জুবায়ের হুসাইন
ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমানোটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে শামীমের। জানে এটা ঠিক হচ্ছে না, তারপরও কিছুতেই না ঘুমিয়ে পারছে না।
কাল শুক্রবার থাকায় বেশ রাত অবধি টিভি দেখেছে ও। স্টার মুভিজ আর এইচবিও-তে ইংরেজি মুভিগুলো দেখে ও। বিশেষ করে অ্যাকশনধর্মী আর ডিটেকটিভ গল্পগুলো ওর দারুণ পছন্দের। অবশ্য হরর মুভিও দেখে, মাঝে মধ্যে। আর টিভি দেখার সুযোগ এভাবে সবসময় হয়ও না। ওর অন্য বাসামেটরাও টিভি দেখে। একেকজনের একেক বিষয় পছন্দ। তাই একসাথে টিভি দেখতে বসলে কেউই নিজের পছন্দেরটা দেখতে পারে না। শামীম তাই রাতের শেষের দিকের অংশটাই বেছে নিয়েছে। এ সময় অন্যরা সবাই ঘুমিয়ে পড়ে।
ও হ্যাঁ, বাসামেটের বিষয়টা পরিষ্কার করা দরকার। শাশীমরা একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। ভাড়াটা একটু বেশি হলেও ওরা তা মেনে নিয়েছে। কারণ, মেসে থাকলে তো আর বাসা বাসা একটা ভাব আসে না। সবাই ব্যাচেলর ওরা। অবশ্য ঢাকা শহরে ব্যাচেলর বাসা ভাড়া পাওয়াও বেশ কষ্টের। বাসাতে থাকে বলেই বাসামেট বলে ওরা নিজেদেরকে।
শেষ রাতের দিকে বৃষ্টি হয়েছে। চলেছে একটানা অনেকক্ষণ। রুমের জানালা দরোজা বন্ধ থাকায় বাইরে কী হয় না হয় তা বোঝা যায় না। আর একবার ফ্ল্যাটে প্রবেশ করলে সহজেই বের হয় না শামীম। প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিস ও অফিস থেকে ফেরার পথেই কিনে নিয়ে আসে। অবশ্য দোকানে গিয়ে কেনাকাটা করতেও ওর দারুণ অনীহা। কোনো দোকানে অন্য কোনো ক্রেতা থাকলে ও সে দোকানে যায় না। ফাঁকা দেখে কোনো দোকানে গিয়ে কেনাকাটা। এ কারণে অনেক দরকারি জিনিস অনেক সময় কেনা হয়ে ওঠে না। এই যেমন, গত এক মাস ধরে সেভিং ক্রিম কিনবে কিনবে করছে, বাসায় ফেরার পথে মনেও থাকে, কিন্তু দোকানের সামনে এলেই দেখে দোকানে কোনো না কোনো খদ্দের আছে। ব্যস, সেভিং ক্রিম ছাড়াই ও বাসায় চলে আসে।
ফজরের নামাজ পড়ে যথারীতি শুয়ে পড়েছিল ও। এটা ওটা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল। কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা রাগছে। সারারাতের গরমের কষ্টটা কিছুটা লাঘব হচ্ছে এতে। আরাম আরাম লাগায় দেরিতেই ঘুম ভাঙলো শামীমের। বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটা সামনে এনে বাটন চেপে দেখল কয়টা বাজে। প্রথমে ঝাঁপসা দেখল। বার তিনেক চেষ্টার পর দেখল আটটা পনেরো বেজে গেছে। ধড়মড় করে বিছানা থেকে নামল শামীম। আজ নির্ঘাত দেরি হয়ে যাবে। সাত মাসের অফিসে আজই ও দেরিতে পৌঁছবে ধরে নিয়েছে।
