ইয়াছিন ইবনে ফিরোজ

বাইরে টিনের চালে টাপুর টুপুর শব্দে বৃষ্টি পড়ছে। রাফি সোফায় বসে ট্যাব হাতে গেম খেলছে। হঠাৎ দাদুর গলা, বৃষ্টি পড়ছে রে রাফি! এই বৃষ্টি আমাদের সময় ছিল যুদ্ধের দিন। রাফি তাকায়, গা এলিয়ে চায়ের কাপ হাতে বসে আছেন দাদু। কেন দাদু? শুনবি? তাহলে গেমটা একটু নামিয়ে রাখ। একটা স্মৃতির গল্প বলি, আমার স্কুল যাওয়ার গল্প। এখন তোরা যা দেখে বড় হচ্ছিস, তখন এসব কিছুই ছিল না। আমাদের স্কুল ছিল পাঁচ কিলোমিটার দূরে ছনখোলা হাইস্কুল। হেঁটে যেতে হতো। পাঁচ কিলোমিটার! রাফির চোখ বড় করে বললেন। তুই আরো শুনে অবাক হবি। আমরা কেউ আসতাম হাওড় পাড়ের ঘোড়াশাল থেকে, কেউ কলতাপাড়া, কেউবা চর ভরাট করে বানানো পথ দিয়ে। বর্ষা এলেই সেই পথ থাকত না সব ডুবে যেত পানিতে। তাহলে কীভাবে যেতেন? কখনো হাঁটু সমান পানিতে হেঁটে, কখনো বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে, আবার অনেক সময় বই পত্র মাথায় নিয়ে চলতাম। কাঁদায় পিছলে পড়তাম। দাদু একটু থামলেন। চোখে জল চিকচিক করে উঠল। একবার কী হয়েছিল জানিস? পলাশপুর থেকে আসার পথে হঠাৎ ধসে পড়ে বাঁশের সাঁকো। আমি আর আমার বন্ধু হারুন পড়ে যাই। আমার বইয়ের ব্যাগ সোজা গিয়ে পড়ে পানিতে। সব খাতা, বই সব ভিজে যায়। তারপর? সেদিন স্যার কিছু বলেননি। উল্টো বলেছিলেন, হায়দার, তোর চেষ্টা আমি দেখেছি। বই না থাকলে আমি তোকে নতুন বই দেব। কিন্তু এই সাহস, এই চেষ্টা যেন না হারাস। রাফি মুগ্ধ হয়ে শুনছে। এবার বলে, দাদু, এখন তো স্কুল সামনে। রাস্তায় ব্রিজ আছে, ড্রেনেজ আছে, এমনকি বাসও চলে। এত কষ্ট করতে হতো কেন? এই ব্রিজগুলো আগে ছিল না রে। তখন যা ছিল, তা ছিল স্বপ্ন। আর আমাদের সেই স্বপ্নে জোর ছিল বলেই তোরা আজ এত কিছু পাচ্ছিস। তখন এক ইউনিয়নে একটাই মাধ্যমিক স্কুল ছিল। এখন প্রতিটা গ্রামে প্রাইমারি থেকে কলেজ পর্যন্ত। রাফি চুপ হয়ে যায়। নিজের ট্যাবটা বন্ধ করে বলে দাদু, আমি তো কখনো ভাবিনি পড়তে যাওয়ার এত কষ্ট হয়। এখন তো সামান্য বৃষ্টিতেই অনেকেই স্কুল বাদ দেয়। আপনি এত কিছু সহ্য করেও গেলেন? দাদু হাসেন। আমরা জানতাম, স্কুল না গেলে ভবিষ্যৎও যাবে। আর আজকের প্রজন্ম জানলে, কত সহজ হয়েছে তাদের পথ, তাহলে আর পিছিয়ে থাকবে না কেউ। বৃষ্টি এখনও ঝরছে। দাদু আর রাফি, দুই প্রজন্ম, পাশাপাশি বসে একজন অতীতের কাদা মাখা পথ থেকে জ্ঞান এনেছেন, আরেকজন ভবিষ্যতের আলো হাতে তুলে নিতে প্রস্তুত।

রাফি দাদুর কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেই কিছু উদ্যোগ নেয়, এবং তার বন্ধুরাও দাদুর কাদায় ভেজা স্কুল জীবনের গল্প শুনে বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে যায়। রাফির মনে ঘুরপাক খায় দাদুর বলা কথাগুলো। পরদিন স্কুলে সে টিফিন পিরিয়ডে বন্ধুদের কাছে বলে, তোমরা জানো, আমার দাদু কিভাবে স্কুলে যেতেন? পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে, কাঁদা পেরিয়ে, বাঁশের সাঁকোতে! বন্ধুরা হেসে উঠেঃ আরেহ! সত্যি? হ্যাঁ, সত্যি। এমনকি বই খাতাও ভিজে যেত, তাও হাল ছাড়ত না । ভাবো তো, আজ আমরা সামান্য বৃষ্টিতে ছাতা ছাড়া বের হই না। বন্ধু সাদিক বলে, চল না, এই নিয়ে একটা প্রজেক্ট করি আগে কেমন ছিল স্কুল জীবন!

শুক্রবার, রাফি, সাদিক, লাবিবা আর তিনজন মিলে যায় রাফিদের দাদুকে নিয়ে একটানা হাঁটতে। দাদু, আপনি যেভাবে যেতেন, সেই পথটা কি এখনো আছে? রাফি জানতে চায়। দাদু হাসেন, সবটা নেই। অনেকটা রাস্তা এখন পাকা। কিন্তু একটা জায়গা আছে, যেখানে আজও সাঁকোটা কাঠ দিয়ে বানানো হয় বর্ষায়। তারা সবাই হাঁটতে থাকে। পেরিয়ে যায় আধুনিক রাস্তা, ব্রিজ, দোকান। এরপর পৌঁছায় সেই পুরনো স্থানে একটা সরু খাল, আর তার উপর বাঁশের অস্থায়ী সাঁকো। দাদু থামেন। এই সেই জায়গা যেখানে আমি একবার পড়ে গিয়েছিলাম। বই ভিজে গিয়েছিল, কিন্তু আমি থামিনি। বন্ধুরা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। সেদিন রাতে, দাদুর পাশে বসে রাফি বলে,দাদু, আমি বড় হয়ে শিক্ষক হতে চাই। যেন আরও অনেক ছেলেমেয়ে তোমার মতো পথ তৈরি করতে পারে। দাদু শুধু বলেন, এই তো চাই! কাদার পথ একদিন ফুলে ভরে উঠবে যদি মন সোজা থাকে। বাইরে তখনও হালকা বৃষ্টি ঝরছে। রাফির মনে পড়ে যায় সেই শব্দ টাপুর টুপুর আর তার তালে তালে এগিয়ে চলা এক অসম্ভব সাহসের মানুষ তার দাদু।