আশরাফ জামান

রহমান ভাই বলে ডাকে শহরের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। কারণ তিনি সকলের অত্যন্ত প্রিয়জন। হিন্দু কি মুসলমান সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার ক্ষমতা তাকে আল্লাহ দান করেছিলেন। এদিক থেকে বলা যায়, অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তবে তিনি রাজনৈতিক কোনো নেতাও নন বা গ্রামের মাতাব্বরও নন।

আমাদের ছোট্ট শহরে জনপ্রিয় ব্যক্তি রহমান ভাই গল্পের আসর জমানোর মানুষ। চায়ের কাপ বা সিগারেট হাতে নিয়ে পান মুখে দিয়ে তার বক্তব্য শুরু হতো কখনো মুদির দোকানে, বইয়ের দোকানে, কখনো চায়ের দোকানে বা কোনো আড্ডাখানায়। যুক্তির মারপ্যাচে এমনভাবে তিনি বক্তব্য দাঁড় করাতেন যে, উপস্থিত কেউ আর তার প্রতিবাদ করতে পারতো না। উপস্থিত সকলে থাকতো তার শ্রোতা। তিনি হলেন একক বক্তা।

তর্ক হতো কখনো বা হিন্দু ধর্ম শাস্ত্র নিয়ে, ধর্মীয় পণ্ডিত বা ব্রাহ্মণ ঠাকুরের সঙ্গে। অসাধারণ জ্ঞান ও যুক্তির কাছে হেরে গিয়ে প্রণাম করে যেতো তারা। বলতো, আপনাকে নমস্কার জানাই গুরুদেব।

আবার অন্যদিকে তর্ক হতো ইসলামের কোনো ঘটনা ইতিহাস, আকিদার উপর কোনো আলেমের সঙ্গে সেখানেও রহমান ভাই ছিলেন বিজয়ী তার্কিক।

আমরা তাকে দেখতাম শহরের হিন্দু মন্দিরে। হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে সকলের সামনে গিয়ে বসে আছেন মধ্যমণি হয়ে। মুখ ভরা ছিল সাদা দাড়ি, মাথায় ভাসানীর তালের টুপি। কিন্তু তাতে কোনো সংকোচ বা লজ্জা হতো না তার। আবার ইসলামী জলসায়ও সামনে গিয়ে বসতেন সকলের আগে। তাকে জিজ্ঞেস করতাম, রহমান ভাই। আপনি কোন ধর্মের লোক?

উত্তরে দৃঢ়তার সাথে বলতেন, কেন ইসলামী। কোনো সন্দেহ আছে কি? আমি চাই এ দেশে ইসলাম কায়েম হোক। এ দেশর নব্বই ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এটা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার।

আমরা বলতাম, কিন্তু আপনি হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নেন? উত্তরে বলতেন, তাদের সম্পর্কে জানার জন্য যাই। দূরে থাকলে বুঝবো কি করে আমার ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব তো যাচাই করতে হবে।

ইসলাম সম্পর্কে বলতেন, ইসলাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম-পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। আর আমি মুসলমান হয়ে জন্মগ্রহণ করেছি এর চেয়ে আর কি চাওয়ার আছে আল্লাহর কাছে?

রহমান ভাইর অভ্যাস ছিল যুক্তি দিয়ে কথা বলার সময় কখনোবা অশ্লীল কথা অনায়াসে বলতেন। আমরা তাই মুরুব্বিদের সাথে বসলে তার সঙ্গ ছেড়ে চলে আসতাম। আবার আমাদের সঙ্গে বসলে মুরুব্বিরাও চলে যেতেন।

কথা বলার এমন আকর্ষণীয় গুণ ছিল রহমান ভাইর যে তিনি কথা বলা শুরু করলে পেটে ক্ষুধা থাকলেও খাবারের কথা মনে পড়তো না।

মনে হতো আর কিছু সময় থাকি। কথা বলার সময় ঘন ঘন পান সিগারেট আর চা খেতেন। তবে এগুলো বাড়ির বাইরে গেলে সাধারণত ক্রেতারাই জোগার করতো।

রহমান ভাই এর আদর্শ ব্যক্তিত্ব ছিলেন মওলানা ভাসানী। ভাসানীকে তিনি অত্যন্ত পছন্দ করতেন। তার নিরহঙ্কারী স্বভাব, নির্লোভ চরিত্র এবং অমায়িক ব্যবহারের জন্য। কথায় কথায় বলতেন তার প্রসঙ্গ।

হঠাৎ করেই লেখা শুরু করলেন রহমান ভাই। একদিন এসে বললেন, জামান তোমাদের একুশে ফেব্রুয়ারির স্মরণিকায় আমার প্রবন্ধ ছাপবে?

বললাম, হ্যাঁ, রহমান ভাই আপনার লেখা অবশ্যই প্রকাশ করবো। তিনি ছিলেন একটি প্রবন্ধ যা ছিল ব্যতিক্রমধর্মী বক্তব্যে ভরা। প্রবন্ধটি প্রকাশ করায় আমাদের স্মরণিকার সাটতিও বেড়েছিল।

বলা যায়, প্রথম লেখা প্রকাশ পাওয়ার পরই খুব উৎসাহবোধ করলেন রহমান ভাই। গ্রামের জমি বিক্রি করে প্রকাশ করলেন জাতীয়তাবাদের উপর একটি রাজনৈতিক গ্রন্থ। যা ছিল দু’শ পৃষ্ঠার একটি বই। এ জাতীয় বই বিক্রি করা খুবই দুরুহ ব্যাপার। তাছাড়া অনেক ভদ্রলোকই পয়সা দিয়ে কেনার মতো বিলাসিতা করেন না। তবু হাল ছাড়লেন না রহমান ভাই। বইখানি বন্ধু-বান্ধবদের সৌজন্য কপি হিসেবে দিয়ে শেষ করে ফেললেন।