তাড়াহুড়োয় ব্রাশে পেস্ট লাগাতেও ভুলে গেল। ফলে দাঁতে ঘষার পর যখন ফেনা হচ্ছে না তখন বিরক্তিতে চোখ কুঁচকে ফেলল। তারপর হড়হড় করে গায়ে পানি ঢেলে কোনোরকম গোসল সেরে রুমে গিয়ে জামাকাপড় পরল। নাশতা না করেই ফ্ল্যাটের দরোজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। এবং থমকে দাঁড়াল। বাইরে অঝোর ধারায় ঝরে চলেছে বৃষ্টি। আবারও রুমে ঢুকল। টেবিলের নিচ থেকে ছাতাটা নিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। নাহ্, ছাতায় বৃষ্টি বানাচ্ছে না। তাছাড়া রাস্তায়ও পানি জমে গেছে। হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। এদিকে রিকসাও দেখা যাচ্ছে না। আজ নির্ঘাত হাজিরা খাতায় লাল কালি পড়বে- ভাবল ও।
একটা রিকসা এলো। কিন্তু ওর কাছে আসার আগেই আরেকজন তাতে উঠে বসল।
মোবাইল থাকাতে এখন আর হাতঘড়ি ব্যবহার করে না অনেকেই। শামীমও যেহেতু অনেকের মধ্যে পড়ে, তাই ও-ও হাতঘড়িকে বিদায় করে দিয়েছে। প্যান্টের বাম পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে টাইম দেখল। পৌনে দশটা বাজে। ওর চোখজোড়া একটা রিকসা খুঁজে চলল। হ্যাঁ, ওইতো আসছে একটা রিকসা। হাত ইশারায় কাছে ডাকল রিকসাওলাকে। কাছে আসতেই দিলকুশা বলে উঠে পড়ল। একটু খারাপও লাগছে দশ মিনিটের পায়ে হেঁটে যাওয়া পথটা টাকা খরচ করে রিকসায় করে যেতে হচ্ছে বলে।
রিকসাওলা রিকসা টান দিল। অমনি পাশ থেকে আরেকজন উঠে পড়ল ওর রিকসায়। বেশ ধোপদুরস্ত কাপড় পরা লোকটা। গলায় আবার একটা টাইও ঝুলছে।
‘আপনি নিশ্চয়ই দিলকুশা যাবেন?’ জিজ্ঞেস করল লোকটা।
‘হ্যাঁ,’ বলে মাথা নাড়ল শামীম। জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি?’
‘আমিও দিলকুশা যাব।’
‘ও।’
ঢাকা শহরের রিকসাগুলো ক্রমেই যেন ছোট হয়ে যাচ্ছে। শামীমের মতো রোগাপাতলা ছেলের পাশে যে বসেছে, সেও হালকা গড়নের। তবুও দু’জন বসা বেশ কষ্টের হয়ে যাচ্ছে।
ছাতাটা গুটিয়ে বাইরে ধরে রেখেছে শামীম। হাতটা ব্যথা করছে এভাবে ছাতা ধরে রাখতে। হাত বদলানোরও উপায় নেই, কারণ অন্য হাতটা ব্যস্ত আছে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে সবুজ রঙের পলিথিনের পর্দা ধরে রাখতে।
পথে দু’জনার মধ্যে কোনোই কথা হলো না।
রিকসা দৈনিক বাংলা মোড় হয়ে বক চত্বরের সামনে যেতেই শামীমের সঙ্গী রিকসাওলাকে বলল, ‘এখানে আমাকে নামিয়ে দেন।’ রিকসাওলা রিকসা দাঁড় করালে ছেলেটি শামীমকে জিজ্ঞেস করল, ‘কত ঠিক করেছেন?’
