির কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কাঁদতেও পারে না। শুধু তার মন খারাপ হতে থাকে।
ছোট্ট একটা বাচ্চা মায়ের কোলে চড়ে আসলো বেকারীতে। তাঁর দুচোখ জুড়ে চশমা। চশমাটা রঙিন। যে দিকে তাকায় সব কিছুই রঙিন দেখা যায়। দোকানে এসেই বললো মা আমি রুটি কিনবো, আমি পাউরুটি খাব। তাঁর মা ব্যাগ থেকে টাকা বের করে পাঁচটি পাউরুটি কিনলো। সে পাঁচটি পাউরুটির সাথে সুন্দর পাউরুটিও ছিলো। দোকানি একটা ব্যাগে ভরে দিলো পাউরুটিগুলো।
ব্যাগের ভিতর বসে সুন্দর পাউরুটিটা কেমন জড়োসরো হয়ে বসে রইলো। আগের মতো নেই নড়াচড়া, নেই উচ্ছ্বাস। নিজের কাছেই নিজের কেমন ভ্যাপসা একটা ঘ্রাণ আসছে। ইচ্ছে করছে নাকে টিপ দিয়ে ধরে। কিন্তু পাউরুটিটি অনেক খুঁজেও নিজের নাকটাকে খুঁজে পেলো না।
সুন্দর পাউরুটির ভিতরে থাকা ব্যাকটেরিয়াটা ভীষণ দুষ্টু। পাউরুটিটাকে কাতুকুতু দিচ্ছে। কিন্তু সুন্দর পাউরুটিটা কিছুতেই তাঁর মন ভালো করলো না। শেষে ব্যাকটেরিয়া অধৈর্য হয়ে বললো এ কোন রস-কস হীন পাউরুটির ভিতরে আমার জন্ম হলো! আর বললো দাঁড়াও বাড়িতে গিয়েই তো বাচ্চাটা পাউরুটিটা খাবে। তখন আমি বাচ্চাটার মুখের ভিতর যাব। আর দাঁতের উপর বসে বসে দাঁতগুলো নষ্ট করে দেব। বলেই ব্যাকটেরিয়া হি হি হি করে হাসতে লাগলো।
বাড়িতে এসে বাচ্চাটা আর বাড়িতে থাকা তাঁর বোন মাকে বলতে লাগলো মা পাউরুটি খাব। বেনী দুলানো মেয়েটা তো ব্যাগ থেকে একটা পাউরুটি বের করে দিলো এক কামড়। সে মজা করে করে পাউরুটি খাচ্ছে। মা তখন বাচ্চাটাকে দিলো সুন্দর পাউরুটিটা। পাউরুটিটার তখনো মন খারাপ। নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃণা হচ্ছে। তাঁর শরীরে যে ব্যাকটেরিয়া নামক এক দুষ্টুর বাসা। সে চিন্তা করছে বাচ্চাটার পেটে ব্যাকটেরিয়া গেলে বাচ্চাটার কি হবে।
ততক্ষণে বাচ্চাটার ছোট্ট ছোট্ট দাঁত দিয়ে পাউরুটিটাকে খেলো। দুষ্টু ব্যাকটেরিয়া বাচ্চাটার দাঁতে আশ্রয় নিলো। কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই বাচ্চাটা বমি করে দিলো। মা তখন বললো পাউরুটিটা মনে হয় পচা। সে বাচ্চাটাকে পুকুর ঘাটে নিয়ে গেলো। সেখানে কুলি করালো বাচ্চাটাকে। কুলির সাথেই বেরিয়ে আসলো দুষ্টু ব্যাকটেরিয়া।
দোকানিকে বকাঝকা করে মা বাচ্চাটাকে নিয়ে ফিরলো ঘরে। মনের আশা পূর্ণ করতে না পারা ব্যাকটেরিয়া পানিতে ভাসতে ভাসতে হঠাৎ দেখা হলো এক ভাইরাসের সাথে। ভাইরাস বললো তুই এখানে কি করতে এলি? এটা তো ভাইরাসের রাজ্য।
ওমা ভাইরাসের রাজ্যে বুঝি ব্যাকটেরিয়া আসতে পারবে না? তুমি কি জানো এই সমগ্র পৃথিবীটা হলো আল্লাহর রাজ্য। সবার প্রাণ দেন তিনি। সবাইকে রক্ষা করেন তিনি। জীবন মৃত্যুও তাঁর হাতে। ভাইরাস তাঁর ভুল বুঝতে পারলো। সেই থেকে ভাইরাস আর ব্যাকটেরিয়া মিলেমিশে থাকতে লাগলো।