শফিকুল মুহাম্মদ ইসলাম

রিনির বয়স সাত। সে থাকে বাংলাদেশের এক শান্ত গ্রামে, যেখানে ধানক্ষেতের সবুজের পাশে কাক ডাকে, আর খালের জলে খেলে বেড়ায় রোদের আলো।

রিনি একটু অন্যরকম। সে মেঘ দেখে কথা বলে, বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ শুনে গুনগুন করে গান গায়। তার প্রিয় ঋতু? অবশ্যই আষাঢ়। কারণ আষাঢ় মানেই বৃষ্টি, কাদা, আর দারুণ সব রঙিন কল্পনা!

এক দুপুরে, আকাশে জমে উঠল কালো মেঘ। ঠান্ডা বাতাস বইছে, তালগাছগুলো দুলছে। হঠাৎ টুপটাপ করে বৃষ্টি নামল।

রিনি আনন্দে লাফিয়ে উঠল,

“আষাঢ় এলো! বৃষ্টি এলো!”

মা চিৎকার করে বললেন,

“ওই! বাইরে যাস না, ভিজে গিয়ে সর্দি হবে।”

কিন্তু রিনি তো রিনি! সে নাচতে নাচতে উঠোনে চলে গেল। দুই হাত বাড়িয়ে আকাশ থেকে পড়া ফোঁটাগুলো ধরতে ধরতে গান ধরলÑ

“আকাশ কেঁদে হাসে রে,

রিনির ঘরে বৃষ্টি আসে রে!”

হঠাৎ একটা বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়ল রিনির কপালে। সেই মুহূর্তে সবকিছু কেমন ঝাপসা হয়ে এলো। চোখের সামনে এক ঝলক আলো, ঝিলমিল ঝিকিমিকি!

রিনি চোখ খুলে দেখে, সে আর উঠোনে নেই! সে এখন এক রঙিন রাজ্যে, যেখানে চারপাশে উড়ছে মেঘ-ঘোড়া, বৃষ্টির ফোঁটা ফুলের মতো ফুটে আছে গাছে, আর ব্যাঙেরা গলায় মুকুট পরে রাজসভায় বসে আছে।

এখানেই তার দেখা হলো বাদলপুচ্ছ রাজার সঙ্গে। রাজা ছিলেন এক বিশাল ব্যাঙ, যার মাথায় সোনালি মুকুট, আর হাতে এক আকাশি রঙের বৃষ্টির তরবারি।

রাজা বললেন,

“রিনি, তুমি তো আমাদের রাজ্যের ভালো বন্ধু! তুমি বৃষ্টি পছন্দ করো, গান গাও, খেলো। তাই তোমাকে এনেছি আমাদের রাজ্যে। তোমার চোখ দিয়ে পৃথিবীটা আরও সুন্দর হয়ে উঠুক এই আমাদের আশীর্বাদ।”

রিনি তো চোখ কপালে তুলে বলল,

“আপনারা সত্যি সত্যি বৃষ্টির রাজ্যে থাকেন? মেঘ দিয়ে ঘোড়া বানান? রামধনু দিয়ে ছবি আঁকেন?”

রাজা হেসে বললেন,

“চলো, তোমাকে সব দেখাই!”

তারা মেঘ-দোলনায় চড়ে উড়ে গেল আকাশের বুকে। নিচে দেখা গেল, ছোট ছোট শিশু খেলছে কাদামাটিতে, কেউ বৃষ্টির জলে কাগজের নৌকা ভাসাচ্ছে, আবার কেউ বৃষ্টির রিমঝিমে ঘুমিয়ে পড়েছে দাওয়ায়।

এক জায়গায় গিয়ে রিনি দেখল, কিছু ছোট মেঘ কাঁদছে।

রিনি চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,

“ওরা কাঁদছে কেন?”

বাদলপুচ্ছ রাজা মুখ ভার করে বললেন,

“ওরা হলো শিশু-মেঘ। যখন কোনো গ্রামে শিশুরা বৃষ্টিকে ভয় পায়, কাদা নিয়ে খেলা করে না, তখন এই ছোট মেঘদের মন খারাপ হয়ে যায়।”

রিনি গভীরভাবে ভাবল। সে বলল,

আমি সবার সঙ্গে গল্প করব, গান গাইব, সবাইকে বলবÑবৃষ্টি মানে ভয় না, আনন্দ। মাটি হাসে, গাছেরা গায়, আর ছোটরা তখন প্রকৃতির সঙ্গে এক হয়ে যায়!”

রাজা খুব খুশি হয়ে বললেন,

“তুমি প্রকৃতির সুর বোঝো। আমরা তোমাকে আজ থেকেই ‘বৃষ্টি-কন্যা’ উপাধি দিলাম।”

রিনির গলায় পরিয়ে দেওয়া হলো এক রামধনু-রঙা মালা। আর হাতে দেওয়া হলো এক বিশেষ ছাতাÑযা বৃষ্টির পানি ঠেকায় না, বরং রঙিন আলো ছড়ায় চারদিকে।

হঠাৎ আবার সেই ঝলমলে আলো।

রিনি চোখ খুলে দেখে-সে আবার নিজের উঠোনে! চারপাশে এখনো হালকা বৃষ্টি পড়ছে। পেছনে মা দাঁড়িয়ে, মুখে হাসি।

মা জিজ্ঞেস করলেন,

তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি রে?”

রিনি দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,

“আমি ছিলাম বৃষ্টির রাজ্যে। রাজা ব্যাঙ আমাকে মালা দিলো! তোমাকেও একদিন নিয়ে যাব মা!”

সেদিন সন্ধ্যায়, রিনি উঠোনে বসে নৌকা বানায়, গান গায়, আর পাড়ার শিশুদের বলেÑ

“আষাঢ় মানে শুধু কাদা নয়,

আষাঢ় মানে আকাশের গল্প,

বৃষ্টির হাসি আর প্রকৃতির স্নেহ।”