শামীম বলল, ‘আপনি যান, ভাড়া আমিই দিয়ে দেব।’
‘তা কী করে হয়? দু’জনেই শেয়ার করব।’ বলে পকেট থেকে মানিব্যাগ টেনে বের করল ছেলেটি।
শামীম আর বাধা দিল না। ছেলেটি দশ টাকার একটা নোট শামীমের হাতে ধরিয়ে দিল। বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ।’
শামীমের রিকসা আবার চলতে শুরু করল। তারপর অফিসের সামনে এলে ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়ল।
যতটা ভেবেছিল তা হয়নি, দুই মিনিট আগেই পৌঁছতে পেরেছে ও অফিসে। যথারীতি হাজিরা খাতায় সিগনেচার করে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসল।
নাহ্, আজ মোটেই কাজে মন বসছে না। মনটা কেমন উড়ু উড়ু লাগছে।
দুপুর হয়ে গেছে। অন্য কলিগদের সাথে একত্রে দুপুরের খাবার খেয়ে নিল। কুরিয়ারের খাবার খায় ওরা। একটা লোক প্লাস্টিকের বাটিতে করে ভাত দিয়ে যায়। এজন্য এর নাম হয়েছে কুরিয়ার। সপ্তাহ শেষে সপ্তাহের বিল পরিশোধ করতে হয়।
আজ বাটির ভাত পুরোটাই খেল শামীম। সকালে নাশতা করেনি, তাই ক্ষিধেটাও ছিল অন্যদিনের তুলনায় বেশি। অন্যান্য দিন ও বাটির ভাত সব খেতে পারে না। ইচ্ছে করে না।
তিনটার দিকে চা খাওয়ার জন্য বের হলো শামীম। এবং একটা বিষয় দেখে থমকে দাঁড়ালো। বিষয়টা খুবই অবাক করল ওকে।
ওদেরকে যে কুরিয়ারের খাবার দিয়ে যায়, সেই লোকটা বাটিগুলো এক জায়গায় জড়ো করেছে। তারপর ভ্যানে রাখা একটা বাক্সে সেগুলো ঢুকাচ্ছে। কিন্তু তা ঢুকানোর আগে প্রত্যেক বাটির মুখ খুলে ভেতরে থেকে যাওয়া উচ্ছিষ্ট খাবারের অংশটুকু এগিয়ে দিচ্ছে পাছে একটু বড় একটা বাটি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মাঝবয়েসি এক মহিলার দিকে। মহিলা বাটি থেকে খাবারের উচ্ছিষ্ট নিয়ে নিজের বাটিতে রাখছে এবং ওই বাটিটা লোকটিকে ফিরিয়ে দিচ্ছে।
একদৃষ্টে সেদিকেই তাকিয়ে রইল শামীম অপলকে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না ও। বাড়িতে ওর মা আছেন। এই মহিলার বয়সিই হবেন তিনি। মুহূর্তেই মায়ের স্নেহভরা মুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। করুণা ঝরে পড়ল ওর চোখেমুখে। চোখজোড়া বোধহয় ভিজেও উঠেছিল। পাশ থেকে ওর এক কলিগ বলল, ‘কি চা খাবেন না এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবেন?’
সম্বিৎ ফিরে পেল শামীম। কোনোরকমে চা খেয়ে আবার নিজের ডেস্কে গিয়ে বসল। ছুটির আগ পর্যন্ত ওই বিষয়টাই ওর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল। কেন জানি মায়ের মুখটা বারবারই ভেসে উঠছে।
কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে ওর মা লোকের উচ্ছিষ্ট খাবার নিয়ে নিজের বাটি ভরছে। তারপর তা নিয়ে আসছে বাড়িতে। শামীমরা ভাই-বোনেরা মিলে তা পরম তৃপ্তির সাথে খাচ্ছে। আর মা আদরমাখা হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ওদের শরীরে-মাথায়। মায়ের আদর পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল শামীমের অন্তরটা। অস্ফুটে মুখ দিয়ে বেরিয়েও এলো, ‘মা!’
পাশ থেকে একরাম সাহেব বললেন, ‘কি শামীম সাহেব, মোবাইল ছাড়াই মায়ের সাথে কথা বলছেন নাকি?’
‘না মানে ইয়ে...’ কী বলবে তা খুঁজে পেল না শামীম।
একরাম সাহেব আবারও বললেন, ‘এক কাজ করেন, দু’দিন ছুটি নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসুন।’
‘হ্যাঁ, ভাবছি সেটাই করব। আপনি একটু সুপারিশ করে দিয়েন ভাই।’
‘আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে স্যার আমার কথা শুনবে তো?’
‘সেটা আমি ম্যানেজ করব। আপনি শুধু সায় দেবেন।’
‘ঠিক আছে। তো কবে ছুটি নিচ্ছেন?’
