মোহছেনা পারভীন
দামি গাড়ি হাঁকিয়ে যাচ্ছিলেন ব্যবসায়ী ইকবাল কবির। রাজলক্ষী মার্কেট পেরিয়ে কুশল সেন্টারের সামনে যেতেই চোখে পড়ল বড় একটি সাইনবোর্ড। তাতে বড় করে লেখা আছে ‘এখানে যাকাতের কাপড় সস্তায় পাওয়া যায়’। ইকবাল সাহেব ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললেন। ড্রাইভার যথারীতি গাড়ি থামাল কুশল সেন্টারের সামনে। উত্তরার সব মার্কেট রোজার শুরু থেকেই শেষ পর্যন্ত খুবই জমজমাট থাকে। কুশল সেন্টারও তেমনি একটি মার্কেট যেটি ক্রেতাদের পদচারণায় সব সময় মুখর থাকে। ইদানিং মার্কেট শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে।
বিভিন্ন চাকুরিজীবী, ব্যাংকার, ব্যাবসায়ী সবাই যার যার মতো কেনাকাটা করে থাকে এই মার্কেট থেকে। ইকবাল কবিরও গিয়েছেন যাকাতের কাপড় কিনতে। শাড়ি, লুঙ্গি কিনবেন। গ্রামের গরির অসহায়দের মধ্যে বিতরণ করবেন। দোকানির কাছে জানতে চাইলেন পাঁচশত পিস শাড়ি পাঁচশত পিস লুঙ্গির কত দাম পড়বে। দোকানি ক্যালকুলেট করে যে হিসেব দিল তাতে সম্মত হয়েছেন ইকবাল সাহেব। গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যাবেন, তখন কাপড়গুলো বিলিয়ে দেবেন। দোকানি যথারীতি যাকাতের কাপড়গুলো প্যাকেট করে দিলেন। যতটুকু মূল্য গায়ে লেখা ছিল তাথেকে ২০% কম মূল্যে কাপড়াগুলো তাকে দেওয়া হলো। মার্কেটের সামনে পার্ক করা ইকবাল সাহেবের গাড়িতে কাপড়ের প্যাকেটগুলো তুলে দেয় দোকানের এক কর্মচারী। ইকবাল সাহেব কর্মচারীকে একশ টাকা বকশিশ দেন।
ইকবাল সাহেব একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। উত্তরায় তার কয়েকটি ফ্ল্যাট ও প্লট আছে। নান ধরনের বিজনেসের সাথে জড়িত তিনি। সৎ জীবন যাপন করেন। প্রতি বছর যাকাতের কাপড় কিনে গ্রামে পাঠিয়ে দেন, কিন্তু তিনি গ্রামে যান না। এবার তিনি গ্রামে যাবেন। নিজের হাতে কাপড়গুলো বিলিয়ে দেবেন।ঈদের বেশি দেরি নেই। প্রাইভেট কারে যাবেন গ্রামের বাড়িতে। তাই টিকেট করার কোনো ঝক্কি ঝামেলা নেই। স্ত্রীর হাতে বাচ্চাদের কেনাকাটার টাকা তুলে দিয়েছেন। ইকবাল সাহেবের এই ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা নেই। একদম নিশ্চিন্ত। তিনি বড় ব্যবসায়ী হলেও সংসার পুরোটাই সামলায় তার স্ত্রী মুনিরা।
দশ নম্বর সেক্টরে ইকবাল সাহেবের বাসা। বাসায় গিয়ে তিনি কাপড়ের একটি প্যাকেট খুললেন। খুলে দেখলেন এটা তো শাড়ি না, যেন একটা মশারি। এক ধুয়াতেই রং উঠে ত্যানা হয়ে যাবে। খুব মন খারাপ হয় ইকবাল সাহেবের। ঝানু একজন ব্যবসায়ী হওয়া সত্ত্বেও তিনি যেন আজ ঠকে গেছেন। ড্রইংরুমে বসে এলোপাথাড়ি অনেক কিছু ভাবছেন। সস্তা শব্দটি দেখে তিনি আকৃষ্ট হয়ে দোকানে গিয়েছেন। দোকানী সন্তুষ্ট হয়ে আরও সস্তায় দিয়েছেন যাকাতের কাপড়গুলো। বোকামির জন্য লজ্জিত হলেন। তার বুঝা উচিত ছিল আমাদের দেশ মুসলিম দেশ হওয়া সত্ত্বেও নিত্যপণ্যের দাম থেকে শুরু করে সব জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি করা হয় এই রমজানে।
