শফিকুল মুহাম্মদ ইসলাম
গ্রামের নাম বাউশাম। শান্তিপূর্ণ, সরল মানুষে ভরা। এই গ্রামে একসময় ছিল এক পাগলাটে ছেলে,নামের আগেও “গো”, পেছনেও “হাকিম”! পুরো নাম-“গো-হাকিম”।
না, তার জন্মনাম মোটেও এটা না। মায়ের দেওয়া নাম ছিল “আব্দুল কাইয়ুম”, কিন্তু তার গরুর প্রতি অদ্ভুত টান আর ছেলেবেলায় গরু চরাতে গিয়ে কাঁধে লাঠি আর মুখে সিটি বাজিয়ে সে এমন নাম কুড়ায় যে, তার আসল নাম সবাই ভুলে যায়।
যার বয়স দশ, হাতে লাঠি, কাঁধে গামছা, মাথায় পাটের টুপি, সে কী করে এমন গরু চরায়, সেটা দেখে গরুরাও বিভ্রান্ত হতো, ‘‘এ আমাদের রাখাল, না রাখালের ছেলে?”
গো-হাকিমের ছিলো এক অদ্ভুত ভাষা। গরুকে সে ডাকত গান গেয়েÑ “গো গাইগো, ঘাস খাইগো,
চরে বেড়াই গগন চুইয়া,
দুধ দিবি কবে ভাইগো?”
তবে সে শুধু গরুর রাখাল ছিল না, ছিলো এক গরু-গবেষকও। কোন গরু কতটুকু ঘাস খায়, কোনটা সাদা দুধ দেয়, কোনটা টিপ দিতেই লাথি মারে , সব তার নখদর্পণে।
একবার হাওরে এক বিদেশি গবেষক এসেছিলেন। গরুর জেনেটিক পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করতে। গো-হাকিম তখন গাইড হিসেবে নিয়োগ পেলো মাগনা! কারণ সে তখনও জানতো না “গবেষণা” শব্দের মানে কী।
তবে সেই বিদেশি লোকটাই তাকে বলেছিলেন, “You are a cow-genius!”
সে বোঝেনি। কিন্তু তখন থেকেই সে গরুর ওপর গভীর চিন্তায় ডুবে যেতে শুরু করলো।
এরপর একদিন, ঘটে গেলো বিরাট ঘটনা। তার প্রিয় গরু “লালু” হঠাৎ করে পেট ফাঁপা হয়ে পড়লো। গো-হাকিম তখন লম্বা বাঁশ আর হাওরের কচুপাতা দিয়ে এক গরু-চিকিৎসা চালিয়ে দিলো। মানুষজন ভিড় করে দেখে কেউ বলল, “এইডা তো ডাক্তার গো-হাকিম!”
সে রাতে বাড়ি ফিরে আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে বলল, “আমি হাকিম, তবে এখন হইমু ডাক্তার হাকিম!”
পরদিন থেকে সে পড়াশোনার পোকা হয়ে গেলো। গরুর দুধ বিক্রি করে কিনে আনলো বাংলা ব্যাকরণ, গণিতের বই আর ‘গরু পালন কৌশল’ বিষয়ক একটা পুরান পুস্তিকা। বসে বসে পড়া আর প্র্যাকটিস। এমনকি মাটিতে গরুর গোবর দিয়ে অঙ্ক কষতেও পিছপা হতো না।
গ্রামের লোকজন ভাবলো, হয়তো মাথায় রোদ লেগেছে।
মেয়েরা আড়ালে বলতো, “গো-হাকিম এখন পাগল হইছে। গোবর দিয়ে গুনাগুন করতেছে!”
তবে কেউ জানতো না, এই গো-হাকিম প্রতিদিন রাতে কেরোসিন বাতির আলোয় পড়াশোনা করে আর স্বপ্ন দেখে, সে একদিন হবে ‘গরু-বিশেষজ্ঞ ডাক্তার’।
কয়েক বছর পর, বিস্ময়ের ব্যাপার হলোÑ সে সত্যিই মাধ্যমিকে পাস করে বসলো। সবাই বললো, “গরু চরানো ছেলে এত বই কেমনে পড়লো?”
সে বললো, “গরু যেমন ঘাস চিবায়, আমি তেমনে বই চিবাই!”
এরপর সে ভর্তি হলো ভেটেরিনারি কলেজে। শহরে গিয়ে তার প্রথম কাজ ছিল গলায় গামছা ফেলে স্যারদের সামনে দাঁড়িয়ে বলা, “স্যার, গরু রোগে গোঁ গোঁ করে কেন?”
স্যাররা অবাক। ছাত্র তো সোজাসুজি প্রশ্ন করে! তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে বদলে গেলো। শিখে ফেললো বড় বড় শব্দ, “বোভাইন অ্যাসিডোসিস”, “ম্যাস্টাইটিস”, “জিন-এডিটিং” ইত্যাদি।
বন্ধুরা তাকে ডাকতো “গো-ডক্টর”।
সেই গো-হাকিম, যে একদিন গরুর লেজ ধরে দৌড়াতো, এখন একাডেমিক কনফারেন্সে দাঁড়িয়ে বলে,
“বাঙলাদেশের গবাদিপশুর উন্নয়নে জেনেটিক মডেলিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেৃ”
গ্রামের মানুষ তখন গর্বে ফেটে পড়ে। হেডমাস্টার স্যার বলেন ,“এই হইলো গ্রামের গর্ব, যেই ছেলে একসময় খাতা না চেনতো, এখন খাতায় গরুর রোগ লেখে।”
অবশেষে সে গ্রামে ফিরে এলো এক বিশাল হোন্ডায় চড়ে। কাঁধে স্টেথোস্কোপ, গায়ে সাদা এপ্রোন, আর পেছনে লেখা” ড. আব্দুল কাইয়ুম (উরফে গো-হাকিম), গবাদিপশু বিশেষজ্ঞ”।
পুরো গ্রাম একনজর দেখতে ভিড় জমালো। ছোট ছেলেরা বললো,“ওই যে গো-হাকিম কাকা! ডাক্তার হইছে!”
তবে এক বৃদ্ধা চাচি দাঁড়িয়ে বললেন,
“আরে বাবা, ও তো এখন বড় হইছে, গো-হাকিম না, হাকিম-ডাক্তার!”
গো-হাকিম হাসলো। বললো, “চাচি, নাম পাল্টাইলেও হৃদয় পাল্টায় না। আমি এখনও গরুর ভাষা বুঝি!”
গল্পের শেষে দেখা গেলো, সে এখন শুধু ডাক্তার নয়, একজন ব্যতিক্রমী আদর্শ। গ্রামের ছেলেমেয়েরা এখন গরু চরানোর ফাঁকে বই পড়ে। কেউ কেউ বলে “গরু চরায়া যদি হাকিম হওয়া যায়, তাইলে আমরাও পারি!”