রহমান ভাইয়ের বইটির আলোচনা সমালোচনা হলো মানুষের মুখে মুখে। আরো উৎসাহিত হয়ে লেখা চালালেন অবিরাম গতিতে। একটি গ্রন্থের সম্পাদনার দায়িত্ব পড়লো আমার উপর। আমাকে বললেন, জামান! এখন আর চোখে দেখি না আমার একটা বই তুমি বের করে দাও। টাকা যা লাগে দেব।

বললাম, রহমান ভাই! আপনার বইয়ের ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব, আপনি প্রেসে দেন।

অবশেষে বইটি বের হলো। কিন্তু তা থেকেও টাকা উঠে এলো না। আরো দুটি বই বের করেছিলেন। একটি রাজনৈতিক, অন্যটি ইসলামী জীবনব্যবস্থার উপর।

হাজার মানুষের প্রিয়জন রহমান ভাই তার সন্তানদের কাছে প্রিয় হতে পারলেন না। জমি বিক্রি করে বই বের করছেন এটা পছন্দ করলো না তার সন্তানরা। বাবার মৃত্যুর পর ফেলে যাওয়া সম্পত্তির মালিক যে হবে তারাই। বাবার জমিদারী নেই যা সামান্য আবাদি জমি আছে এভাবে বিক্রি করলে যে অল্পদিনে শেষ হয়ে যাবে। তাই তারা বাবার বই প্রকাশের মতো বিলাসিতার প্রতিবাদ জানালো।

বই প্রকাশের নেশা বন্ধ হলো আব্দুর রহমানের। একদিন এসে তিনি বললেন, জামান। আমার কলম বন্ধ হয়ে পড়েছে। আমি আর লিখব না। আমার জন্য দোয়া করো যেন ঈমানের সাথে কবরে চলে যেতে পারি।

সংসারে ছেলেমেয়ে পরিবেষ্টিত থেকেও নিঃসঙ্গ রহমান ভাই হাপিয়ে উঠলেন। বৃদ্ধ বয়সী স্ত্রী কাছে নেই সে চলে গেছে পরপারে। পাশে এসে বসতো দশ বছরের এক নাতি। সে করতো দাদুর ফরমাশ।

খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট করতে হয় বৃদ্ধ বয়সে। যে রহমান তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন সংসারটিকে, সে সংসারের কেউ নেই তার খোঁজখবর নেবার। মেয়ে দুটি রয়েছে স্বামীর ঘরে। বাবার খোঁজখবর তারা নিতে পারে না। ছেলের বউদের বলতে লজ্জা লাগে। তাছাড়া তার অভিযোগ শুনতে চায় না ছেলে দুটি। যাদের কোলে পিঠে করেছেন তারাই। বউরা তো পরের মেয়ে, তাদের দোষ কি?

একদিন মনের ক্ষোভ আর খেদ নিয়ে তার অভাবের কথা জানালেন রহমানের ছোট ছেলে রফিককে।

বললেন, আমি বুড়ো হয়ে গেছি কি খাই না খাই, দেখিস না। পান, জর্দা পর্যন্ত কেনার পয়সা থাকে না।

রফিক তার জবাবে বলল, তুমি উঠানে আম গাছে গলায় দড়ি দাও। রহমান এ কথার কোনো জবাব দেননি। নিঃশব্দে শুধু কেঁদেছেন।

দুদিন পর তার সুযোগ এলো। অভিমানে ক্ষুব্ধ রহমান এর মধ্যে বাজার থেকে নতুন একটি রশি কিনে বালিশের নিচে রেখেছেন। দিনটি শুক্রবার। বাড়িতে একা। সকলে আত্মীয় বাড়ি বেড়াতে গেছে। কাজের মেয়ে রহিমাকে বিকেল বেলা ডেকে রহমান বললেন, রহিমা যাতো মা দু টাকার পান নিয়ে আয়। রহিমা বলল, চাচা পান তো আছে। ধমক দিলেন রহমান। যা আরো পান দরকার সারারাত চলবে না।

অগত্যা পানের জন্য বাজারে গেল রহিমা।

দুনিয়ার কাকেও আর আপন মনে হলো না রহমানের। আমার মতো দূরের লোকদেরও ভুলে গেলেন। অর্থাৎ আমি বলেছিলাম, রহমান ভাই! কোনো অসুবিধা হলে আপনি আমার কাছে চলে আসবেন। আমি তখন ঘোড়াশালে একটা কলেজে প্রভাষক পদে চাকরি করতাম।

উঠানে নিজের হাতে লাগানো আম গাছটাকে তার বেশি আপন মনে হলো। তাই সযত্নে রাখা রশিটা গাছের ডালে বেঁধে গলায় পেঁচিয়ে ফেললেন রহমান।

মৃত্যুর পর তার মুখে ফুঠে উঠেছিল প্রবল ঘৃণা আর অভিমান। এই ঘৃণা তার সন্তানদের প্রতি সমাজের প্রতি আর দেশের মানুষের প্রতি। যারা তার মতো একজন মানুষকে ক্ষুধায় দিল না খাদ্য, মনে দিল না শান্তি। অক্সিজেন নেবার অধিকারটুকু কেড়ে নিয়েছিল সুন্দর নীলাকাশটা আর ভালোবাসার একটি রোমান্টিক জগৎ।