সিণ্ডিকেটের সিনক্রিয়েটে নাভিশ্বাস উঠে সাধারণ মানুষের। আর এখানে যাকাতের শাড়ি সস্তায় বিক্রি করা হয়। এটা একটা রহস্য। আর সেই রহস্য হচ্ছে নিম্নমানের সুতা, রং ব্যবহার করে এসব কাপড় তৈরি করা হয় যা টেকসই হয় না। তার প্রমাণ এই শাড়িগুলো। বিগত বছরগুলোতে যত যাকাতের কাপড় পাঠিয়েছে সবগুলো তার কর্মচারীদের মাধ্যেমে। এই প্রথম তিনি নিজেই কিনলেন। এটা ইকবাল সাহেবের জন্য অন্যরকম এক ভালো লাগা। কিন্তু ভালো লাগার বদলে তার নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে। যারা ধনাঢ্য ব্যক্তি তাদের তো পয়সার অভাব নেই। তারা ইচ্ছে করলে ভালো দামের টেকসই, গ্রামের মানুষের উপযোগী সুন্দর কাপড় কিনে দিতে পারেন, কেন তিনি সস্তা খুঁজতে গেলেন এমন সব ভাবনা ভাবিত করে তোলে ইকবাল সাহেবকে। পরেরদিন শাড়িগুলো দোকানে ফেরত দিতে গেলেন ইকবাল সাহেব। তখনি ঘটলো বিপত্তি। কোনো মতেই দোকানের মালিক কাপড় ফেরত নেবে না। দোকান মালিক সমিতির লোকজন এসে বুঝিয়েছেন কাপড়তো ওরা বানায়নি, কাপড় বানিয়েছে তাঁতিরা। যারা মূল ব্যবসায়ী এটা তাদের সমস্যা, এই দোকানদারের না।
ইকবাল সাহেব দোকানে কাপড়গুলো ফেরত দিলেন, কিন্তু দোকানী টাকা ফেরত দেননি। এমন নিম্নমানের কাপড় যাকাত হিসেবে দেওয়া যাবে না। কাপড়গুলো ফেরত দিয়ে ইকবাল সাহেব প্রতিবাদ করলেন। ‘যাকাতের কাপড়’ নামে কোনো শব্দ থাকবে না। ধনীদের সম্পদে যাদের হক আছে তারা অনেক সম্মানিত। তাদেরকে ছোট করে দেখলে চলবে না। তাদের হক সঠিকভাবে দিতে হবে। এই সব কথা বলে ইকবাল সাহেব অভিমান করে টাকা না নিয়ে দোকান থেকে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে গেলেন। সবাই তাকিয়ে থাকলো। কারো কিছু বলার সাহস হলো না। বাসায় যেতে যেতে ইকবাল সাহেব অনেক কিছুই ভাবলেন। যাকাতের সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ব্রেক কষার শব্দে তার সম্বিৎ ফিরে আসে। সামনে একজন বয়স্ক রিক্সাওয়ালা তিনজন ইয়াং মানুষকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে রোজার দিনে। ক্লান্ত হয়ে প্রায় গাড়ির সামনে পড়েই যাচ্ছিল। গাড়ি থেকে নেমে ইকবাল সাহেব লোকটির সাথে কথা বললেন। মানিব্যাগ থেকে বৃদ্ধ লোকটিকে দুই হাজার টাকা দিলেন, ইফতারি খাওয়ার জন্য পরিবার নিয়ে। ইকবাল সাহেবের মনে হলো নিম্নমানের যাকাতের কাপড় না দিয়ে গ্রামের গরিব আত্মীয় স্বজন, ও প্রতিবেশীকে টাকা দিয়ে দিলেই ভালো হবে। তারা তাদের পছন্দ মতো জিনিস কিনে নিতে পারবে। ঈদের একসপ্তাহ আগেই চলে যায় ইকবাল সাহেব তার গ্রামের বাড়িতে। অনেক দিন আত্মীয় স্বজনের সাথে ঈদ করা হয় না। বাবা-মা বেঁচে থাকতে প্রায়ই যাওয়া হতো গ্রামে।