‘ভাবছি এই সপ্তাহেই নেব।’
সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সমস্ত রাস্তা বৃষ্টি ধোয়া। থোকা থোকা পানি জমে আছে একানে ওখানে। ছাতাটা মুড়ে হাতে দোলাতে দোলাতে বাসায় ফিরছে শামীম।
আকাশের মুখ গোমড়া করা ভাব এখনও কাটেনি। যেকোনো সময় আবারও নামতে পারে বৃষ্টি। মনে হচ্ছে আরও কিছুদিন থাকবে বৃষ্টিটা। এখন নিম্নচাপ চলছে বোধহয়। আবহাওয়ার খবর একদম দেখা হয় না এখন। কাজেই এখন বাংলা কী মাস তাও বলতে পারবে না। শামীমের বিশ্বাস, ওর মতো অধিকাংশ মানুষই এটা বলতে পারবে না। আবহাওয়ার খবর রাখে না কেউ। ইট-পাথরের এই শহরে ওসব খবর রাখার সময় কই? তার চেয়ে যেটুকু অবসর পাওয়া যায়, সেটুকু সময় শেয়ার বাজারের পেছনে ব্যয় করলে অনেক লাভ। নয়তো টিভিতে কোনো সিরিয়াল দেখে একটু বিনোদনের চাহিদা মেটানো আর কি! আর যারা শামীমের মতো অ্যাকশন, ডিটেকটিভ বা হরর ছবির পোকা, তাদের তো আবহাওয়া বা বাংলা মাস-তারিখ নিয়ে মাথা ঘামাবার সময়ই নেই।
অফিস পাড়া দিয়ে হেঁটে বাসায় ফিরছিল শামীম। ওর মতো অনেকেই হাঁটছে। এই মুহূর্তে রাস্তাটায় ভিড়ও বেড়েছে। সবার মধ্যেই বাড়ি ফেরার তাড়া। ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহটা টেনে নিয়ে চলেছে।
একটা লোকের সাথে ধাাক্কা খেল শামীম। তবে ওর মনে হলো লোকটা ইচ্ছে করেই ওর সাথে ঢাক্কা খেল। কড়া ভাষায় কিছু বলতে গিয়েও বলল না শামীম। ও অমনই। প্রতিবাদের অনেক ভাষাই মনের মধ্যে জেগে ওঠে। কিন্তু সেটা মনেই চেপে যায়। কাউকে কিছু বলতে পারে না।
‘বাজান দুডো ট্যাহা দিবেন? ভাত খামু।’
থমকে দাঁড়াল শামীম। রাস্তার পাশে বসে এক মহিলা করুণ মুখে ওর দিকে তাকিয়ে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে। মহিলাকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেয়েও যেতে পারল না শামীম। এর আগেও ও এই পরিস্থিতিতে পড়েছে। কিন্তু এভাবে থমকে দাঁড়ায়নি কোনোবার। এইবারই প্রথম এই রকম হচ্ছে। আসলে আজ দুপুরের ওই ঘটনাটা দেখার পর থেকেই ওর মনটা কেমন যেন হয়ে আছে।
মানিব্যাগ বের করার জন্য পকেটে হাত ঢোকালো শামীম। কিন্তু পরক্ষণই চমকালো। ওটা নেই পকেটে। তারমানে পকেটমার হয়ে গেছে। এইবার বুঝল একটু আগে লোকটার ইচ্ছে করে গায়ের উপর পড়ার রহস্য।
ফ্যালফ্যাল করে মহিলার দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত শামীম।
মহিলা আবারও বলল, ‘দেবেন বাবা দুডো ট্যাহা?’
‘হা হা’ করে উঠল শামীমের বুকের ভেতরটা। নীরব একটা বেদনা চিন চিন করে শিড়দাড়া বেয়ে উঠে গেল উপরের দিকে।
আকাশের কোনায় ‘ঝক্কাস্’ করে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। পরপরই ‘কড়্ড়াৎ’ রবে ডেকে উঠল মেঘ। ঝম ঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেল ঘরে ফেরা মানুষের মধ্যে।
শামীম রাস্তায় নেমে এলো। দু’হাত প্রসারিত করে মুখ তুলল আকাশের দিকে।
মেঘের কান্নার সাথে বুকের কান্নাটাকে একাকার করে দিতে চায় শামীম।