এবার গ্রামে গিয়েই প্রতি পরিবারকে পাঁচ হাজার টাকা করে দিলেন। টাকা পেয়ে সবাই খুশি। মানুষ পয়সার অভাবে অনেক কিছুই কিনতে পারে না। অনেকের সেমাই, চিনি কেনারও পয়সা জোটে না।
ইকবাল সাহেবকে দেখে গ্রামের মানুষ অনেক খুশি হয় কারণ অনেক দিন পর স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে নিয়ে গ্রামে ঈদ করতে এসেছে। তার কাছ থেকে উপহার পাওয়ার চেয়ে, তার উপস্থিতিই গ্রামের মানুষের কাছে অনেক আনন্দের ছিল।
ঈদগাহে গিয়ে শৈশবের কথা মনে পড়ে ইকবাল সাহেবের। এ বাড়ি ও বাড়ি গিয়ে ফিরনি সেমাই খাওয়া, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ঘুরে বেড়ানো প্রতিবেশী চাচি, ফুফুদের আপ্যায়নের কথা সবকিছু মনে পড়ে ইকবাল সাহেবের। তবে এবারের ঈদে গ্রামের গরিব আত্মীয় স্বজনের মুখে হাসি দেখে তার প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। সে বুঝতে পারে এতদিন তারা যাকাতের কাপড় পেলেও খুশি ছিলনা, এবারে নগদ টাকা পেয়ে তারা অনেক খুশি। সেমাই, চিনি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পছন্দমতো কিনতে পেরেছে তাই।
ঈদুল ফিতরের দুইদিন পর ব্যবসার জরুরি কাজে ইকবাল সাহেব পরিবার দিয়ে টাঙ্গাইল থেকে ঢাকায় চলে আসে। তারও দুইদিন পর যাকাতের কাপড় ব্যবসায়ী তার ঠিকানা যোগাড় করে হাজির হয় বাসায়। গোনে গোনে সব টাকা তাকে ফেরত দেয় দোকানি। ইকবাল সাহেব জানতে চায় তার ব্যবসা কেমন হয়েছে। দোকানি তাকে জানায় সে যাকাতের সব শাড়ি প্রকৃত মালিককে ফেরত দিয়েছে। মূল টাকাটা উদ্ধার করতে পেরেছে। সে সিজনাল ব্যবসায়ী। রমজান মাসেই সে এ ব্যবসা করে। ইকবাল সাহেবের এই প্রতিবাদ দোকানির বিবেককেও নাড়া দেয়। সে সৎভাবে অন্য ব্যবসা করবে বলে ইকবাল সাহেবকে জানায়। দোকানির কথায় মুগ্ধ হয়ে ইকবাল সাহেব তাকে টাকাটা দান করে দেয়। আর ব্যবসায় কোনো টাকার প্রয়োজন হলে সহযোগিতা করবে বলে আশ্বাস দেয়। দোকানি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যায়।
ব্যবসায়ী ইকবাল কবির পুরো ঘটনাটি তার স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েকে খুলে বলে। তারা যাকাতের কাপড় বিক্রেতার সততার প্রশংসা করে। আর ইকবাল সাহেব মনে করেন, একজন একজন করেই একদিন সবাই সুন্দর মানসিকতার পরিচয় দেবে। গরিব, মিসকিনের মুখে ফুটবে হাসি। বদলে যাবে দেশ। সেদিন আর বেশি দূরে নয়।